প্রবাসী কবি জুলির জন্মদিন উপলক্ষে আড্ডা ও আলাপচারিতা

হাকিকুল ইসলাম খোকন, নিউইয়র্ক থেকে: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবি জুলি রহমান সাহিত্যচর্চা করছেন তিন যুগের অধিককাল ধরে। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প – সাহিত্যের এসকল উল্লেখযোগ্য শাখাতেই রেখেছেন মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর, পেয়েছেন পাঠকপ্রিয়তা। ২০১৭’র একুশে’র বইমেলায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তার রচনাকৃত পায় তিন’শ গানের বিশেষ সংকলন ‘জুলি গীত’।

চারণ কবি, গল্পকার সুরকার এবং প্রাবন্ধিক জুলি রহমানের জন্মদিন ৩১ ডিসেম্বর শনিবার।

জুলি রহমানের জন্মদিনে অফুরন্ত অগ্রীম প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বোষ্টনবাংলানিউজ ডটকম,কটিয়াদিনিউজ ডটকম, আমেরিকান প্রেসক্লাব অব বাংলাদেশ অরিজিন, শিরি শিশু সাহিত্য কেন্দ্র, গ্লোবাল নিউজ লন্ডন এবং বনলতা-শিল্পী-সাহিত্যক সাংবাদিক গোষ্ঠী নিউইয়র্ক।

সম্প্রতি জুলি রহমান মুখোমুখি আড্ডায় বসেছিলেন সাংবাদিক ও টিভি উপস্থাপক দিমা নেফারতিতি’র সাথে। সেই আলাপচারিতা উদ্ধৃত হলো প্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্যে।
দিমা নেফারতিতি: প্রথমেই জানতে চাইব সদ্য প্রয়াত কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে কবি জুলি রহমানের মূল্যায়ন। কবি শহীদ কাদরীকে আপনি কোন দৃষ্টিতে, কোন ভঙ্গিতে দেখেন, কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

জুলি রহমান: কবি শহীদ কাদরীর কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে, তিনি একজন বিরল প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। কবিতা যদি সর্বোচ্চাঙ্গের আর্ট হয়, তবে আমি মনে করি কবি শহীদ কাদরী সেই আর্টের তুলি এবং ক্যানভাস। কবিতায় ছন্দ এক কল্পনা রঙিন পরিবেশ তৈরী করে। শুধু তাই নয়, কাব্যের গভীরে থাকে বোধের অতলতা। একজন কবির বোধ, সাধারণের বোধের চেয়ে অনেক বেশি ঊর্ধ্বে বিরাজ করে। কবি শহীদ কাদরী সেই উচ্চবোধসম্পন্ন মানব। কবি শহীদ কাদরীর সাহিত্য আসর ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’য় আমি বহুবার গেছি। ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’র শুরুর দিনগুলি থেকেই আমি এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। সেসময় খুব কাছে থেকে কবি শহীদ কাদরীকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেই কাছে থেকে দেখা অভিজ্ঞতায় আমি জেনেছি, একজন কবিকে অবশ্যই রোমান্টিক হতে হয়। কবি শহীদ কাদরী ছিলেন রোমান্টিক কবি। রোমান্টিকতার দ্যোতনায় আচ্ছাদিত ছিল তার কাব্য মানস এবং তার কবিতা। কবি শহীদ কাদরীর বিউটি বোর্ডিং নিয়ে কাব্যালাপ থেকে, তার বিভিন্ন সময়ের স্মৃতিচারণ থেকে, তাকে নিয়ে তার বন্ধু-স্বজনদের আড্ডার স্মৃতিচারণ থেকে কবি শহীদ কাদরীর রোমান্টিক সত্তার স্পষ্টতা প্রতিভাত হয়।
দ্বিতীয়ত কবিকে হতে হয় একজন সাচ্চা মানুষ। কবি শহীদ কাদরীকে খুব কাছে থেকে দেখে, তার সান্নিধ্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে, এটাই উপলব্ধি করেছি বারবার, যে কবি শহীদ কাদরী একজন সাচ্চা মানুষ, সত্যিকার অর্থে একজন নিখাদ মানুষ। সেইসাথে আমি বলব কবি শহীদ কাদরী নি:সন্দেহে একজন বিরল প্রতিভার মানুষ। তুলনামূলকভাবে তার রচনার সংখ্যা নিতান্তই অল্প। হাতে গোনা। কিন্তু সেই অল্পসংখ্যক রচনা দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যে শক্ত আসন করে নিয়েছেন। এই যে জায়গা করে নেওয়ার বিষয়, এক্ষেত্রে বিশ্ব বরেণ্য চিত্রশিল্পী পিকাসোর কথা মনে পড়ছে। পিকাসো যখন রংতুলি দিয়ে ছবি আঁকতেন, নিন্দুকেরা বলতেন – এসব কি হচ্ছে, নেহায়েত আঁকিবুকি, শুধু কাকের ঠ্যাং আর বকের ঠ্যাং। কিন্তু দেখুন কালের পরিক্রমায় পিকাসোর শিল্পকর্ম জগৎজোড়া খ্যাতি পেল। আমি মনে করি, লেখার এবং তাবড় সৃষ্টিকর্মের, শিল্পকর্মের বিস্তার নয় – স্বল্পতা নয় – সংখ্যা নয়, কেবল গুনগত মান শিল্পকে – সৃষ্টিকে – কবিতাকে টিকিয়ে রাখে। সেই গুনগত মানের বিবেচনায় কবি শহীদ কাদরী বিরল ক্ষমতাসম্পন্ন একজন কবি এবং বাংলা ভাষার অন্যতম মহান কবি, শ্রেষ্ঠ কবি।

দিমা নেফারতিতি: আপনি অনেকদিন যাবত প্রবাসে লেখালেখি করছেন। প্রবাসে বসে লেখালেখি করবার সুবিধা এবং অসুবিধা কি কি অনুভব করেছেন ?

জুলি রহমান: দেখুন আমাকে অনেকেই বলে যে প্রবাসী কবি, একথাটিতে আমার খুব আপত্তি। কারণ কবির কোন স্থান, কাল নেই। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, সেখানেই তার লেখার পরিবেশ এবং আবহ তৈরী হয়ে যায়। আমি যখন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলাম তখন মধ্যপ্রাচ্যের সমাজ ব্যবস্থার আনুষঙ্গিকতা নিয়ে আমার লেখা তৈরী হত। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছি, এখানকার আবহ, এখানকার সংস্কৃতি, এখানকার জীবন বাস্তবতা আমার লেখায় প্রতিবিম্বিত হয়। তাই প্রবাস/নিবাস বলে আমার কাছে কিছু নেই। কিন্তু তারপরেও যখন আমরা বইমেলায় যাই তখন দেখি দু’টা সারি, একটাতে প্রবাসী লেখকদের বই আরেকটাতে বাংলাদেশী লেখকদের বই। তখন আমি খুব পীড়িত হই, ভাবি কেন এই বিভেদ? মাঝখানে এই দেয়ালটা কেন থাকবে। তাছাড়া আমি বাংলাদেশে সাহিত্য চর্চা করেছি অনেকদিন। তারপর মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেলাম। সেখান থেকে ফিরে বাংলাদেশে আবার চুটিয়ে সাহিত্য চর্চা করেছি। আল-মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুন্, কাজী জাকির, জুবাইদা গুলশানআরা, রুবি রহমান, কাজী রোজি এদের সাথে সাহিত্য চর্চায় দুর্দান্ত সময় কাটানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সাহিত্য চর্চা করেছি। তখন আমি দেখেছি আমরা যারা প্রবাসে বসে সাহিত্য চর্চা করি, তাদের লেখাত, দেশে বসে যারা সাহিত্য চর্চা করে তাদের চেয়ে ফেলনা নয় – তাহলে এই বিভেদ টেনে দেওয়া কেন?
নানা কারণে আমরা দেশে থাকতে পারিনি। বাস্তবতার খাতিরে প্রবাসী হয়েছি। কিন্তু তাই বলে এই বিভেদ কেন? একবার কবি রবীন্দ্র গোপ আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনারটা প্রবাসে থাকেন, আপনাদের লেখায় কি দেশের সংঘাত, সংকট এসব ফুটে ওঠে?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে আমরা কি প্রবাসে বসে কেবল চাঁদ, ফুল, লতাপাতা নিয়েই লিখি? এরপরপরই দেশের রাজনৈতিক সংঘাত নিয়ে আমার একটি লেখা কবিতা আমি যখন কোন এক সাহিত্যের আসরে পড়েছিলাম, উনি প্রশংসাসূচক মন্তব্যে বলেছিলেন, জুলি আপনার কবিতা যেন কাঁচা লঙ্কা, ভীষণ ঝাঁঝ আছে ভিতরে।’
আসলে প্রবাসী হওয়ার বড় ব্যাথা হলো, যখন আমরা বই বের করতে যাই তখন ভীষণ বঞ্চনা এবং বৈষম্যের শিকার হই। আমি আজ দীর্ঘ ৩৬ বছর যাবৎ সাহিত্য চর্চা করছি। আমি যদি দেশে থাকতাম তাহলে আমার গ্রন্থের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারত বলে আমি মনে করি। আজকে আমার অগণিত পান্ডুলিপি ঘরে পড়ে আছে। আমার উপন্যাস যুদ্ধ ও নারীসহ অজস্র পান্ডুলিপি ঘরে পরে আছে। সমস্যাটা হলো প্রকাশকদেও কাছ থেকে সহযোগিতার অভাব। তারা যখন শোনে প্রবাসী লেখক, তখন তারা হা করে থাকে পয়সার জন্য। আজ যদি আমি দেশে বসে সাহিত্য চর্চা করতাম তাহলে আমার গ্রন্থের সংখ্যা যেমন বেশি থাকত, তেমনি আমি রয়্যালটি পেতাম। আরেকটা জিনিস উল্লেখ করার মত, প্রবাসে মোটামুটি সবাই লেখে, সবাই কবি। কিন্তু লাইনের পর লাইন লিখলেই, কবি হওয়া যায়না। সত্যিকারের কবি স্বত্তার উম্মেষ যার ভিতরে নেই, তিনি হাজার লিখলেও কবি হতে পারবেন না। কালের বিচারে, যোগ্যতার মাপকাঠিতে, গুণগত প্রকাশের মানদন্ডে যার সাহিত্য উত্তীর্ন হবে, তিনি সত্যিকারের কবি, সত্যিকারের গল্পকার। তা তিনি দেশি হন আর প্রবাসী হন। আজ আমরা কিটসের কবিতা পড়ি, শেক্সপিয়ারের কবিতা পড়ি, রবীন্দ্রনাথের, জীবনানন্দের কবিতা পড়ি। কেন পড়ি? সেসব কালের পরিক্রমায় উত্তীর্ন তাই। সুতরাং ভুঁইফোড়, সৌখিন কবিদের ভিড়ে সত্যিকারের কবিরা হারিয়ে যাবে, এটা আমি বিশ্বাস করিনা।

দিমা নেফারতিতি: আপনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার। আবার আপনি একজন গীতিকার। অজস্র গান লিখেছেন আপনি। এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।

জুলি রহমান: সত্যিকার অর্থে গান দিয়েই আমার লেখা শুরু। ৩৬ বছরের লেখালেখির জীবনে আমার গানের সংখ্যা ঠিক কত আমি জানিনা। আমার গান লেখার সবচেয়ে বড় ক্যানভাস প্রকৃতি । আমি গান লিখেছি আমার কৈশোর থেকে। আমার গ্রামের নাম চাপিল। সেই গ্রামের মাঠ, ঘাট, পথ, প্রান্তর, নদী এসবই আমার গান রচনার নেপথ্যে নাটাই ঘুড়িয়েছিল। বর্তমানে দীর্ঘদিনধরে বাস করছি যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে আমি দুটো সময় ঘর থেকে বের হই। যখন পাতা ঝরে, যখন ফুলে কুড়ি আসে। এই দুটো সময় আমার হাজবেন্ডকে বলি আমাকে একটা আনলিমিটেড ট্রাভেল কার্ড দাও। তিনি দেন। তখন আমি ঘরে থাকতে পারিনা। এদেশে পাতা ঝরে অক্টোবর মাসে, আর ফুলে কুড়ি আসে এপ্রিল মাসে। এইদুটো মাস আমি ঘরে থাকতে পারিনা। তখন আপনমনে ঘুরি। আমি যতটা চিনি এই নিউ ইয়র্ক শহরকে, আমার মনে হয় যারা গাড়ি চালান তারাও বোধহয় নিয়ে ইয়র্ককে এতটা চেনেন না। প্রকৃতিকে দেখার জন্য আমি কখনো বাসে চেপে, কখনো পায়ে হেঁটে এশহরে ঘুড়ি। আমার সাথে তখন কেউ থাকেনা। আমি রাখিনা সাথে। তখন আমি কথা বলি নিজের সাথে। আমি গান করি, আমার গানে সুর করি ওই পথে পথেই। যেমন সেদিন ঝরা পাতার উপর যখন হাঁটছিলাম, পাতারা মচমচ করছিলো, মনে হচ্ছিলো যেন আমি পাতার কান্নার শব্দ শুনছি, কিংবা আমি বাঁশির শব্দ শুনছি। মনে হচ্ছিলো যেন ঝরে পড়া পাতারা আমার সাথে কথা বলছে। আমার সেই অনুভব নিয়ে সাথে সাথে আমি গান রচনা করলাম, তারপর ঘরে ফিরে তা লিখে ফেললাম। এই ৩৬ বছরের সাহিত্য চর্চার জীবনে এ পর্যন্ত অজস্র গান লিখেছি কিন্তু সবগুলো সংগ্রহ করা হয়নি। আজ সেজন্য ক্ষানিকটা অনুতাপ হচ্ছে। এই যেমন সেদিন আমার ঘরের কাছে ক্যাসল হিল পেরিয়ে আমি জেরিগাতে হাঁটছিলাম। সেখানে অপার্থিব নিস্তব্ধতার মধ্যে পথজুড়ে ঝরা পাতার স্তুপ দেখে আমার মনে হলো পাতারা কাঁদছে, এরপর লিখলাম – ‘ঝরাপাতা বলে কথা’ গানটি। এভাবে ঝরা পাতা, তুষারপাত, ঝলমলে রোদ্দুর, কিংবা মুষলধারায় বৃষ্টি – অর্থাৎ প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গের সাথে মিলে জন্ম নেয় আমার গান, আমার কবিতা। ওয়েচেস্টারে ওয়াটার এভিনিউতে একবার আমি গেলাম, তখন খুব বরফ পড়ছিলো, তখন জন্ম নিলো একটা কবিতা। সেটা আমার চার’শ কবিতা সম্বলিত ‘জুলি রহমানের কাব্যগ্রš’’তে আছে। সেই কবিতায় একটা লাইন ছিল এমন – ‘পরিব্রাজক পাখিদের কথা।’ এখানে অনেকে এটা পড়ে বললেন, শীতের মধ্যে জুলি এত পাখি পেলেন কোথায়? আসলে এটাত সিম্বলিক ওয়ার্ডে লেখা। সাহিত্যের ভাষায় যাকে রূপক বলা হয়। পরিব্রাজক পাখি বলতে এই কবিতায় আমি নানা দেশের মানুষদেও কথা বুঝিয়েছি। তাই সাহিত্য তখনি সত্যিকারের পূর্ণতা পাবে যখন তা সত্যিকারের সমঝদারের কাছে পৌঁছাবে।

দিমা নেফারতিতি: একটি সাংস্কৃতিক আবহমন্ডিত পরিবারে আপনার জন্ম। কবি জুলি রহমানের বেড়ে ওঠায় সেই পারিবারিক আবহ কতটা ভূমিকা রেখেছে?

জুলি রহমান: আমার মা ছিলেন চিত্রশিল্পে ভীষণ পারদর্শী। বাবা পুঁথিতে। একমাত্র মামা ছিলেন ইত্তেফাকের নিয়মিত কলামিস্ট। ফুপাত ভাই নিজাম উদ্দিন মুখে মুখে গীতিকবিতা রচনা করতেন। অনেক ছোটবেলা থেকে তার সেই সুর আমাকে সারাদিন আবিষ্ট করে রাখত। বড়ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারা সেই সাথে কবি।তার কবিতা চুপে চুপে পড়েছি। আমার মেঝু ভাই বাউল চিত্তের ছিলেন ।বই গান এ সবেই ডুবে থাকতেন উনি।বই কেনাই ছিলো তাঁর নেশা।বাড়িতে মা পারিবাড়িক গ্রন্থাগার।আমার ভাইদের কমর্।হরেক রকম বইয়ে সমৃদ্ধ তার লাইব্রেরি। ছোটবেলা থেকেই ভাই এর বই এর বাগানের আমি ছিলাম নিয়মিত প্রজাপতি। মামাতো ভাই মাসুদ আহমেদ সতীনাথকে চিরতরে কণ্ঠে ধারণ করে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রথিতযশা গল্পকার। আমার মা মরহুম ফাতেমা খাতুন ছিলে একজন নিভৃত মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি রেঁধে খাওয়াতেন। তারপর রাতের আধাঁরে মুক্তিযোদ্ধারা চলে গেলে তাদের অস্ত্র হাতের ছবি এঁেক রাখতেন তার নিজের হাতের বানানো মাটির কলসের গায়ে। মা’র ছিল মাটির পটারি বানাবার ঝোঁক। আমাদের গ্রামে বিয়ে শাদীসহ যেকোন পরব – অনুষ্ঠানে আমার মা নানারকম পটারি বানিয়ে সেসবের গায়ে ছবি একেঁ দিতেন। আমার স্বামী ফজলুর রহমান নন্দী এমন একজনা মানুষ, বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাকে নীরবে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন। আমি ছোটবেলা থেকেই ভীষণ পড়তাম। বিয়ের পর যখন শশুরবাড়িতে গেলাম সেখানে রানু নামে আমার এক ভাগ্নি আমাকে শেক্সপিয়ারের বই এনে দিত, বাংলা সাহিত্যের এবং বিশ্ব সাহিত্যের নানান বই এনে দিত। বিয়ের পর পর আমার শাশুড়ি খুব অবাক হয়েছিলেন যে, নতুন বৌ ঘরের দরজায় খিল এটেঁ কবিতা লেখে। তারপর উনি আমাকে অনেক বোঝাতেন, বলতেন, “দেখো তোমাকেত আমি এনেছি আমার ছেলের সংসার দেখবার জন্য। সংসারটা ঠিকমত সামলাও। কবিতা লিখে সময় নষ্ট করে কি হবে। কবিতা লিখেত আর পয়সা পাবেনা ।সেসময় আমি কবিতা লিখেছিলাম, ‘বৌ কেন কবি’ শিরোনামে। তারপর অনেক চেষ্টায় আমি ওনাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি সব কর্তব্য ঠিকঠাক পালন করেই আমি কবিতা লিখছি। তাই ওনার চিন্তিত হবার কারণ নেই। একসময় উনি নতি স্বীকার করলেন আমার কবিতারূপী প্রেমিকের কাছে। এরপর নিজেই আত্মীয়-পরিজনদের বলতেন, “আমার বৌমা একজন কবি।”

দিমা নেফারতিতি: আপনার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত? নতুন বই কবে প্রকাশিত হবে?

জুলি রহমান: আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে, উপন্যাস রক্তচোষা। এরপর ব্যবধান, বহে রক্তধারা, কাগজের বৌ, ফাতেমার জীবন, শেষের পান্ডুলিপি, ধান পাতা বাঁশি, একজন দলিলুর রহমান, ভূ -গোলক সহ বহু পান্ডুলিপি গ।ন ,প্রবন্ধ নিবন্ধ ,গীতি কাব্য সহ কিছু পুঁথি।এ গুলো সব প্রকাশিতব্য।র্রক্তচোষা করার বিশ বছর আবার করি কাব্য ময়ূরী সময়।বই বের না করলেও অনেক সাহিত্য পত্রের সম্পাদনা ও নিয়মিত লেখালেখি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছেলেখা প্রতিনিয়ত। জলপ্রপাত ,অনিবাস রৌদ্দুর রাইটাসর্ ,সত্যের আলো পত্রিকায় জুলি রহমানের পাতা। সে সব এখন পীড়া দেয়।
মাঝের এই লেখালেখির সময়টা ছিলো আমার জীবনের চরম দুবর্োদ্ধ সময়।পড়াশোনা বিয়ে চাকুরী লেখালেখি ভীষণ একটা কঠিন সময়ের চড়াই উৎরাই আমার জীবনের।তারপর ও যে লেখাটাকে নিয়মিত পাশে রাখতে পারার আনন্দ ও অনেক নিরানন্দকে মাটি চাপা দেয়।
১২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। আরো অসংখ্য পান্ডুলিপি রয়েছে প্রকাশের অপেক্ষায়। আসছে একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে প্রায় ৩০০ গান এর বিশেষ সংকলন ‘জুলি-গীত।’

দিমা নেফারতিতি: কবি জুলি রহমানের কাছে কবিতার সংজ্ঞা কি?

জুলি রহমান: আমি যখন জীবনের রুঢ়তায় বিধস্ত হই, কবিতা তখন রসের ফল্গুধারার মতই সকল শোকসন্তাপকে ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করে দেয়। কবিতা যেমন দুর্বোধ্য আড়াল। জীবনের বাকঁ তেমনি কঠিন মোড়কে আবৃত। আবার জীবন সুখ ও শান্তিময়। নিরন্তর ভাবনার বিস্তার কবিতার শরীর। সৃষ্টির নোদনায় নান্দনিক কবিতার অবয়ব।

দিমা নেফারতিতি: সবশেষে জানতে চাইব, এই দূর পরবাসে নেই বাংলার মাটি, বাংলার জল। কবি জুলি রহমান দেশকে কোথায় কিভাবে ধারণ করেন?

জুলি রহমান: স্থান কালের সীমারেখায় কবি আবদ্ধ নন। আমি যখন হাডসন নদীর তীর ধরে হাঁটি, তখন হাডসন নয়, আমি অবলোকন করি আমার গ্রামের, আমার শৈশবের চাপিল নদীকে। সেই চাপিল নদীর স্রোতের কলতান নিরন্তর বেজে চলে আমার চেতনার গহবরে। বাংলার মাটি, বাংলার জল আন্দোলিত হয় আমার হৃৎপিন্ডের স্পন্দনে। আমার চোখের তারায় অনুরণিত হয় বাংলার আকাশের নীল আর সবুজ প্রান্তরের সবুজাভ দ্যোতনা। নিভৃতে বাংলার মাটি, বাংলার জল আমাকে প্রতিনিয়ত প্রাণিত করে অবিরাম শব্দের ফুল ফোঁটাতে।



from প্রবাস – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2iryB8x

December 29, 2016 at 02:48AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top