আবদুর রহমান ● বাংলা ভাষার জন্য মূল আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিলো ১৯৫২ সালে। এর আগে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান গণপরিষদ সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ওই সময় সরকারি কাগজে বাংলা ভাষার ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাষা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সেই দাবি তৎকালীন (পাকিস্তান) সরকার মেনে নেননি। বিষয়টি ওই সময়ে আমার মতো হাজারো ছাত্রের কাছে অত্যান্ত কষ্টদায়ক ছিলো। তখন আমাদের মতো ছাত্ররাই বাংলা ভাষার জন্য এই আন্দোলনের উত্থান করেন। এক কথায় বলতে গেলে ভাষা আন্দোলনের মূলভিত্তি বা শক্তি ছিল ছাত্র সমাজ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরাই এ আন্দোলনের কথা চিন্তা ভাবনা করতেন। ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভে কোন রাজনৈতিক দলের তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। কারন রাজনৈতিক দল বলতে তখন ছিল মুসলিম লীগ, আর মুসলিম লীগ ছিল সরকার। তারা চেয়েছিল উর্দুই থাকবে রাষ্ট্রভাষা। তবে তমুদ্দিন মজলিশ নামে একটি সংগঠন বাংলা ভাষার জন্য কিছুটা কাজ করে। তখন আমরাই ভাষা আন্দোলনকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা ব্যবস্থা নিলাম। ধীরে ধীরে ভাষার জন্য আন্দোলন সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন ঢাকা থেকে জেলায়, জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে। আর এ দেশের প্রগতীশীল লোকেরা যখন বুঝতে পারলেন বাংলা ভাষা ছাড়া এই দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব না, তখন তারাও স্বজাগ হয়ে উঠলেন এবং বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যাপক আন্দোলন শুরু করলেন।
বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনের স্মৃতির কথা গুলো গত ২৭ জানুয়ারি সকালে লাকসাম পৌর শহরের অনির্বাণ নামের নিজ বাড়িতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে এভাবেই বলছিলেন ৫২’র ভাষা আন্দোলনের অনত্যম সৈনিক মো.আবদুল জলিল। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের কো-অডিনেটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মো.আবদুল জলিল ১৯৩৬ সালের ১ লা জানুয়ারি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার উত্তরদা ইউনিয়নের চন্দনা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রয়াত আলহাজ্ব মুন্সি বজলুর রহমান এবং মাতা ওয়াহেদা খাতুন। তিনি ১৯৫০ সালের জুনিয়র মাদ্রাসা জালালাবাদ রেঞ্জে হাজী মহসীন পান্ডের স্টাইফেন্ড পরীক্ষায় বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র এবং লাকসাম অতুল হাই স্কুলে ‘দি নিউজ সিট’ হাতে লেখা সাপ্তাহিক সংবাদ সমীক্ষা পত্রের সম্পাদনা করেন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় লাকসাম নওয়ার ফয়জুন্নেছা কলেজে একাদশ শ্রেণির মেধাবি ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলেন তিনি। বর্তমানে লাকসামের প্রাচীণ সংবাদপত্র ‘সাপ্তাহিক লাকসাম’ এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
আবদুল জলিল বলেন, ভাষা আন্দোলনের সময় আমি কলেজে পড়ি। যেহেতু আমি একজন মেধাবী ছাত্র, কাজেই আমার উপর বেশি কাজের ভার পড়লো। আমাকে আন্দোলনের শুরুতে যথেষ্ঠ কাজ করতে হয়েছে। বাংলা ভাষাকে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা প্রথমে অনুবাদবোর্ড করেছি। ইংরেজি লেখাগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করে আমরা মানুষের কাছে বোধগোম্য করে ছড়িয়ে দিয়েছি। তাতে কাজ হয়েছে। কারন ইংরেজি মাধ্যমে লেখাগুলো বুঝতে কষ্ট হতো, আমারা বাংলায় অনুবাদ করার ফলে তা বুঝতে সুবিধে হয়েছে। আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সংকলন প্রকাশ করতাম। ২১’র ঘটনাকে জনগণের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমার হাতে লেখা পোষ্টার ও ব্যাচ তৈরি করেছি। এগুলো একুশের ভোরে বিলি করেছি। এতে ভাষা আন্দোলনে বেশ গতি আসে। ওই সময় মাইক তেমন পাওয়া যেত না। বলা যায় মাইক ছিলো না। আন্দোলন সমাবেশে আমার শ্লেগান ও বক্তব্য দেওয়ার জন্য টিনের চোঙ্গার মাধ্যমে সমাবেশ করেছি।
ভাষা সৈনিক মো.আবদুল জলিল বলেন, ভাষা আন্দোলনের জন্য ঢাকার পরে কুমিল্লা ও লাকসাম ছিল একটি বিশেষ স্থান। যে কারনে ঢাকার পাশাপাশি কুমিল্লা, লাকসাম, নোয়াখালী এবং চট্রগ্রামে এ আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কুমিল্লার অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী, আলী তাহেরসহ নাম মনে না থাকা অনেক ভাই ভাষা আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আর আমি ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহনের প্রেরণা পেয়েছি ও শিখেছি ড.মোহাম্মদ শহিদুল্লার কাছ থেকে। তিনি একজন বিখ্যাত ভাষাবিদ ছিলেন। ভাষা ভিত্তিক এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল । ৫২’এর ভাষা আন্দোলনের ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের শহীদ ভাইদের মৃত্যুর মতো আঘাত যদি না আসতো তাহলে আজকে আমরা হয়তো গর্ববোধ করতে পারতাম না আমাদের মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা নিয়ে। সেদিন সালাম, জব্বার, বরকত, শফিক, রফিক এবং নাম না জানা আরো অনেক ভাই ভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যাদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা বাংলা ভাষার আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিতে পেরেছি। যা পরবর্তীতে ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়েছিল।
৫২’র ভাষা আন্দোলনের অনত্যম এ সৈনিক আরও বলেন, কুমিল্লা অঞ্চলে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য লাকসামের মো.আবদুল আউয়াল, গুণবতীর আবদুল মতিন, নাঙ্গলকোটের হাসানুজ্জামান খান, বরুড়ার আবদুল হাকিম ভূঁইয়াসহ নেতাদের সঙ্গে আমাদের তৎকালীন ছাত্রনেতাদের বেশ কয়েকবার গোপন বৈঠক হয়। তখন প্রকাশ্যে মিছিলে শ্লোগান হতো ‘ নুরুল আমিনের কল্লা চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। কুমিল্লার সিংহ প্রেস ও নাজিরিয়া প্রেসে আমাদের গোপন লিফলেট এবং পোষ্টার ছাপা হতো। একবার লাকসামের গাজিমুড়া মাদ্রসা মাঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সভায় আমরা প্রায় ৫শ’ ছাত্র বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আসি। পরে অবশ্য পুলিশের লাঠি পেটায় টিকতে পারিনি। পিটুনি খেয়ে ওইদিন রাতে লাকসামের জগন্নাথ বাড়িতে রক্তশপথ নিয়েছিলাম। উর্দু এবং ইংরেজী কোনটাই শিখবো না, আমাদেরর মাতৃভাষা বাংলা’ই হবে রাষ্ট্রভাষা। আর অন্য ভাষা শিখবো, তবে সেটা হবে শুধু পরীক্ষায় পাশ করার জন্য। এভাবেই ভাষার জন্য আন্দোলন করেছি।
আবদুল জলিল দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ভাষা সৈনিকদের কোন গেজেট বিজ্ঞপ্তি আজ পযর্ন্ত হয়নি। কেন হয়নি তাও জানি না। আমরা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছি। টাকা-পয়সার জন্য কখনও লালায়িত ছিলাম না, এখনই নাই। কিন্তু তাই বলে আমরা কি কোন মূল্যায়ন পাব না ? আমি মনে করি জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে স্বোচ্চার হতে পারেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটু বিশেষ দৃষ্টি দিলে তাঁর বিশেষ ক্ষমতা বলে জাতীর ও ভাষা সৈনিকদের এই কামনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন। আমাদের সংঙ্গ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই বলবো, কারো উপর দায়িত্ব অর্পণ করে নয়, প্রধানমন্ত্রী আপনি নিজে অন্তত এই কাজটুকু করুন।
এখনও ভাষার জন্য আন্দোলন করছি উল্লেখ করে আবদুল জলিল বলেন, কুমিল্লার প্রকৌশলি কানাডায় বসবাসরত রফিকুল ইসলামের তৎপরতায় আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উদ্যোগ নেওয়ায় ফলে ২১ শে ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে এদেশের অনেক মিডিয়ায় এখনও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার হয়। আদালতে রায় লেখা হয় ইংরেজীতে, চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র লিখেন ইংরেজীতে। আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য লজ্জা। তাই আমি যতদিন বাচঁবো ততদিন সকল ক্ষেত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য আন্দোলন করে যাবো। সব শেষে বলতে চাই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। না, ভুলা যায় না। এটা কখনও ভুলার নয়। একুশের এই প্রেরণায় জাতী এগিয়ে যাবে, এটাই আমার প্রত্যাশা।
সূত্রে জানা গেছে, ভাষা সৈনিক আবদুল জলিলকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ টেলিভিশন রিপোর্টাস এসোসিয়েশন (ট্র্যাব), বাসস, বাংলাদেশ বেতার কুমিল্লা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫০টি ক্রেস্ট ও সম্মাননা এ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছেন। তার লেখা নাটক খুনে লাল বাংলা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বৃহত্তর লাকসাম ও কুমিল্লা সংক্ষিপ্ত অধ্যায়সহ জনপদ কথামালা ১ম ও ২য় খন্ড, বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার সাংবাদিকতার উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস, বৃহত্তর কুমিল্লার পীর মুর্শিদের আস্তানায়, মহিয়সী নারী ফয়জুন্নেছা, আশেকে রাসূল মাসুকে এলাহী আল্লামা হযরত মাওলানা আবদুল বারী জিহাদী, বেদনা যারে দাও, ওগো বঙ্গবন্ধু, সাগর তীরে কেওড়াবনে, পীর মুর্শিদের বাংলাদেশ, রিক্সাওয়ালা নামক বইয়ের লেখক। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে এ ভাষা সৈনিক সিলেটের যুগভেরী, ইষ্টার্ণ হেরাল্ড, আওয়াজ, কুমিল্লার সাপ্তাহিক আমোদ, দৈনিক রুপসী বাংলা, ফলক, পূর্বাশা, ঢাকা-চট্টগ্রামের পূর্বদেশ, দৈনিক আজাদী, দৈনিক জনতা এবং লাকসামের দিলদার ও নোয়াখালীর জাতীয় নিশানসহ অনেক পত্রিকার সঙ্গে লেখালেখি এবং শিশু সংগঠন কচিকাচাঁর মেলা, খেলাঘর ও সুজন মজলিশের আঞ্চলিক সংগঠক ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তার প্রতিষ্ঠিত লাকসাম লেখক সংঘ’র মাধ্যমে একটি লেখক সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক গোষ্ঠি তৈরির স্বপ্ন সফল হয়েছে দেখে তিনি আজ তৃপ্ত। আবদুল জলিল ১৯৬৫ সালে শূন্য পূঁজিতে লাকসামের উত্তরদা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করেন। তিনি পিআইবি প্রকাশিত মাসিক নিরীক্ষাতে ফিচার লিখতেন। সাংবাদিক অভিধানে তার ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ছাপা হয়েছে। তিনি একজন সফল নাট্যকার, কবি ও উপন্যাসিক। মানুষের কল্যাণে তিনি দিশারী সংস্থা নামক একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে চা বাগানে খেটে খাওয়া মানুষ কুলিকামিনিদের জীবনের উপর কুলি মেয়ে নামক নাটক লিখেছেন। আবদুল জলিলের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান চন্দনা প্রকাশনী, নুরজাহান স্মৃতি পাঠাগার, ভাষাসৈনিক মো.জলিল-নুরজাহান ফাউন্ডেশন। তার গ্রামীনমুখী চিন্তা চেতনার কারনে শহরের কৃত্রিমতাকে অপছন্দ করে সহজ সরল জীবন অতিবাহিত করেছেন। তার সহধর্মীনি বেগম নুরজাহানের স্মৃতিকাতর মনের কামনার ফসল কিছু প্রকাশমান লেখয় তিনি বর্তমানে কর্মব্যস্ত হয়ে আছেন।
বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য মো: আবদুল জলিল একটি মতবাদের উপর গবেষণারত আছেন। তার মতে সোনার বাংলা গড়তে হলে কৃষিতে ভূর্তকি শিক্ষা, বাণিজ্য বন্ধ, বুর্জুয়া ছাত্রশিক্ষক রাজনীতি সীমিত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য যেকোন জনপ্রিয় সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন।
The post ‘ভাষার জন্য আন্দোলন সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম’ appeared first on Comillar Barta™.
from Comillar Barta™ http://ift.tt/2lcqBcX
February 05, 2017 at 11:28PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন