মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপটে দ্রুত পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্প্রতিক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে সেখানে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে দেখা যাচ্ছে। আগেকার সময়ে এমনকি গোটা ওসমানী সাম্রাজ্যের ইতিহাসেও এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা যায়নি। এখন দ্রুত জোট গঠিত হচ্ছে, আবার সাথে সাথে পাল্টা অপর জোটও গঠিত হচ্ছে। এভাবে দৃশ্যপটে নতুন নতুন পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে।
কিন্তু এমনকি অধিকতর লক্ষণীয় বিষয় হলো এ ক্ষেত্রে একটি বড় বা প্রধান দেশ এবং জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি বিশিষ্ট তথা খ্যাতনামা রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। আর কেবল এক মাসের মধ্যে ফিলিস্তিন ও ইসরাইল তাদের অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন করে এখন সঙ্ঘাতের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
আমরা ১৯৫৫ সালের ‘বাগদাদ চুক্তি’ অথবা মিডল ইস্ট ট্রিটি অর্গানাইজেশন (মেটো) যেটা সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সেন্টো) নামেও পরিচিত, সেই চুক্তিগুলোকে স্মরণ করতে পারি। কিন্তু কয়েকটি দেশ জোট গঠন না করেও মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসেরের নেতৃত্বে দ্রুত আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং দ্রুত ওই অঞ্চলে সম্প্রসারণশীল সোভিয়েত ইউনিয়নের মোকাবেলা করার জন্য নিজেদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলেছিল। ওই সময়ে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে আসা ওই দেশগুলো হলো : ইরান, তুরস্ক, ইরাক, পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেন।
যাই হোক না কেন, ১৯৫৮ সালে ‘বাগদাদ প্যাক্ট’ দ্রুত অকার্যকর হয়ে পড়ে। জুলাই মাসে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরাকি রাজতন্ত্রকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং জেনারেল আবদুল করিম কাসেমের নতুন সোভিয়েতপন্থী সরকার ওই ‘প্যাক্ট’ বা চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় এবং মস্কোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সংস্থাটি তারপর সেন্টোর পক্ষে বাগদাদ প্যাক্টের লেবেল পরিত্যাগ করে। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব এবং ওই অঞ্চলে আরেকটি রাজতন্ত্রের পতনের ফলে এই সংগঠনের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বাস্তবে, ১৯৭৪ সালে সেন্টোর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তুরস্ক ওই সময়ে ব্যাপক তুর্কি জনসংখ্যা অধ্যুষিত উত্তর সাইপ্রাস দখল করে নেয়ার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। সাইপ্রাসকে করাত্ত করার লক্ষ্যে গ্রিক সমর্থিত একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর মাধ্যমে হেলেনিক রিপাবলিক অব সাইপ্রাস প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তুরস্ক উত্তর সাইপ্রাস দখল করে নেয়।
এখন বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে হঠাৎ করে সিরিয়া নিয়ে একটি জোট গঠিত হয়েছে। আকস্মিকভাবে এই প্রথম তুরস্ক ও ইরান উভয়কে রাশিয়ার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে। এই জোটকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা হলে বলতে হবে, প্রত্যয় বা দৃঢ় বিশ্বাসবিহীন বিয়ে বা চুক্তি। কারণ জোটের তিনটি দেশের প্রত্যেকেরই সিরীয় ট্র্যাজেডিতে প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে নিজম্ব লক্ষ্য উদ্দেশ্য রয়েছে। বাগদাদ প্যাক্ট বা ‘বাগদাদ চুক্তি’ যদি তিন বছর টিকে থাকে, বর্তমান সমঝোতা বা চুক্তি তত দিনও স্থায়ী হবে না। যদিও তিনটি দেশ সিরিয়া নিয়ে তাদের উচ্চাভিলাষের ক্ষেত্রে একটি যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে- তবুও প্রত্যেক দেশেরই অন্য দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রথমত, রাশিয়া সম্পর্কে বলা যায়, সিরিয়া রাশিয়ার সৈন্যদের জন্য একটি উন্মুক্ত প্লেগ্রাউন্ড বা খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। বিশেষত, বিশ্বের একক পরাশক্তির ওই অঞ্চলে অনুপস্থিতির পুরো সুযোগটি রাশিয়া লুফে নিয়েছে। এ ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতায় অধিকার বলে না হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীন ও মুক্তভাবে চলাচলের জন্য অনুমতি দানের কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে রাশিয়া।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ভূমধ্যসাগরের উষ্ণ পানিতে টারটোসের নৌঘাঁটি এবং সিরিয়ার লতাকিয়ার বাইরে মাইমিমের বিমানঘাঁটি অর্থাৎ উভয় ঘাঁটিতে তার দেশের উপস্থিতি পুনরায় নিশ্চিত করে দীর্ঘ দিনের উচ্চাভিলাষকে দৃঢ়প্রত্যয়ের সাথে সম্পন্ন করেছেন। তা সত্ত্বেও সর্বশেষ এক সপ্তাহ আগে রাশিয়া ১৯৭৭ সালে সোভিয়েত আমলে প্রথম স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি আবার ৪৯ বছরের জন্য নবায়ন করে। এটা ২৫ বছর এক্সটেনশনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়নযোগ্য। অর্থাৎ একপক্ষ অপরপক্ষকে এক বছর আগে যেকোনো পরিবর্তনের ব্যাপারে কিছু না জানালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটা আগে ২৫ বছরের জন্য নবায়ন হয়ে যাবে। নতুন চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়াকে টারটোসকে পরিপূর্ণভাবে একটি নৌঘাঁটিতে রূপান্তরের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাশিয়া আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যেকোনো সময়ে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে ১১টি পর্যন্ত রুশ যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে পারবে। এভাবে রাশিয়া অত্যন্ত কার্যকর ও প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়ার ব্যাপারে একটি প্রধান সালিশকারী বা সালিশি হিসেবে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে।
দ্বিতীয়ত, ওই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে এই নজিরবিহীন পরিবর্তনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান নিজেকে বাধ্যতামূলক রাশিয়ার পাশে দেখতে পান। এর প্রকৃত কারণ ও রহস্য কী? সিরিয়ার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে এরদোগানকে পুতিনের হাতে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে তুলে দেয়নি বরং প্রথম এবং সর্বাগ্রে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ হুমকির কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
গত জুলাই মাসে ফতেহ উল্লেহ গুলেনের আন্দোলনের পক্ষ থেকে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর অভ্যন্তরীণ বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং ফলশ্রুতিতে তুরস্কের হাজার হাজার সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতারের কারণে কুর্দিদের ক্রমবর্ধমান উত্থান ঘটে এবং তুরস্ক রাশিয়ার পক্ষপুটে চলে যায়।
এরদোগানের অগ্রাধিকারের বিষয়টি হঠাৎ করে পরিবর্তন হয়ে যায়। তিনি সিরিয়ার কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে তার সিরিয়া যুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন। মনমানসিকতায় এই চিন্তা ও পরিকল্পনাকে ধারণ করে তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে কিছু ঐতিহাসিক সমঝোতা করতে হয়। পুতিনের ভিশনের ব্যাপারে এরদোগানকে তার দীর্ঘ দিনের নীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে সমঝোতার পথে হাঁটতে হয়। সাথে সাথে সিরিয়ায় ইরানের পরিকল্পনা এবং সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের নিজের ভাগ্যের ব্যাপারেও এরদোগানকে সমঝোতায় আসতে হয়।
তৃতীয়ত, ইরানের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয়, এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, পররাষ্ট্রনীতির পেছনে দেশটির ‘রিভ্যুলিউশনারি গার্ডস’রা অত্যন্ত কার্যকর শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের পর তেহরান সেভাবে কৌশলী হয়ে সুনিপুণভাবে নিজেদের দেশকে পরিচালনা করছে, তাতে অবশ্যই পশ্চিমাদের এবং প্রকৃতপক্ষে বিশ্বকে বিস্ময়করভাবে ধাক্কা খেতে হবে। ওই অঞ্চলে নিজেদের নীতিকে সহনীয় করার পরিবর্তে এই চুক্তি তেহরানকে তার নেতৃত্ব দানকারী প্রবণতা বৃদ্ধি করেছে। এতে করে ইরাক, সিরিয়া এবং লেবানন থেকে ইরান ‘হিজবুল্লাহর’ মাধ্যমে উত্তরে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং ইয়েমেন এবং দক্ষিণে আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর পেছনে পর্যন্ত তার সামরিক বাহু বিস্তৃত বা সম্প্রসারিত করেছে। মাঝারি অথবা দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়া এবং তুরস্কের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ার আগে এই ইরানের নীতি টিকে থাকতে পারবে কি না, তা দেখার বিষয়।
সর্বশেষে, আরব-ইসরাইল সঙ্ঘাত এবং সিরিয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের অবস্থান পরিবর্তনের লক্ষণ ফুটে উঠেছে। ২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ২৩৩৪ প্রস্তাবের পেছনে প্রধান উদ্যোক্তা ছিল ব্রিটেন। ওই প্রস্তাব ১৪-০ ভোটে নিরাপত্তা পরিষদে পাস হয়। যুক্তরাষ্ট্র ওই প্রস্তাবে ভেটো প্রদান থেকে নিজেকে বিরত রাখে। ওই প্রস্তাবের মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যার দুই রাষ্ট্র সমাধানের আহ্বান জানিয়ে আগের জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবকে সাধারণভাবে পুনরায় নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ১৬ জানুয়ারি এক বিস্ময়কর তৎপরতার মাধ্যমে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মন্ত্রিপরিষদকে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৩৩৪ প্রস্তাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথা একই ধরনের প্যারিস সামিট স্টেটমেন্ট গ্রহণ করতে বাধা সৃষ্টি করেছে।
এ ছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে সম্প্রতি ফিলাডেলফিয়ায় মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের উদ্দেশে দেয়া এক বক্তৃতায় ফিলিস্তিনিদের অধিকারসংক্রান্ত বক্তব্য রাখতে সম্পূর্ণরূপে বিরত থেকেছেন। অপর দিকে, তিনি ইসরাইলের শান্তি ও নিরাপত্তা ইস্যুর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সিরিয়া ইস্যুতে মনে হচ্ছে, লন্ডন তার আগের অবস্থান থেকে ফিরে এসেছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন একই দিন এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাজ্য মেনে নিয়েছে যে, বাশার আল আসাদকে সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশটিতে অনুষ্ঠিতব্য পুনর্নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়া উচিত। ‘এটা আমাদের মত যে, বাশার আল আসাদকে অবশ্যই চলে যেতে হবে … কিন্তু এটা কিভাবে সম্পন্ন হবে এবং কোন সময়ে এটা ঘটবে সে ব্যাপারে আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত।’ জনসন হাউজ অব লর্ডসে এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমাকে বাস্তবধর্মী হতে হবে।’ ‘কিভাবে দৃশ্যপট পরিবর্তন হচ্ছে এবং হতে পারে আমাদের নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে- এই পরিস্থিতি আমরা কিভাবে মোকাবেলা করব। আমি বলতে ভয় পাচ্ছি পুরনো নীতি যথেষ্ট আস্থা সৃষ্টি করতে পারবে না।
from মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্য – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2k2czck
February 08, 2017 at 05:40PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন