মোঃ আবুল কাশেম,বিশ্বনাথ ( সিলেট ) থেকে :: বয়সের ভারে ন্যুব্জ সবাই। ফুরিয়েছে জীবনীশক্তি। শরীরে ধরেছে কাঁপুনি। আর বাসা বেঁধেছে অসংখ্য রোগব্যাধি। কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে তাদের বাস। বছরের পর বছর ধরে সেই প্রকোষ্ঠে থেকে ক্রমেই ধাবিত হচ্ছেন মৃত্যুর দিকে।
মর্মস্পর্শী এই দৃশ্যপট সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে। যেখানে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন পাঁচ বন্দী। তাদের সাথে থাকা আরো দুই বন্দী ধুঁকতে ধুঁকতে হারিয়ে গেছেন রহস্যময় অতলান্তে। হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বাকি পাঁচজনও আছেন সেই পথে। তবে তাদের জন্য আশার আলো ক্ষীণ হয়ে জ্বলছে। ‘বন্দী মুক্তি কমিটি’ তাদের মুক্তির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যাবজ্জীবন দ-াদেশ ভোগ করছেন সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার পৈলানপুর গ্রামের মৃত বাদশা মিয়ার ছেলে লায়েছ (৬৫)। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের ৪৬২৭/এ কয়েদী প্রায় ১৫ বছর ধরে কারাভোগ করছেন। রেয়াতসহ যার কারাভোগের মেয়াদ প্রায় সাড়ে ১৭ বছর। প্যারালাইসিসে শরীরের ডানপাশ অবশ হয়ে আছে অশীতিপর এই বৃদ্ধের। সাথে আছে উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জটিলতা।
হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার পাঞ্জারাই গ্রামের খোরশেদ উল্যার ছেলে আফজাল মিয়া (৫০) প্রায় ১৫ বছর ৩ মাস ধরে কারাগারের চার দেয়ালে বন্দী। রেয়াতসহ ৬৭০০/এ নং কয়েদী আফজালের কারাদ-ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ বছরেরও বেশি সময়। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত এই বৃদ্ধ ধুঁকছেন আরো নানা উপসর্গে।
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার থানার ফানাইল গ্রামের (বর্তমানে ঢাকা জেলার ক্যান্টনমেন্ট থানার দামালকোর্ট) ছবদার আলীর ছেলে তসলিম আলী (৭৬) কারাগারের প্রকোষ্ঠে আছেন প্রায় ১৬ বছর ৮ মাস ধরে। রেয়াতসহ যার কারাদ-ের মেয়াদ হচ্ছে প্রায় ২২ বছর। সিলেট কারাগারের ২১৭/এ নং কয়েদী প্যালাইসিস ও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন।
হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার নোয়াগাঁওয়ের উমেশ পালের ছেলে পরশ পাল ওরফে পরান পাল (৬০)। দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর ধরে কারাজীবন পারছেন তিনি। রেয়াতসহ যারা কারাজীবনের মেয়াদ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৫ বছর। সিলেট কারাগারের ৭২৬/এ নং কয়েদী স্ট্রোক ও অনিয়ন্ত্রিক উচ্চ রক্তচাপে ভোগছেন।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার নালীউরি গ্রামের মুছাব্বির আলীর স্ত্রী আঙ্গরুন্নেছা (৬৬)। প্রায় ৭ বছর ধরে কারাদ-াদেশ ভোগ করা এই বৃদ্ধা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত। সিলেট কারাগারের ৩৯২৫/এ নং কয়েদী আঙ্গুরুন্নেছার রেয়াতসহ কারাদ-াদেশের মেয়াদ প্রায় সাড়ে ৮ বছর।
এই পাঁচ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দিন এখন মৃত্যুর প্রহর গুণে কাটছে। ধুঁকে ধুঁকে চলছে তাদের দিনযাপন। নিজেরা চলাফেরায় অক্ষম এই বন্দীরা অন্য বন্দীদের সাহায্যে কোনোরকমে চলছেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাদের চলাফেরার সহায়তা করতে অন্য বন্দীদের নির্দেশনা দিয়েছে।
জীবনের শেষক্ষণে এসে এই পাঁচ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একটু নিশ্চিন্তে, নিজের আপনালয়ে ফিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান। মুক্তি চান বন্দীজীবন থেকে।
চোখে নোনা জল নিয়ে যেমনটি বলছিলেন আঙ্গুরুন্নেছা, ‘উঠতে-বসতে পারি না, চোখে দেখি না। ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত। আমাকে যদি আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্তি দেওয়া হয়, তবে আরো কিছুদিন হয়তো বেঁচে থাকতে পারবো।’
চোখেমুখে কান্নার স্পষ্ট চাপ নিয়ে তসলিম আলীর কণ্ঠে ঝরে এক পৃথিবী বিষাদ, ‘প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে আমি এখন চলাফেরাও করতে পারি না। শেষ বয়সে একটাই চাওয়া, পরিবারের সামনে যেন মরতে পারি।’
জীবনের শেষমুহুর্তে চলে আসা এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জন্য যেন একটু আশার আলো উঁকি দেই দেই করছে। তাদের মুক্তির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছে ‘বন্দী মুক্তি কমিটি’। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং-স্বঃ মঃ (কারা-২) বিবিধ-০৬/২০০৭/১৭৮/(ক), তাং-৬/৪/২০১০ খ্রি. জারিকৃত পরিপত্রের ৩ অনুচ্ছেদ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং-৪৪.০০.০০০০.০২৪.০১.০০২.১৫-৪৩৫, তাং-২৭/১০/২০১৬ খ্রি. এর নির্দেশনা অনুসারে ওই কমিটি এদের মুক্তির আবেদন জানিয়েছে।
বন্দী মুক্তি কমিটিতে আছেন– সিলেটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জয়নাল আবেদীন (কমিটির আহবায়ক), সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. ছগির মিয়া (সদস্য সচিব), সমাজসেবা কার্যালয় সিলেটের উপপরিচালক নিবাস রঞ্জন দাশ (সদস্য), সিলেটের পাবলিক প্রসিকিউটর মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ (সদস্য), সিলেটের সিভিল সার্জনের পক্ষে ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. আবুল কালাম আজাদ (সদস্য), সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনারের পক্ষে সহকারি কমিশনার মো. ইসমাইল (সদস্য) ও সিলেট জেলা পুলিশ সুপারের পক্ষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুজ্ঞান চাকমা (সদস্য)।
গত বছরের ৮ নভেম্বর এই কমিটি কারাগার পরিদর্শন করে ওই পাঁচ বন্দীর দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে। পরে তাদের মুক্তির বিষয়ে আবেদন জানায় কমিটি।
এ ব্যাপারে কমিটির সদস্য সচিব ও সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. ছগির মিয়া বলেন, ‘এসব বন্দী অপরের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না। স্ট্রোক, প্যারালাইস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে আক্রান্ত।’
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘তাদের সবার বয়স হয়েছে অনেক। চলাফেরাও করতে পারেন না। তারা কারামুক্ত হলে নতুন করে কোনো অপরাধে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
বন্দী মুক্তি কমিটির আহবায়ক ও সিলেট জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমরা সাত বন্দীর মুক্তির জন্য আবেদন করেছিলাম। তবে দুজন ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। বাকি পাঁচজনের ব্যাপারে এখনও কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি।’
কারাগারে রোগে-শোকে ধুঁকতে ধুঁকতে যে দুজন বন্দী মারা গেছেন, তারা হচ্ছেন- মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের আলফু মিয়ার ছেলে মো. লোকমান এবং হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার সুরমা চা বাগান এলাকার মৃত রনিয়া মাংকী মুন্ডার ছেলে রাসু মাংকী মুন্ডা। গত বছরের ২৭ নভেম্বর মারা গেছেন লোকমান; ঠিক পরদিন মারা গেছেন লোকমান।
from সিলেট – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2ke3LRF
January 24, 2017 at 09:20PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.