প্রভাষ আমিন ● আমার জন্ম দাউদকান্দিতে। প্রথম স্কুল আমার বাড়ির প্রায় উঠানে, চাঁদগাও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গৌরিপুর সুবল আফতার উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েছি বছর দুয়েক। পরে মামার শিক্ষকতার সুবাদে পরের তিনবছর কেটেছে চৌদ্দগ্রামের মুন্সীরহাটের মেষতলা হাইস্কুলে। এরপর পড়েছি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। কুমিল্লার এ মাথা থেকে ও মাথা জুড়ে আমার দুরন্ত শৈশব, রহস্যে ঘেরা কৈশোর আর উত্তাল যৌবন। কুমিল্লার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে আমার হাজার স্মৃতিতে।
বছর তিনেক কুমিল্লা শহরে ছিলাম। টমছম ব্রিজের নিউ হোস্টেল ছিল আমার আস্তানা। কুমিল্লা শহরে মাত্র তিন বছর থাকলেও সে সময়টা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ব্যয় করেছি যৌবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়, যা এখনও গৌরবান্বিত করে। কুমিল্লার কথা উঠলেই আমার সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানের কথা মনে হয় ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু, পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছু পিছু।’ আসলেই কুমিল্লার সাথে আমার প্রায় ২৮ বছরের বিরহ। তবু যতই পালাতে চাই, কুমিল্লা পিছু নেয়, পালাতে পারি না। আমার সবচেয়ে প্রিয় আমার গ্রাম, দাউদকান্দির শহীদনগরের চাঁদগাও। সবচেয়ে প্রিয় শহর কুমিল্লা। মুন্সীরহাট যাই না ৩১ বছর। গ্রামে বা কুমিল্লাও যাওয়া হয় কালেভদ্রে। কিন্তু তবু কুমিল্লা আমার ভালোবাসা, কুমিল্লা শব্দের ঝঙ্কারেই মিশে আছে দারুণ আবেগ।
কুমিল্লার জন্য ভালোবাসা আছে, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে আঞ্চলিকতায় বিশ্বাস করি না। তাই তো কুমিল্লা সমিতি বা দাউদকান্দি সমিতির মত কোনো সংগঠনের সাথে নিজেকে জড়াইনি। এমনিতে দেখি ঢাকায় চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও নোয়াখালি এলাকার অপরিচিত দুজন মানুষের দেখা হলে দুই তিন মিনিটের মাথায় তারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। যার অনেককিছু বোধগম্য হয় না বাকিদের। অল্প সময়ের মধ্যে অপরিচিতির গণ্ডি ভেঙে তারা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ৯২ সালে বাংলাবাজার পত্রিকায় শহীদুল আজমের সাথে কাজ করার ৩ বছর পর বিয়ের দাওয়াত দিতে গিয়ে জানলাম তার বাড়ি কুমিল্লায়। এখনও অনেকের সাথে কথা বলতে বলতে চমকে যাই, আরে আপনার বাড়ি কুমিল্লায়? আগে বলবেন না।
আমি নিজে যেমন আঞ্চলিকতায় বিশ্বাস করি না, আমি আশা করি আমাদের নীতিনির্ধারকরাও আঞ্চলিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করবেন। এমপিদের না হয় নির্বাচনী এলাকা আছে। কিন্তু সরকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা তো সারাদেশের, সবার। কিন্তু এরশাদ ক্ষমতায় থাকলে যখন রংপুরে উন্নয়ন বেশি হয়, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে যখন বগুড়ার শান-শওকত বাড়ে, সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী হলে যখন বদলে যায় সিলেটের চেহারা, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে যখন সকল উন্নয়ন ভাবনা গোপালগঞ্জকে ঘিরে আবর্তিত হয়; তখন খারাপ লাগে। এমপিরা নিজ নিজ এলাকার উন্নয়ন চাইবেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীরা সারাদেশের চেহারা সামনে নিয়ে বসবেন। কোথায় কী উন্নয়ন লাগবে, সেটা দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। বৈষম্য দূর করাই সরকারের কাজ। কুমিল্লার মানুষ হলেও পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা হলে আমার ভালো লাগে। তেলা মাথায় তেল দিতে আমার কখনোই ভালো লাগে না।
আঞ্চলিকতায় বিশ্বাসী নই বলেই কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়নের দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা আন্দোলনে আমি কখনোই সম্পৃক্ত হইনি। দাবিও জানাইনি। আর বাংলাদেশের বাস্তবতায় আলাদা বিভাগ হলে কী লাভ হয়, সেটাই আমার মাথায় ঢুকে না। আমার জেলা বিভাগে উন্নীত হচ্ছে, এটুকু আত্মসন্তুষ্টি ছাড়া আর কোনো লাভ আমি খুঁজে পাইনি। তবে এটাও ঠিক, কুমিল্লার যে ঐতিহ্য তাতে রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহের আগেই কুমিল্লা বিভাগ হওয়ার দাবিদার। নীতিনির্ধারকদের ধন্যবাদ। দেরিতে হলেও কুমিল্লার বিভাগ বাস্তবায়নের দাবিটি তাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। আর কুমিল্লা বিভাগের ঘোষণাটি দিচ্ছেন, কুমিল্লারই একজন মন্ত্রী, এটা দারুণ আনন্দের উপলক্ষ্য হতে পারতো। কিন্তু পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের ঘোষণাতেই লুকিয়ে ছিল বঞ্চনার, বিক্ষোভের উপাদান। তিনি জানিয়ে দেন, একনেক বৈঠকে কুমিল্লাকে বিভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এর নাম হবে ‘ময়নামতি।’ একনেক বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে দেশে নতুন কোনো বিভাগ করা হলে তা আর সংশ্লিষ্ট জেলার নামে করা হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কোনো জেলাকে বিভাগে রূপান্তর করা হলে ওই এলাকার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা সার্বিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সুন্দর হয় এমন নামকরণ করা হবে।`
এখানেই ক্ষোভের বারুদ জমে আছে। কুমিল্লার ক্ষেত্রেই কেন এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে? কেন ঢাকা বিভাগের নাম জাহাঙ্গীরনগর হবে না, কেন খুলনার নাম সুন্দরবন হবে না, কেন রংপুরের নাম পায়রাবন্দ হবে না, কেন সিলেটের নাম জালালাবাদ হবে না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিয়ে যারা কুমিল্লার নাম ‘ময়নামতি’ করতে চান, তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। আমার ধারণা কুমিল্লা বিভাগের নাম ময়নামতি করার পেছনে ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি যতটা মমতা, তারচেয়ে অনেক বেশি রাজনীতি। কুমিল্লা বিভাগ হলে রাজনৈতিকভাবে কোন নেতা বেশি লাভবান হবেন, নামকরণের ব্যাপারে এইসব প্যাচ বিবেচনা করা হয়েছে। আমার ধারণা এই প্যাচ নোয়াখাইল্যা। নোয়াখালির মানুষ কুমিল্লার সাথে থাকতে চায় না বলেই নাকি নাম বদলে তাদের শান্ত করা হয়েছে। কে থাকবে না থাকবে, সেটা আলাদা বিবেচনা। তবে কুমিল্লা বিভাগের নাম বদলানোর সিদ্ধান্ত যৌক্তিক মনে হয়নি।
আমি জানি কুমিল্লা নাম নিয়ে অনেকের নানারকমের স্পর্শকাতরতা রয়েছে। আমরাই মজা করে বলি, সব কু যেখানে একসাথে মিল্লা থাকে, তাকেই কুমিল্লা বলে। বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মুশতাকের বাড়ি দাউদকান্দি, রশিদের বাড়ি চান্দিনা, ডালিমের ছেলেবেলা কেটেছে কুমিল্লায়, তাহেরউদ্দিন ঠা্কুরের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম ষড়যন্ত্র হয়েছিল বার্ডে। এ সবই কুমিল্লার কলঙ্ক, কুমিল্লার পাপ। রাজাকার শিরোমনি গোলাম আযমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তবে এই কুলাঙ্গারদের বাদ দিলে কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশ শুধু নয়, এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন জনপদের একটি কুমিল্লা। এই জনপদের কোনায় কোনায় লুকিয়ে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। অনেকে বলছেন, নামের শুরুটা যেহেতু ‘কু’ দিয়ে তাই বিভাগের নাম বদলানোই ভালো। কু বদলাতে হলে আরো অনেক জেলার নাম বদলাতে হবে।
কুমিল্লা একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। একসময় অবিভক্ত ভারতের, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ছিল কুমিল্লা। এই কুমিল্লা আমার প্রাণের শহর, আমার ভালোবাসার শহর। আমার যৌবনের উত্তাল সময় কেটেছে এই কুমিল্লায়। কুমিল্লার রাস্তায় হাঁটতে গেলেই আমি শিহরিত হই। এখানে নজরুল হাঁটতেন! এখানে বসে নজরুল কবিতা লিখতেন! এখানে আড্ডা মারতেন! এই বুঝি বাতাসে ভেসে এলো শচীন কর্তার নাঁকি কণ্ঠ ‘তোরা কে যাসরে…’! মহাত্মা গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে কুমিল্লা। বুদ্ধদেব বসুর জন্ম কুমিল্লায়। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ’দের সেতার ঝঙ্কার তুলেছে কুমিল্লার বাতাসে। পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কুমিল্লার সন্তান। গর্বে আমাদের বুক ফুলে যায়।
কুমিল্লার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল নজরুলের অনেক স্মৃতি। আজ তার কিছুই নেই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, অস্তিত্ব নেই নজরুলের শ্বশুরবাড়িরও। শচীন দেব বর্মণদের যে বাড়িতে নজরুল আর শচীন গানের আসর বসাতেন, দীর্ঘদিন সেটি মুরগির খামার হয়েছিল। নজরুল-শচীনের স্মৃতিধন্য বাড়িতে মুরগির খামার, এ যে কত বড় পাপ, তা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে আমাদের। অনেক চিৎকার-চেঁচামেচির পর, শচীন কর্তার বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হলেও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। ভাষা সংগ্রামের অগ্রসেনানী, একাত্তরে যিনি জীবন দিয়েছেন; সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আমরা কুমিল্লার সাইনবোর্ড বানাতে পারতাম; তাকেই কিনা আমরা ভুলে বসে আছি অবলীলায়।
কুমিল্লাকে বলা হতো ব্যাংক আর ট্যাংকের শহর। অনেক দীঘি-পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তবু এখনও ধর্মসাগর, রাণীর দীঘি, নানুয়ার দীঘির মত অনেক জলাশয় টিকে আছে। একসময় অবিভক্ত ভারতের ব্যাংকিং আর সমবায়ের প্রাণকেন্দ্র ছিল কুমিল্লা। গোমতী-মেঘনা-তিতাস-ডাকাতিয়া বিধৌত কুমিল্লা একটি প্রাচীন জনপদ। এ জেলায় লালমাই, ময়নামতি, শালবন বিহার, শাহ সুজা মসজিদ, কোটিলা মুড়া, চণ্ডীমুড়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওয়ার সিমেট্রি, নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে যা আকর্ষণ করে ইতিহাসবিদ ও পর্যটকদের। কুমিল্লার খাদি শিল্প, তাঁত শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎ ও কারু শিল্প, রসমালাই, মিষ্টি, ময়নামতির শীতল পাটি সুনাম দেশজুড়ে। রসমালাই আর খাদির নাম তো বিশ্ব জোড়া।
প্রাচীনকালে কুমিল্লা সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল এবং পরবর্তীতে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হয়েছিল। কুমিল্লা নামকরণের অনেকগুলো প্রচলিত মতের মধ্যে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক ওয়াং চোয়াঙ কর্তৃক সমতট রাজ্য পরিভ্রমণের বৃত্তান্ত থেকে। তার বর্ণনায় কিয়া-মল-ঙ্কিয়া নামের যে স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায় তা থেকেই কমলাঙ্ক বা কুমিল্লার নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
কুমিল্লা বিভাগের নামকরণের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে ময়নামতি নামটি। অনেকে এটির পক্ষে বলছেন। বলতেই পারেন। নামটি আমারও খুব পছন্দের। খুবই রোমান্টিক ও সিনেমাটিক নাম। এখন কুমিল্লার একটি ইউনিয়নমাত্র, তবে ময়নামতিতে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। ময়নামতির প্রতি আমার টান আছে। তবে বিভাগের নাম ময়নামতি করতে হবে, এই সিদ্ধান্তে আমার প্রবল আপত্তি। অকারণে কুমিল্লার মানুষের আবেগে আঘাত করা একটি কুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত।
কুমিল্লা বিভাগ না হলে আমার আপত্তি নেই। তবে যদি হয়ই, আমি চাই কুমিল্লা থাকুক কুমিল্লাতেই।
প্রভাষ আমিন
হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
from Comillar Barta™ http://ift.tt/2lltUl6
February 16, 2017 at 06:41PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন