রোহিঙ্গা সমস্যাটা ব্রিটিশদের তৈরী।
হিংস্র বুদ্ধরা বাঙালী ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের তুচ্ছার্থে কালা নামে ডাকে??!
মুহাম্মদ নূরে আলম ।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক ।
বার্মায় চলছে মুসলিম নিধন, নিজ পৈত্রিক ভূমি থেকে বিতাড়িত বার্মার মুসলমানরা বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের প্রতিহিংসার শিকার। বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের আগ্রসী দমন নীতির ফলে আমার মুসলিম ভাইয়েরা আজ সর্বস্ব হারিয়ে পড়েছে উভয় সংকটে। যাকে বলে জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। তারা না পারছে থাকতে না পারছে নিজেদের বসত ভিটায় ফিরতে ?? আর না পারছে একজন মানুষ হিসেবে তার মৌলিক অধিকার নিজে বাঁচতে। বার্মার মুসলমানরা গরীব বা অশিক্ষিত ছিল না। তারা শিক্ষা দীক্ষায় ব্যবসা বাণিজ্যে ছিল উন্নত । দেশের সামরিক সরকার আর হিংস্র সন্ত্রাসী বৌদ্ধরা কেড়ে নিয়েছে মুসলমানদের সব কিছুই। আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা মুসলিম।
দেশটিকে এক সময় আমরা বাংলায় বলতাম ব্রহ্মদেশ। আর ইংরেজিতে বলতাম বার্মা (Burma)। ফারসিতে বলা হতো বারহামা। এই বারহামা নাম থেকেই ইংরেজিতে উদ্ভব হতে পেরেছিল বার্মা নামটি। ‘ম্রনমা’ শব্দটার মানে হলো মানুষ, যাদের আমরা এক সময় বলতাম বর্মি, তারা নিজেদের বলেন ‘ম্রনমা’। মিয়ানমার নামটি এসেছে ম্রনমা নাম থেকে। ১৯৮৯ সালে ১৮ জুন থেকে বার্মার সরকারি নাম রাখা হয়েছে মিয়ানমার। ম্রনমা ভাষায় ‘র’-এর উচ্চারণ করা হয় না। যদিও তা লেখা হয়। তাই ম্রনমা ভাষায় দেশটির নাম দাঁড়ায় উচ্চারণগতভাবে মিয়ানমা।
রোহিঙ্গাদের সমস্যাটা ব্রিটিশরা তৈরী করে যায়, পরিকল্পনা করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে মানচিত্রের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করে যায়। যাতে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানরা শক্তিশালী না হতে পারে। তাই কৌশলে কাশ্মীর সমস্যা,পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম এলাকা ভারতের ভিতরে রেখে দেয়ার মাধ্যমে সমস্যা, সিটমহল সমস্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়াদা করেও আরাকানকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা না করে, না বাংলাদেশ না বার্মা মাঝখানে রেখে যাওয়ার সমস্যা, অনির্ধারিত সীমান্ত রেখে যাওয়ার সমস্যা, এইরকম অসংখ্য সমস্যার মূলে ব্রিটিশরা।
জাতিতে জাতিতে বিভাজন ইংরেজরা তৈরী করে গেছে। আর ঐক্যবদ্ধ মুসলমানদেরকে করে গেছে বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন। ওয়াদা অনুযায়ী স্বাধীনতা তো দেয়নি বরং বার্মার নৃ গোষ্ঠীর তালিকা তৈরী করার সময়ে ইংরেজরা ১৩৯ জনগোষ্ঠীর তালিকা থেকে আরাকানের ( রোহিঙ্গা) মুসলমানদের বাদ দেয়?! আর এতে সুযোগ পেয়ে যায় অতি হিংস্র বর্ণবাদী বুদ্ধরা বাঙালী ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের তুচ্ছার্থে ঘৃণা বরে কালা নামে ডাকে। আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন এই বুদ্ধরা কতো হিংস্র নরপশু।
ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। আমাদের ‘প্রাক্তন ব্রিটিশ শাসকরা’ মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের কত যে গোলমাল করে গেছে ব্রিটিশরা তার হিসেবে নেই !
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা ‘কালা’ বলে। ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা।
মুসলিম বসতি :
আরাকান এখন মিয়ানমারের অংশ। কিন্তু আরাকান (যাকে এখন বলা হচ্ছে রাখাইন প্রদেশ) তা ছিল গৌড়ের সুলতানদের সামন্তরাজ্য। আরাকানের এক রাজা (মেং সোআম্উন) পালিয়ে আসেন গৌড়ে। কারণ দক্ষিণ বার্মার এক রাজা দখল করেন তার রাজত্ব। গৌড়ের সুলতান জালাল-উদ্দীন মুহম্মদ শাহ তাকে তার রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সৈন্যসামন্ত দিয়ে সাহায্য করেন। এবং তিনি তার রাজত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারেন গৌড়ের প্রদত্ত সৈন্যসামন্ত দিয়ে, যাদের বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমান, তারা প্রধানত হলেন এদের বংশধর। আরাকানের রাজা গৌড় থেকে যাওয়া মুসলমান সৈন্যসামন্তকে তার রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য রেখে দেন আরাকানে। আরাকানের রাজা নতুন রাজধানী স্থাপন করেন, যার নাম দেন রোহং। রোহংকে বাংলায় বলা হতে থাকে রোসঙ্গ নগর। এক সময় গোটা আরাকানকেই বাংলায় বলা হতো রোসাঙ্গ দেশ। আরাকানের সব মুসলমানই অবশ্য রোহিঙ্গা নন। যদিও আরাকানবাসী মুসলমানেরা সাধারণভাবে এখনো রোহিঙ্গা নামেই পরিচিত। কিন্তু পুরো উত্তর আরাকানে এক সময় চলেছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। আরাকানের উত্তরাঞ্চলে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বহু মুসলমান গিয়ে উপনিবিষ্ট হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরাকানসহ পুরো বার্মা চলে যায় জাপানের দখলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আরাকানে মুসলমানদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ব্রিটেন বলে, আরাকান আবার তারা ফিরে পেলে উত্তর আরাকানকে পৃথক করে গড়া হবে একটি পৃথক প্রদেশ। এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করবে। কিন্তু ইংরেজরা ওয়াদা ভঙ্গ করে।
আরাকানে মুসলমানদের বসতি হাজার বছরেরও বেশি পুরনো, তার পেছনে দলিল রয়েছে। সে দলিল রয়েছে খোদ মিয়ানমারে। সেখানে মুসলমান বসতির সূত্রপাত প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ড. মুহাম্মদ এনামুল হক আরাকানের জাতীয় ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থ ‘রাজোয়াং’ থেকে নিম্নোক্ত বিবরণটি উদ্ধৃত করেছেন : “খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষ পাদে যখন আরাকান রাজ মহতৈং চন্দয় (গধযধঃড়রহম ঞংধহফুধ- ৭৮৮-৮১০ অ.উ.) রাজত্ব করছিলেন, তখন কতকগুলো মুসলমান বণিক জাহাজ ভাঙিয়া যাওয়ার ফলে আরাকানের দক্ষিণ দিকস্থ ‘রনবী’ (আধুনিক রামরী) দ্বীপে উঠিয়া পড়েন। তাঁহারা আরাকানীগণ কর্তৃক ধৃত হইয়া রাজার সম্মুখে নীত হয়েছিলেন। রাজা তাঁহাদের দুরবস্থা দেখিয়া দয়াপরবশ হইয়া তাঁহাদিগকে স্বীয় রাজ্যে গ্রামে গিয়া বসবাস করিতে আদেশ দিয়াছিলেন।” ড. এনামুল হক মনে করেন যে, “রাজোয়াংএ উল্লিখিত এ সব মুসলমান বণিক আরব দেশীয় ছিলেন এবং চাটগাঁ থেকে উপকূল বেয়ে দক্ষিণ মুখে যাবার পথে, কিংবা দক্ষিণ উপকূল হয়ে উত্তরে চাটগাঁর দিকে এগুবার সময়ই ঝঞ্ঝাতাড়িত হয়ে সম্ভবত তারা রামরী দ্বীপে গিয়ে আশ্র্য় নিয়েছিলেন।” সুপ্রাচীন আরবীয় ঐতিহ্য অনুসারে একই সাথে জীবিকা অর্জন ও ধর্ম প্রচারের সুমহান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানেরা দলে দলে নৌ ও স্থলপথে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরই অংশ হিসেবে খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে বার্মায় মুসলিম উপনিবেশ গড়ে ওঠে। জীবন-জীবিকার অনিবার্য প্রয়োজনে স্থানীয় মহিলাদেরকে বিবাহ-শাদি করে তারা সেখানে ধনে-জনে বর্ধিত হতে থাকে।
মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ হামলার কথা নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী লেখা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক Time পত্রিকায় (১ জুলাই ২০১৩ সংখ্যায়)। টাইম পত্রিকা মুসলিমদের দিয়ে কোনোভাবেই প্রভাবিত নয়। তার প্রতিবেদনকে তাই গ্রহণ করতে হয় যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ হিসেবে। শুধুমাত্র টাইম ম্যাগাজিন নয় বার্মার মুসলমানদের উপরে গণহত্যার চিত্র আল জাজিরাসহ সব মিডিয়া প্রচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
মিয়ানমার (বার্মায়) রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনের ব্যাপারটিও রুয়ান্ডারই অনুরূপ এর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে মুসলমানদের খতম করা। মুসলিম গণহত্যা দ্বারা মানুষরূপী এসব শয়তানের এজেন্টদের বাড়তি উদ্দেশ্য হলো, একদিকে মানুষের বংশ নিধন অপরদিকে আল্লাহর আনুগত্যকারীদের সংখ্যা হ্রাস করে শয়তানদের অধিক সন্তুষ্টি অর্জন করা।
বিশেষ করে বার্মার রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যার প্রতি তাকালে যেসব প্রশ্ন জাগে তন্মধ্যে প্রথম প্রশ্ন হলো এই যে- বার্মার সামরিক এক নায়কত্বের ভেতর থেকে যেই গণতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়ালো সেখানে এই গণহত্যা সত্ত্বেও শান্তির নোবেল প্রাপ্ত বর্মী বিরোধী নেতৃত্বে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া নেই কেন? সারা দুনিয়ায় এই বেদনাদায়ক গণহত্যার বিষয়টিকে কেন ব্লেক আউট করে রেখেছে? মুসলিম বিশ্বের মিডিয়াগুলোর চোখ এ ব্যাপারে কেন বন্ধ হয়ে আছে? কোনো পক্ষ থেকেই ইসলাম দুনিয়ার চোখ খোলার কোনো প্রকার চেষ্টা হচ্ছে না। এ ঘটনাতো শুধু এটিই প্রথম নয়- এর আগে থেকেই রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন ও নিপীড়নের কাজ চলে আসছে।
বর্মী সামরিক সরকার কি এতই শক্তিশালী যে, তারা আন্তর্জাতিক নিয়ম-রীতি লঙ্ঘন করে মনে যা চাইবে তাই করতে থাকবে, কিন্তু জিজ্ঞাসা হলো, সকলের মধ্যে এই নীরবতা কেন? বিভিন্ন সরকারের চাপ ইসলামী সম্মেলন সংস্থা, সার্ক সম্মেলন এ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সকল ফোরাম থেকে নানানভাবে কার্যকর প্রেসার আসা কর্তব্য। অন্যথায় মানবতাবিরোধী গণহত্যায় সকলের এই নীরবতার ফলে মানুষ নামের দানবদের কর্মকান্ডের পরিণতি এক সময় অন্যদেরও ভোগ করতে হবে।
মুসলিম বিশ্ব ইসলামী সম্মেলন সংস্থা এবং গণতন্ত্র প্রিয় দুনিয়াবাসী থেকে অনেক কিছু আশা করেছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দিনের দিন যেন সব আশা ভরসা নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। মানবসভ্যতা পশ্চাৎমুখী হতে চলেছে। মানবতাকে এই অন্যায় ও দুরবস্থার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে জাতিসংঘ সনদকে কার্যকর করার জন্য বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের অবশ্যই সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। অন্যথায়, বিশ্ব আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাবস্থার মতো অমানবিকতা ও বর্বরতার দিকে ধাবিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের নামে আবারো মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে আরাকানে। স্থানীয় মগজনগোষ্ঠী এবং প্রশাসনের প্রকাশ্য সহায়তায় আরাকানের মংডু এবং আকিয়াব এলাকায় চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ। রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বিরাণভূমিতে পরিণত করছে গ্রামের পর গ্রাম। রোহিঙ্গা যুবতি নারীদের অপহরণ করা হচ্ছে নির্দ্বিধায়। ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক যুবতি নারীকে অপহরণ করা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। খাল, বিল এবং জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মহিলাদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলমানদেরকে হত্যা করে তাদের দাড়ি গোঁফ মুড়িয়ে গেরুয়া পোশাক পরিয়ে বৌদ্ধলাশ সাজিয়ে মিডিয়ার সামনে মুসলমানদেরকেই দাঙ্গা সৃষ্টিকারী এবং ঘাতক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে সেখানে। মানবিক বিপর্যয়ের এক জলন্ত জাহান্নামে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গাদের বসতভিটে। এমন নির্মমতায় প্রাণ হারাচ্ছে অসহায় নারী শিশু ও বৃদ্ধসহ সেখানকার খেটে খাওয়া অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত সমগ্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। সর্বস্ব হারিয়ে নিজেদের প্রাণটুকু বাঁচানোর তাগিদে তারা পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিতে সক্ষম কিনা কিংবা আশ্রয় দিলেই এ সমস্যার সমাধান হবে কি না এসব বিতর্কের কারণে বাংলাদেশ সরকারও ভীষণভাবে কঠোরতা অবলস্বন করে তাদেরকে আশ্রয়ের কোনো সুযোগ দিচ্ছে না। বরং আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের দৃঢ়চেতা বক্তব্যে জাতি আশাহত হয়েছে। এমনকি যারা মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল, নদীর অথৈ জলে অসহায় মানুষদের খাবার পানীয় সরবরাহ করছিল তাদের দিকে জাতিগত দাঙ্গার মদতদাতার অভিযোগ তুলে বিবেকবান মানুষকে হতবাক করেছে।
নির্যাতিত নিষ্পেষিত অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করা তো দূরের কথা বরং যারা কিছু করার চেষ্টা করছেন তাদের দিকেও অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষত সন্দেহের আঙ্গুল উচ্চকিত করা হচ্ছে। ফলে আহত ও নির্যাতিত অসহায় মানুষগুলোকে অবর্ণনীয় কষ্টের মাধ্যমে নদী আর সাগর জলেই মৃত্যুমুখে গমন করতে হচ্ছে।
বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও মানবিক উৎকর্ষতার এ উন্নত যুগে সকলের চোখের সামনে এমন মানবিক বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে নির্বিঘে। কেউ যেন নেই দেখবার, সাহায্যের হাত বাড়াবার কিংবা ন্যূনতম সহানুভূতি প্রকাশ করবার। চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে রাখাইন রাজ্য নামে পরিচিত আরাকানরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী। অথচ তারা আরাকানেরই মূল জনগোষ্ঠী, জন্মগতভাবেই আরাকানের নাগরিক, তাদের হাতেই পরিপুষ্টি অর্জন করেছে আরাকানের ইতিহাস ঐতিহ্য। শুধুমাত্র মুসলিম হবার অপরাধেই তাদের উপর চলছে এ অমানবিক নির্যাতন।
অথচ রোহিঙ্গারাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী মূল ধারার সুন্নী আরব মুসলমান। আরাকান রাজ্যের মুসলিম সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নৃতাত্বিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে আরাকান অঞ্চল থেকে মুসলিম সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বর্তমানে নিজ দেশে নাগরিকত্বহীন অবস্থায় পরবাসী হয়ে জীবন যাপন করছে। অথচ রোহিঙ্গাদের কেউ হাজার বছর, কেউ পাঁচ শতাধিক বছর আর কেউবা কয়েকশত বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে। মূলত বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশেষত ব্রিটিশ বিদায়ের শেষপর্বে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়ে অমীমাংসিত ও প্রশ্নবোধক অধ্যায়ের সূচনা হয়; যার ফলে অদ্যাবধি রোহিঙ্গাদেরকে আরাকানের অভিবাসী আশ্রিত মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে এবং বারবার তাদেরকে স্বদেশভূমির ভিটেমাটি ত্যাগ করে বাংলাদেশে শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে হয়েছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রেক্ষাপট:
আরাকান এককালে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও অধুনাকালে মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। অনুরূপভাবে রোহিঙ্গারাও এক সময় স্বাধীন আরাকানের অমাত্যসভা থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখলেও বর্তমানে তারা আরাকানের সবচেয়ে নিগৃহীত জাতিগোষ্ঠী। ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজ বোধপায়া কর্তৃক আরাকান দখলের মধ্যদিয়েই মূলত রোহিঙ্গাদের নিগৃহীত জীবনের সূচনা হয়। অতঃপর ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তিলগ্নে ব্রিটিশ কূটকৌশলের ফলে তাদের জীবনে দ্বিতীয়বারের মত অনিশ্চয়তা নেমে আসে। স্বাধীনতা-উত্তর বার্মায় ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা নে উইন কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর হতে রোহিঙ্গারা ক্রমশ নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে থাকে। অবশেষে ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনের নামে তাদেরকে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে কল্লা বা বিদেশী আখ্যা দিয়ে দেশ থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে। রোহিঙ্গারা জন্মসূত্রে আরাকানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের জীবনে এ দুর্ভোগের পিছনে নিম্নোক্ত কারণ উল্লেখ করা যায় –
প্রথমত, রোহিঙ্গারা দীর্ঘ হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় আরাকানের অমাত্যসভাসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন থাকলেও তারা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কোনো ধারা সৃষ্টি করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বর্মীরাজ বোধপায়া কর্তৃক ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকান দখলের পর আরাকানের সর্বময় ক্ষমতা বর্মীদের হাতে চলে যায়। তারা পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাসহ আরাকানি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হত্যা করে। অবশিষ্টদের অনেকেই প্রাণ ভয়ে বাংলায় পালিয়ে আসে এবং ১৮২৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের মাধ্যমে আরাকান দখল পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে অবস্থান করে। এ সময়ে সিন পিয়ানসহ অনেক আরাকানি নেতা স্বদেশ পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করলেও বিভিন্ন কারণে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা নেতৃত্বের দিক থেকে আরো পিছিয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, ১৮২৬ সালে আরাকানে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তারা রোহিঙ্গাদেরকে বাহ্যিক কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করে। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রয়োজনেই আরাকানের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ছাড়াও কৃষি, ব্যবসায় প্রভৃতি কাজের জন্য বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানিদেরকে স্বদেশে বসবাসের সুযোগ প্রদান করে। এ সময় রোহিঙ্গাদের নেতৃস্থানীয় শিক্ষিত শ্রেণীর অনেকেই আরাকানে ফিরে না গিয়ে বাংলার কক্সবাজার ও বান্দরবান অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীসহ কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে গেলেও নেতেৃত্বের ক্ষেত্রে নতুন করে কোনো অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। পক্ষান্তরে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা ব্রিটিশের কর্তৃত্বকে সহজে মেনে না নেবার কারণে বরাবরই তারা মুসলমানদেরকে শক্র মনে করতো। ফলে বার্মায় পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর রোহিঙ্গারা যাতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে না পারে সেজন্য তাদেরকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত না করে স্থানীয় মগদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এমনকি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বার্মাকে স্বাধীনতা প্রদানের পূর্বে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মগদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা উত্তর মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন বর্মী ও স্থানীয় মগরা সে ইস্যুকে ক্রমশ শক্তিশালী করে তোলে; যার সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে রোহিঙ্গারা কল্লা বা ভিনদেশী চিহ্নিত হয়ে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়।
ব্রিটিশ শাসিত বার্মাকে মুক্ত করার আন্দোলনে রোহিঙ্গারা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানকে সমর্থন দিয়ে বার্মাকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করলেও তারা তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। স্বাধীনতাউত্তর বার্মার শাসক গোষ্ঠী বিভিন্ন অজুহাতে তাদেরকে মিয়ানমার বা আরাকানের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ না করে শুধুমাত্র আরাকানের বাসিন্দা হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে।
রোহিঙ্গারা আরাকানের স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করলে রাজনৈতিক কৌশলে তাদের এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। অতঃপর তাদের উপর চালানো হয় ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭৮-৭৯ সালে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বালাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের চাপ ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কূটনৈতিক তৎপরতায় বিষয়টির বাহ্যিক সমাধান নিশ্চিত হয়। তাই রোহিঙ্গাদের নিঃশেষ করে দেবার জন্য কৌশল অবলম্বন করে ১৯৮২ সালে বিতর্কিত বর্ণবাদী নাগরিকত্ব আইন ঘোষণা করেন।
এ আইনে নাগরিকদের Citizen, Associate এবং Naturalized শ্রেণীতে ভাগ করে ১৮২৩ সালের পরে আগত বলে Associate কিংবা ১৯৮২ সালে নতুনভাবে দরখাস্ত করে Naturalized Citizen ঘোষণা করার ব্যবস্থা করে। উক্ত আইনের ৪নং প্রভিশনে আরো শর্ত দেয়া হয়, কোনো জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রের নাগরিক কিনা তা নির্ধারণ করবে আইন-আদালত নয়; সরকারের নীতি-নির্ধারণী সংস্থা Council of State. এ আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভাসমান নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রোহিঙ্গাদের কাছে কালো আইন হিসেবে বিবেচিত এ আইন তাদের সহায়-সম্পত্তি অর্জন, ব্যবসায়-বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা সার্ভিসে যোগদান, নির্বাচনে অংশ গ্রহণ কিংবা সভা-সমিতির অধিকারসহ সার্বিক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাসহ প্রচার মাধ্যমগুলো তাদেরকে সেখানকার স্থায়ী নাগরিক হিসেবে সম্বোধন করে।
১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদেরকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মিয়ানমার সরকার বিভিন্ন অপারেশনের নামে আরাকানে এক অমানবিক নির্যাতন চালায়। তবে তাদের এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ অপারেশনে তারা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং দুইপর্বে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে তাদের পৈতৃক বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে প্রতিবেশী বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ সরকার সীমিত সামর্থ নিয়েই অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ত্রাণ কার্যক্রমসহ আশ্রায়ন ক্যাম্প তৈরি করে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতায় বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তথাপিও রোগ-শোক, অনাহার-অর্ধাহারে নাফ নদী পেরিয়ে আসা অসংখ্য লোক প্রাণ হারায়; যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও কৌশল অবলম্বন করে দ্বি-পক্ষীয় ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধান করেন।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে কাজ করলেও রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে শধুমাত্র শরণার্থীদের অস্থায়ী পুনর্বাসন, ভরণ-পোষণ তথা শরণার্থী জীবন যাপনে সার্বিক সহযোগিতা করছে কিন্তু নাগরিক অধিকার দেবার ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করছে না। তাছাড়া মিয়ানমারের মিলিটারি শাসকরা বিশ্ব মতামতের খুব একটা ধার ধারে বলে মনে হয় না। সে দেশের বিরোধী নেত্রী, নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত অংসান সুকি দীর্ঘদিন যাবৎ বন্দী অবস্থায় জীবন যাপন করেছেন। তাকে বন্দী রাখার প্রতিবাদে বিশ্বের সর্বত্র তীব্র প্রতিক্রিয়া হলেও State Law And Order Restoration Council (SLORC) তার প্রতি কর্ণপাত না করে তাদের ইচ্ছামত পদ্ধতিতে নামে মাত্র মুক্তির পথ উন্মুক্ত করছে।
যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার প্রেক্ষাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আরাকানি মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশের সহস্র বছরের বন্ধন ও ঐতিহ্যকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয়সহ বহুমাত্রিক বন্ধনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে দেশের স্বার্থে; মানবতার জন্য বাংলাদেশেরই এগিয়ে আসা উচিৎ। রোহিঙ্গা সমস্যাকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের নিকট গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে; এক্ষেত্রে বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহিত করে ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক মুসলিম সংস্থাগুলো মিলে জাতিসংঘের কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সেইসাথে মিয়ানমার সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিৎ। ১৯৭১ সালে যদি ভারত সরকার বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে না আসতো তবে এদেশবাসীকেও বিপাকে পড়তে হত।
মূলত আরাকানে মুসলিম জাতিস্বত্ত্বা বিনাশ করে এককভাবে মগ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়েই রোহিঙ্গাদেরকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেশের বিভন্ন স্থান থেকে মগদের এনে প্রত্যাবাসন করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে স্বাধীন আবাসভূমি ছাড়া রোহিঙ্গাদের মুক্তির বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই বলে অনেকে মনে করেন।
কিন্তু স্বাধীকার আন্দোলনের নিমিত্তে কিছু কিছু সংগঠন কাজ করলেও মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মত সাংগঠনিক ও বৈপ্লবিক শক্তি কোনোটিই তাদের নেই। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের নিয়মিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তিন লক্ষাধিক সেনাসদস্য ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের মুখে তাদের মুক্তি বাহিনী বা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা যেমন কঠিন তার চেয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়া আরো কঠিনতর হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষিতে অসহনীয় নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে মানবাধিকারের মমত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
মিয়ানমারে ১৯৬২ সাল থেকে চলেছে সামরিক শাসন। সেখানে নেই কোনো গণতন্ত্র। মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা বৌদ্ধ পুরোহিতদের সমর্থনে চালাতে চেয়েছেন দেশকে। উগ্র বৌদ্ধবাদীদের এরা দিয়েছেন আশকারা। যার ফলে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পেরেছে। এতে মিয়ানমারের হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছেন না। কারণ তাহলে তাদের পড়তে হবে ভারতের আক্রোশে। কিন্তু মুসলমানদের হত্যাসহ বৌদ্ধ ধর্মের জয়গান করে বার্মার সামরিক জান্তা যেন পেতে চাচ্ছে সে দেশের বিরাট জনসমর্থন। মুসলমানেরা সে দেশে হয়ে উঠেছেন বিশেষ ঘৃণাবস্তু। রাজনৈতিক পরিভাষায় ইংরেজিতে যাকে বলে Hate-object এমন ঘৃণাবস্তু সৃষ্টি করে রাজনীতি করার ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মোটেও বিরল নয়। বলা হয়, বৌদ্ধ ধর্মের মূল কথা হলো, অহিংসা পরম ধর্ম। কিন্তু ধর্মের নামে বৌদ্ধরা হয়ে উঠছেন যথেষ্ট হিংস্র। বৌদ্ধ ধর্মের মর্মবাণী বৌদ্ধদের হাতে হতে পারছে অস্বীকৃত।
from প্রবাস – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2g7xRqv
November 28, 2016 at 01:48AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন