হাবিবুর রহমান চৌধুরী ● শীতের অবকাশে ভ্রমণ করতে পারেন প্রত্নতত্ত্বের শহর কুমিল্লা। কুমিল্লা শহরকে ‘পর্যটনের শহর’ বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। কিংবা একে পুরাকীর্তি বা প্রত্নতত্ত্বের শহরও বলা যেতে পারে। হাজার বছরের পুরাতন এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থাপনা, পুরাকীর্তি কিংবা স্মৃতিচিহ্নের দেখা পেতে হলে যেতে হবে কুমিল্লায়।
কবি নজরুল, রবি ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী ও সঙ্গীত সাধক বাবু শচীন দেব বর্মনের স্মৃতি বিজড়িত দেশের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী প্রাচীন ও ঐতিহ্যমন্ডিত জেলা কুমিল্লা। কুমিল্লায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে লালমাই পাহাড়। এটি উত্তর-দক্ষিণে ১১ মাইল লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২ মাইল চওড়া। লাল মাটির এ পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা ৫০ ফুট। এই পাহাড় এলাকা এবং এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক প্রাচীন নিদর্শন।
লালমাই পাহাড়ের পাশে রয়েছে শালবন বিহার। পূর্বে এই প্রত্নস্থানটি শালবন রাজার বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু খননের পর ১১৫টি ভিক্ষুকক্ষ বিশিষ্ট ৫৫০ বর্গফুট পরিমাপের একটি বৌদ্ধ বিহারের ভূমি নকশা উন্মোচিত হয়েছে। তাই এটাকে শালবন বিহার হিসেবে নামকরণ করা হয়। বিহারটিতে ৪টি ও কেন্দ্রীয় মন্দিরে ৬টি নির্মাণ যুগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই বিহার খননে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ প্রত্নবস্তু ময়নামতি জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
কুমিল্লা মহানগর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতি (কোটবাড়ি) অবস্থিত। এখানে অষ্টম শতকের পুরাকীর্তি রয়েছে। ১৯৫৫ সালে এখানে খনন কাজ শুরু হয়ে এখনো চলছে খনন, পাওয়া যাচ্ছে অনেক প্রাচীন নিদর্শন। এখানকার বিভিন্ন স্পটের মধ্যে শালবন বিহার ও বৌদ্ধ বিহার অন্যতম।
শালবন বিহার দেখার পর ৩ মাইল উত্তরে রয়েছে কুটিলামুড়া। এখানে তিনটি বৌদ্ধ স্তুপ আছে। এর ভিত্তি বেদিগুলো চার কোণাকার। কুটিলা মুড়া দেখার পর এটি থেকে প্রায় দেড় মাইল উত্তর-পশ্চিমে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত চারপত্র মুড়া। প্রায় ৩৫ ফুট উঁচু একটি ছোট ও সমতল পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান। যা পূর্ব-পশ্চিমে ১০৫ ফুট লম্বা ও উত্তরে-দক্ষিণে ৫৫ ফুট চওড়া ছিল। এছাড়াও রয়েছে রূপবান মুড়া ও কুটিলা মুড়া। এখানে রয়েছে ময়নামতি যাদুঘর। জাদুঘরের পাশে বন বিভাগ নতুন ২টি পিকনিক স্পট করেছে।
১৯৫৯ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) প্রতিষ্ঠিত হয়। বার্ডের ভেতরের নয়নাভিরাম দৃশ্য ছাড়াও রয়েছে নীলাচল পাহাড়। তাছাড়া দুই পাহাড়ের মাঝখানে রয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর বনকুটির। যা পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।
কুমিল্লার লাকসাম, বরুড়া ও সদর থানার ত্রিমুখী মিলনস্থলে লালমাই পাহাড়ের শীর্ষ দেশে চন্ডি মন্দিরদ্বয় অবস্থিত। এলাকাটি চন্ডিমুড়া হিসেবে পরিচিত। ত্রিপুরাধিপতির বংশধর দ্বিতীয়া দেবী প্রতিষ্ঠিত চন্ডি মন্দিরদ্বয় ১৩শ’ বছরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। প্রাচীন তম্রলিপি অনুযায়ী জানা যায়, সমতট রাজ্যটি স্থাপন করার সময় মন্দির দুইটি নির্মিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ওয়ার সিমেট্রি কুমিল্লা-সিলেট সড়কের পাশে ময়নামতি সেনানিবাসের উত্তরে অবস্থিত। সকাল ৭টা-১২টা এবং ১টা-৫টা পর্যন্ত সেখানে পর্যটকরা ভিড় জমায়। এছাড়াও একটি অন্যতম পিকনিক স্পট। এখানে ব্রিটিশ, কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, আফ্রিকান, জাপানি, আমেরিকান এবং ভারতীয় মিলে ৭৩৭ জন সৈন্যের সমাধি রয়েছে।
কুমিল্লা-সিলেট রোডের কুমিল্লা বুড়িচংয়ের সাহেববাজারে রানীর বাংলো অবস্থিত। এখানকার দেয়ালটি উত্তর-দক্ষিণে ৫১০ ফুট লম্বা ও ৪০০ ফুট চওড়া। এখানে স্বর্ণ ও পিতল নির্মিত দ্রব্যাদি পাওয়া গেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা সদর দক্ষিণের লালবাগ নেমে সামনে ২ কিলোমিটার দূরেই রাজেশপুর ফরেস্ট। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী নোম্যান্স ল্যান্ড রয়েছে। সেখানকার সবুজ অরণ্যে পাখির কিচির-মিচির শব্দ শুনতে প্রতিদিন পর্যটকরা ভিড় জমায়। বর্তমানে বন বিভাগ এর অনেক উন্নয়ন করায় পর্যটকরা আকৃষ্ট হচ্ছে।
বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ভাই শাহজাদা সুজার নাম অনুসারে সুজা মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কুমিল্লা মহানগরীর মোগলটুলিতে এর অবস্থান। ১৬৫৭ সালে প্রাচীন স্থাপত্যের আদলে এ মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
মহানগরীর বাদুরতলার পাশে ধর্মসাগর অবস্থিত। প্রায় সাড়ে ৫শ’ বছর আগে রাজা ধর্মমানিক্য এটি খনন করেন। এর আয়তন ২৩.১৮ একর। চারদিকে বৃক্ষশোভিত একটি মনোরম স্থান। এর পশ্চিম ও উত্তর পাড় সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। এর উত্তর পাড়ে সিটি শিশু পার্কটি শিশুদের জন্য নতুন করে সাজানো হয়েছে।
নগরীর এলজিইিডি রোডে ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিবহুল বাড়ি, নবাব বাড়িতে শচীন দেব বর্মন, কবি নজরুল এবং অভয়াশ্রমে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজরিড় স্থান পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। কবি নজরুল-নার্গিসের বাসর শয্যা থেকে শুরু করে অনেক স্মৃতি বিজড়িত স্থান দেখতে পর্যকটরা আগমন করছে কবি তীর্থ জেলার মুরাদনগরের দৌলতপুরে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে যেকোনো বাসে কুমিল্লা যাওয়া যায়। ননএসি বাস ভাড়া ১৫০-২০০ টাকা এবং এসি বাস ২৫০-৩০০ টাকা। কুমিল্লা শহরে পৌঁছতে সাধারণত সময় লাগে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। বাস গুলোর মধ্যে রয়েছে এশিয়া লাইন, তিশা, রয়েল কোচ, বিআরটিসি। শহর থেকে বিভিন্ন জায়গা ঘোরার জন্য রয়েছে অটো রিকশা ,সিএনজি এবং রিকশা।
কোথায় থাকবেন
কুমিল্লায় পর্যটকদের জন্য থাকার সুব্যবস্থা হিসেবে কুমিল্লা বার্ড, জেলা পরিষদ রেস্ট হাউজ ও ডাক বাংলো, নজরুল ইনস্টিটিউট, হোটেল রেড-রফ-ইন, হোটেল নূরজাহান, ময়নামতি, কিউ প্যালেস, রানীর কুটির, আশিক ও সোনালী নামের আবাসিক হোটেল রয়েছে।
কোথায় খাবেন
সেই সঙ্গে নগরী ও মহাসড়কের পাশে খাবারেরও ভালো আয়োজন রয়েছে এ কুমিল্লায়। হোটেল মিয়ামী, মায়ামী, কাকলী, জিহান, হাইওয়ে ইন, ডায়না, ডলি রিসোর্ট, বাঙলা রেস্তোরাঁ, কাস্মীরী বিরিয়ানী হাউজ, কস্তুরী ,আলিফ চায়না গার্ডেন, কিং ফিশার, কফি হাউজসহ রয়েছে অসংখ্য ভালমানের খাবার হোটেল।
কুমিল্লা জেলার গোমতী, ডাকাতিয়া ও কাঁকরী নদীর সৌন্দর্য কম নয়। উপমহাদেশের বিখ্যাত সড়ক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এ শহরের মধ্য দিয়েই অতিক্রম করেছে। সুতরাং প্রাচীন এ জনপদ ভ্রমণে আর দেরি কেন? ঐতিহ্যে-আভিজাত্যে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থাকার কারণে গোমতী বিধৌত কুমিল্লার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, ঐতিহাসিক প্রাচীন নির্দশনসহ বিভিন্ন কারণে সমগ্র দেশ-বিদেশের জ্ঞান পিপাসু পর্যটকদের কাছে কুমিল্লা ক্রমেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
The post শীতের অবকাশে ভ্রমণ করতে পারেন প্রত্নতত্ত্বের শহর কুমিল্লা appeared first on Comillar Barta™.
from Comillar Barta™ http://ift.tt/2hbW3Gi
December 09, 2016 at 10:48PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন