মাঈনুল ইসলাম নাসিম, ইতালী থেকে: নাগরিকদের কোন শ্রেণীবিন্যাসের সুযোগ আইনগতভাবে না থাকলেও এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশীরা বাস্তবে অনেক আগে থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন, সেটা আজ নতুন করে বলার নয়। তারপরও তা বলতে হচ্ছে ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ঢাকায় সরকারীভাবে উদযাপিত আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে ব্যবহৃত একটি ‘বানোয়াট ও ভিত্তিহীন’ প্রতিপাদ্য বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। “উন্নয়নের মহাসড়কে অভিবাসীরা সবার আগে” এমন ডাহা মিথ্যাচার করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রবাসীদের ধিক্কার কুড়িয়েছে। উন্নয়নের মহাসড়কে বাস্তবতার নিরিখে প্রবাসী/অভিবাসীরা কেন এবং কীভাবে ‘সবার পেছনে’, তা জানতে চলুন কিছু সত্যের মুখোমুখি হই।
প্রথমেই আসা যাক ‘উন্নয়নের মহাসড়ক’ ইস্যুতে। হাঁ, বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নয়নের মহাসড়কে শুধু নয়, সুপার হাইওয়েতে আছে। দুর্নীতি আর লুটপাট সব সরকারের আমলে কমবেশ হয়েছে, এখনও হচ্ছে, কমিয়ে আনার সুযোগ থাকলেও এতো সহজে বন্ধ হবার নয় নানান কারনে। তারপরও উন্নয়নের সুপার হাইওয়েতে দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, তার মূল কারিগর কিন্তু এক কোটি অভিবাসী বাংলাদেশীরা। তাঁদের কষ্টার্জিত বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্সের ওপর ভর করেই তো আজ পদ্মার ওপর নির্মিত হচ্ছে বিশ্বব্যাংককে দেয়া দাঁতভাঙা জবাবের এক ঐতিহাসিক সেতু। প্রবাসীদের বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স রিজার্ভ না থাকলে বাংলার আকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের দিবাস্বপ্ন দেখার বিকল্প কিছু ছিলো কি ? যদি তাই হবে, তবে তাঁদেরকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে সরকারের কেন এই উদাসীনতা ?
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ঢেলে সাজানো হয়নি আজো। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি এই মন্ত্রণালয়টি যোগ্যতাসম্পন্ন অভিজ্ঞ লোকদের দ্বারা পরিচালিত হয়নি। বৈদেশিক কর্মসংস্থান বলতে এখানকার কর্তাব্যক্তিরা বোঝে মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়াতে জনশক্তি রপ্তানীর নামে প্রভাবশালী দালালদের কাছ থেকে পার্সেন্টেজ বানিজ্যের ভাগ বসিয়ে কোটি টাকা হালাল(!) উপার্জন। শ্রমবাজার খোলার নামে বেহুদা ঘনঘন বিদেশ সফর তাদের যেন একপ্রকার আদিনেশা। প্রবাসীদের কল্যাণ কী জিনিস তা তারা বোঝেই না, বোঝার সুযোগও নেই কারন আজ অবধি প্রবাসী কল্যাণের দায়িত্বটি কোন প্রবাসীকে দেয়া হয়নি। আমি যদি সারাটা জীবন দেশের ভেতরে থেকে তেল-সাবানের ব্যবসাই করে গেলাম, তবে প্রবাসী কল্যাণ আমার না বোঝারাই কথা, প্রবাসীদের কল্যাণ কী করে হবে আমাকে দিয়ে ?
এক কোটি প্রবাসীর সিংহভাগ থাকেন মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়াতে। তাঁরা যখন বছরে বা দু’বছরে একবার দেশে ফেরেন, তখন ঢাকার ‘সোনার খনি’ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁদেরকে যেভাবে গরু-ছাগলের ‘ট্রিটমেন্ট’ দেয়া হয়, সেটা দেখার সময় নেই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে ‘স্যার’ মার্কা ইতর কর্মকর্তারা ছোটলোকের মতো যেভাবে দুর্ব্যবহার করেন খেটে খাওয়া অভিবাসী/প্রবাসীদের সাথে, সেটারও কোন দায়দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত নয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। অতি সম্প্রতি মন্ত্রীবাহাদুর তো সাফ সাফ জানিয়েই দিলো বিমানবন্দর বা দূতাবাস কোনটাই তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। অন্যদিকে কূটনীতিকরা যেহেতু প্রবাসীদের সমস্যার গভীরে যাবার প্রয়োজন মনে করেন না বা যোগ্যতা রাখেন না, তাই দেশে দেশে দূতাবাসগুলোকে ঘিরে অভিবাসীদের দুর্ভোগ বাড়ছে বৈ কমছে না।
‘রেমিটেন্সের উৎস’ এনআরবি তথা অনাবাসী বাংলাদেশীরা বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখার ভেতরে কোথাও কোন ‘প্রায়োরিটি‘ পান না। বলা চলে, তাঁদেরকে কোথাও কোন ‘প্রায়োরিটি’ দেয়া হয় না। অথচ পাশের দেশ ভারতে খবর নিয়ে দেখুন, ভারত সরকার তাঁদের দেশের ‘সোনার সন্তান’ অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য রকমারী সব ‘প্রায়োরিটি’ দিয়ে রেখেছে বিভিন্ন সেক্টরে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা আজও বঞ্চিত তাদের জন্মগত অধিকার ভোটাধিকার থেকে। দায় এড়াতে সরকারের লোকজন হামেশাই বলে থাকে, প্রবাসীরা চাইলে দেশে এসে ভোটার হতে বা ভোট দিতে পারবে। কিন্তু অকালকুষ্মান্ডদের এটা মাথায় আসে না যে, শুধু ভোট দেয়ার জন্য লাখ টাকা খরচ করে কতজন বাংলাদেশ ভ্রমন করবে ? দূতাবাসের মাধ্যমে বা অনলাইনে বিশ্বের সব দেশের প্রবাসীরা যার যার দেশে বসে ভোট প্রদান করতে পারলেও প্রবাসী বাংলাদেশীরাই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
প্রবাসীদেরকে ব্যাংক করে দেয়ার কথা বলা হয়ে থাকে প্রায়শই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও। অথচ দুর্ভাগের বিষয়, এই সকল ব্যাংক মূলত আগে থেকেই কোটিপতি কিছু ব্যবসায়ীদের বিজসেন কার্ডে নতুন একটি বাড়তি পরিচয় যোগ করেছে ঠিকই, কিন্তু খেটে খাওয়া লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশীদের কোন কাজে আসেনি বা আসছে না সেগুলো। নামে প্রবাসী হলেও প্রবাসীদের কল্যাণ থেকে যোজন যোজন দূরে তথাকথিত এইসব প্রবাসী ব্যাংক। মহান জাতীয় সংসদেও প্রবাসীদের কথা বলার মতো কোন কোটা রাখা হয়নি আজ অবধি। আজকের ‘অর্থনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা’ অনাবাসী বাংলাদেশীদের সন্তানদের জন্য বাংলাদেশের সকল সেক্টরে কোটাপ্রথা চালুর বিষয়েও চরম উদাসীনতা লক্ষণীয়। দেশের অভ্যন্তরে প্রবাসীদের বিনিয়োগের নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সরকার কোনদিন কোন বাড়তি পদক্ষেপ নেয়নি, যেটা বিভিন্ন দেশ নিয়ে থাকে যার যার দেশের অভিবাসীদের স্বার্থরক্ষায়।
বিদেশেতে সন্তান মারা যায়, পাড়া পরশী না জানিতে আগে জানে মা। প্রবাসে মৃত্যুবরনকারী বাংলাদেশের নাগরিকদের মরদেহ বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দেশে আনার বিষয়ে বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠলেও অত্যন্ত মানবিক এই ইস্যুতেও পলিসিমেকাররা দেখেও না দেখার শুনেও না শোনার ভূমিকায়। প্রবাসীদের অর্থেই গড়ে ওঠা কল্যাণ তহবিলে বিশাল ফান্ড অলস পড়ে আছে ঠিকই, কিন্তু সমস্যা সমাধানে দায়িত্বশীল পর্যায়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশীর প্রতি এতো বঞ্চনা এতো উদাসীনতার যেখানে শেষ নেই, সেখানে উল্টো তাঁদেরকে আরো যন্ত্রণা উপহার দিচ্ছে সরকার দ্বৈত নাগরিকত্ব আইন মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করে। ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশীরা যারপরনাই ক্ষুদ্ধ এই নেক্কারজনক পদক্ষেপে। সবমিলিয়ে অনাবাসী/অভিবাসী বাংলাদেশীদেরকে আজ রাষ্ট্রীয়ভাবেই ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ হিসেবে মূল্যায়ন করছে উন্নয়নের সরকার।
লেখকঃ প্রবাসী সাংবাদিক
( মুক্তমতের লেখায় আমাদের প্রকাশনা নীতির কোন প্রতিফলন ঘটে না, ইহা লেখকের নিজস্ব মতামত )
from প্রবাস – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2i7ZBZF
December 20, 2016 at 01:23AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন