ফারুক আল শারাহ ● ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার নাঙ্গলকোটের সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ্ব জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুর ১২বছরেও নাঙ্গলকোটে প্রয়াত এ সংসদ সদস্যের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা রয়েছে। নাঙ্গলকোটের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার স্মৃতি স্মরনীয় করে তাঁর নামে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্টেডিয়াম ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণের দাবি জানিয়েছেন নাঙ্গলকোটের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
সূত্র মতে- নাঙ্গলকোটের প্রত্যন্ত অঞ্চল খ্যাত বদরপুর গ্রামের কীর্তিমান পুরুষ জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া ‘‘নাঙ্গলকোটের মাটি ও মানুষের নেতা’’ হিসেবে খেতাব অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন গরীব-দুঃখী, মেহনতি মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী। যেখানেই সমস্যা, সেখানেই ছিলেন জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া। অর্থ প্রাচুর্যে তিনি বিত্তবান না থাকলেও মনের দিক থেকে ছিলেন সবল। সর্বদা নাঙ্গলকোটের উন্নয়নে ব্যাপৃত ছিলেন। আধুনিক নাঙ্গলকোট গড়ার স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করেছেন। নাঙ্গলকোটের মানুষের ভাগ্যন্নোয়নের কথা চিন্তা করে চাকুরি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশ না করে সর্বদা নাঙ্গলকোটের উন্নয়নের কথা ভাবতেন। সচিবালয়ে দপ্তরে দপ্তরে গিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রী ও সচিবদের সাথে ভাব জমিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নের বরাদ্দ অনুমোদন করিয়েছেন।
জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে চৌদ্দগ্রামের ৬টি ও লাকসামের ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে নাঙ্গলকোট উপজেলা (থানা) প্রতিষ্ঠা তাঁর একক অবদান। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ এম রহমানের কক্ষে থানার অনুমোদন কল্পে প্রবেশ কালীন সময়ে মন্ত্রী থানার অনুমোদনের ব্যাপারে ইতঃস্তত করতে থাকলে টেবিল চাপড়িয়ে জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া বলেন- “এই যদি হয় আমি বিরোধী দল করি। এই অজুহাতে আপনি আমার থানা দিবেন না, তবে এক্ষুনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে থানা আদায় করে ছাড়বো। আমি মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়ার সাথে এক সেক্টরে যুদ্ধ করেছি।’ শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ হতেই সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে নাঙ্গলকোট উপজেলা (থানা) অনুমোদন করেন। এভাবেই নাঙ্গলকোটের বিভিন্ন উন্নয়নে জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন।
জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া এম.পি ছিলেন কি ছিলেন না এমনটি না ভেবে নাড়ির টানে প্রায়ই নাঙ্গলকোটে বিচরণ করতেন। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন এলাকার গিয়ে মেহমানের মতো ৩/৪দিন অবস্থান করে বিভিন্ন উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি জনগণের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা শুনতেন। দলমত নির্বিশেষে তিনি সবার সাথে প্রাণ খুলে মিশতেন বলে ‘‘জয়নাল ভাই’’ নামে খ্যাতি অর্জন করেন। অনেকে তাকে ‘‘নাঙ্গলকোটের বঙ্গবন্ধু’’ বলে ডাকতেন। পরিচিত হোক আর অপরিচিত হোক তিনি কাউকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরতেন, হাসিমুখে কথা বলতেন। কখনো একাকী কিছু খেতেন না। যেখানেই থাকতেন সেখানেই নিয়মিত চা চক্র বসতো। দুপুরের খাবার খেতেন এক সাথে ২৫/৩০ জন। ঢাকায় অবস্থানরত নাঙ্গলকোটের কারো সমস্যার কথা শুনলেই সাথে সাথে ছুটে যেতেন। জীবনের প্রতিটি স্তরে উদারতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তিনি মানুষের মন জয় করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে তিনি ‘‘নাঙ্গলকোটের মাটি ও মানুষের নেতা’’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। জননেতা-জনতার নেতা হিসেবে তিনি নাঙ্গলকোটবাসীর হৃদয়ে ছিলেন, এখনো আছেন। মৃত্যুর ১২বছরেও নাঙ্গলকোটে জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা রয়েছে। এখনো এখানকার সকল শ্রেণী পেশার মানুষ জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়াকে শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দেখেন। একজন জনদরদী-দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি নাঙ্গলকোটবাসীর হৃদয়ে চিরঞ্জীব। আর এ জন্যই নাঙ্গলকোটের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর নামে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্টেডিয়াম ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণের দাবি জানান।
২৭ জানুয়ারি ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, মরহুমের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জুমআর নামাজের পর নাঙ্গলকোটের ৪৩০টি মসজিদে মিলাদ ও দোয়া, স্মরণ সভা। কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে নাঙ্গলকোট উপজেলা সদর সহ উপজেলার সর্বত্র জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পোষ্টার লাগানো হয়েছে।
জয়নাল আবেদীন ভঁইয়া ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব-নাঙ্গলকোটের ঢালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল হাছান ভূঁইয়া বাছির বলেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক দুই দুইবারের সফল সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া একজন শান্তিপ্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন। ন্যায়পরায়ন, জনদরদী এ রাজনীতিবিদ জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত নাঙ্গলকোটের উন্নয়নের কথা চিন্তা করতেন। প্রতিহিংসার উর্ধ্বে ছিল তাঁর সুদৃঢ় অবস্থান। সহজে তিনি মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। তাঁর এসব মানবীয় গুণাবলীর কারণেই তিনি নাঙ্গলকোটের মাটি ও মানুষের নেতা হিসেবে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেন।
তিনি আরো বলেন- জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার আলোয় আলোকিত নাঙ্গলকোট। তাঁর স্বপ্ন, তাঁর প্রচেষ্টা ছিল নাঙ্গলকোটবাসীকে ঘিরেই। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পাশাপাশি জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার স্মৃতি রক্ষায় ‘‘জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া ফাউন্ডেশন’’ কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সমাজ ও শিক্ষা উন্নয়নমুলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার বর্ণাঢ্য জীবন:
নাঙ্গলকোটের মাটি ও মানুষের নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সফল সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া ১৯৪৮ সালে নাঙ্গলকোট উপজেলার ঢালুয়া ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আনু মিয়া ভূঁইয়া, মাতার নাম মরহুমা উম্মে কুলসুম। তারা পাঁচ ভাই, চার বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। তিনি ময়ুরা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ফেনী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক (ডিগ্রী) পাশ করেন। তিনি কলেজে অধ্যয়নকালীন ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি একমাত্র কন্যা সন্তানের জনক। তার স্ত্রীর নাম মোহছেনা আবেদীন ফেন্সী। একমাত্র আদরের মেয়ের নাম রওশন আরা আবেদীন স্নিগ্ধা।
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী কাজী জহিরুল কাইয়ুমকে বিজয়ী করতে তিনি হোমনাবাদে গড়ে তুলেন বিশাল জনমত। জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে অসিম সাহসিকতার সাথে হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু গণ-রায়ের জন্য সংসদ নির্বাচন দিলে ওই নির্বাচনে ফের মনোনয়ন লাভ করেন কাজী জহিরুল ইসলাম কাইয়ুম। ওই নির্বাচনে আওয়ামীলীগের অনেক বাঘা বাঘা নেতা দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করলেও জয়নাল আবেদীন ভুঁইয়ার বুদ্ধিমত্ত্বায় শেষ পর্যন্ত নৌকার বিজয় নিশ্চিত হয়। জয়নাল আবেদীন ভুঁইয়া ১৯৭৭ সালে ঢালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিশাল ব্যবধানে বিজয়ী হন। ১৯৭৯ সালে আওয়ামীলীগের দূর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে মনোনয়ন লাভ করেন ‘‘হোমনাবাদের কীর্তি পুরুষ’’ খ্যাত জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া। তখন বয়সে তিনি তরুণ। নৌকার কান্ডারী তিনি। জীবনের প্রথম সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী, ইউ.পি.পি চেয়ারম্যান পরবর্তীতে এরশাদ মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদকে বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে এম.পি নির্বাচিত হন জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া। ওই নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামীলীগের মাত্র ৩৯ জন এম.পি’র মধ্যে জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া ছিলেন অন্যতম একজন। প্রথমবার এম.পি নির্বাচিত হয়ে তিনি চৌদ্দগ্রামের হোমনাবাদ অঞ্চল এবং লাকসাম উপজেলার অবহেলিত পাঁচটি ইউনিয়নের সমন্বয়ে নাঙ্গলকোট উপজেলা (থানা) গঠনের প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করেন। এরই প্রেক্ষিতে একনেকে পাশ করানোর মাধ্যমে নাঙ্গলকোট উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৬ এবং ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু নীলনকশার নির্বাচনে কারচুপির কারণে তিনি সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পেয়ে বিশাল ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া আওয়ামীলীগের মনোনয়ন লাভ করেন। কিন্তু ওই নির্বাচনে দেশী-বিদেশী চক্রান্তসহ একদল কু-চক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরও জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া পরাজিত হয়। প্রয়াত জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া জীবদ্দশায় জনকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। নাঙ্গলকোটের উন্নয়নে তিনি প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন।
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া নাঙ্গলকোটবাসীকে নিঃশব্দে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে যান। তাঁর তিনটি জানাজায় লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশগ্রহণ করে। যা আজো রেকর্ড হিসেবে পরিগণিত। নিজ বাড়ি বদরপুরে বাড়ির পার্শ্বে পুকুর ধারে সবুজ বৃক্ষে ঘেরা শ্যামল মাটিতে অন্তিম শয়ানে শায়িত করা হয় জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়াকে।
The post এখনো আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া appeared first on Comillar Barta™.
from Comillar Barta™ http://ift.tt/2k7iDnX
January 26, 2017 at 07:47PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন