কেন বিদেশে লোক যাওয়ার শীর্ষে কুমিল্লা জেলা?

সাবিহা রুমি ● ষাটের দশকের গোড়ার দিকেও কুমিল্লার মোট শ্রমশক্তির ৯৩ শতাংশই ছিল কৃষিমজুর। ভূমির উৎপাদনই ছিল তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি। কিন্তু ভূমির উৎপাদন আশানুরূপ ছিল না। ক্ষুদ্রায়তন কিছু কুটির শিল্প গড়ে উঠলেও জেলায় বৃহদায়তন ও ভারী শিল্প তখনো গড় ওঠেনি। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তাই বিকল্প পেশা খুঁজতে থাকে জেলার অধিবাসীরা। স্বাধীনতার পর থেকেই বিদেশে পাড়ি জমাতে থাকে তারা। আশির দশকে তা ব্যাপকতা পায়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী শ্রমিকের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা কুমিল্লা।

বিদেশে শ্রম অভিবাসনে আগে থেকেই ভালো অবস্থানে রয়েছে কুমিল্লা। সেই ধারাবাহিকতা এখনো ধরে রেখেছে জেলাটি। বিএমইটির হিসাবে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শুধু কুমিল্লা থেকেই চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছে ৬ লাখ ১৯ হাজার ১৩৮ জন।

তাদেরই একজন দাউদকান্দির নয়াকান্দি গ্রামের ইউসুফ হোসেন রাজু। ২০১০ সালে চাকরি নিয়ে সিঙ্গাপুরে যান তিনি। দুই বছর পর তার আরেক ভাই আবুল বাশারও পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। সম্প্রতি একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন ছোট ভাই জিশান আহমাদ। তিনিও চেষ্টা করছেন জার্মানি যাওয়ার।

বিদেশ যাওয়ার কারণ হিসেবে জিশান আহমাদ বলেন, তার দুই ভাই আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য বিদেশে গেছেন। দেশে চাকরির সীমিত সুযোগ ও কম বেতনের কারণেই বিদেশে পাড়ি দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন তারা।

চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার এ প্রবণতা কুমিল্লার মানুষের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে বলে জানান জেলা জনশক্তি রফতানি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মাহমুদ উল্লাহ আকন্দ। তিনি বলেন, কয়েক

বছরে চাকরি নিয়ে এ জেলার মানুষের বিদেশ গমনের হার বেড়ে গেছে। গত বছরও কুমিল্লা থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে ৪২ হাজার ৫১১ জন।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত এক দশকে শুধু কুমিল্লা জেলা থেকেই বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে ছয় লাখের বেশি মানুষ, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া মোট জনশক্তির যা প্রায় ১১ শতাংশ। বিভিন্ন দেশে শ্রম অভিবাসনে এর পরই রয়েছে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল ও ঢাকা জেলা। চাঁদপুর, নোয়াখালী ও মুন্সীগঞ্জ জেলা থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন দেশে কর্মরত।

জনশক্তি রফতানিকারকরা বলছেন, অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় এগিয়ে থাকা অঞ্চলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি বেশি। এসব অঞ্চল থেকে শ্রমিক অভিবাসনের হারও তাই বেশি। এছাড়া আগে থেকেই যেসব জেলার লোকজন বিদেশে রয়েছে, সেখান থেকেও বেশি সংখ্যায় বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে লোকজন।

কুমিল্লার পরই গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশে গেছে চট্টগ্রাম জেলা থেকে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জেলাটি থেকে বিভিন্ন দেশে গেছে ৫ লাখ ৪১ হাজার ৭০৯ জন, যা ওই সময়ে দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়া মোট জনশক্তির ৯ দশমিক ৫ শতাংশ।

জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি বেনজির আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা জেলাগুলোর বেশি সংখ্যক মানুষ আগে থেকেই বিদেশে কর্মরত ছিল। রিক্রুটিং এজেন্সির পাশাপাশি বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে এসব জেলা থেকেই বেশি সংখ্যায় মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সে তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলো থেকে বিদেশে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কম।

বিএমইটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সবচেয়ে কম মানুষ বিদেশে যাচ্ছে বান্দরবান থেকে। গত ১০ বছরে জেলাটি থেকে বিদেশে গেছে মাত্র ২ হাজার ২১৫ জন, যা মোট অভিবাসনের দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। উত্তরাঞ্চল থেকেও তুলনামূলক কম মানুষ বিদেশ যাচ্ছে। গত এক দশকে পঞ্চগড় থেকে ৩ হাজার ১৯০, লালমনিরহাট ৪ হাজার ৪৫৩, ঠাকুরগাঁও ৭ হাজার ৪৬২, কুড়িগ্রাম ১১ হাজার ৪৫৯, জয়পুরহাট ১২ হাজার ৫২৬, দিনাজপুর ১৪ হাজার ৯১৮ ও রংপুর থেকে ১৯ হাজার মানুষ কাজের উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে।

তবে অর্থনৈতিক সূচকে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলো থেকেও যাতে অধিক সংখ্যক কর্মী বিদেশে পাঠানো যায়, সে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ। তিনি বলেন, একসময় রংপুর অঞ্চলকে মঙ্গাপীড়িত বলা হতো। তখন সে অঞ্চল থেকে ৪ শতাংশের একটি কোটা ছিল। এখন মঙ্গা জয় হয়েছে। অর্থনৈতিক সূচকে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলো থেকেও অধিক সংখ্যক লোকের বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। কোন জেলা থেকে কত সংখ্যক লোককে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে একটি সার্কুলার দিয়ে তা জানাতে পারব বলে আশা করছি।

উল্লেখ্য, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৩ লাখ ৬ হাজার ৭৩ জন বাংলাদেশী কাজ নিয়ে বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালে গেছেন ৫৭ লাখ ৭৪ হাজার ৫৪০ জন।

The post কেন বিদেশে লোক যাওয়ার শীর্ষে কুমিল্লা জেলা? appeared first on Comillar Barta™.



from Comillar Barta™ http://ift.tt/2goKqye

November 25, 2016 at 08:22PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top