ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ: কয়েকটি মুসলিম দেশ নীরব কেন?

trampমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী কর্মসূচিও তিনি স্থগিত করেছেন। ফ্রান্স, জার্মানিসহ অনেকে এর সমালোচনা করলেও লক্ষণীয়ভাবে চুপ রয়েছে সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্ব। এ বিষয়ে গত ২৯ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। লিখেছেন নিউইয়র্ক টাইমসের কায়রো ব্যুরোপ্রধান ডেকলান ওয়ালশ। ভাষান্তর: কৌশিক আহমেদ।
ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী কর্মসূচিও তিনি স্থগিত করেছেন। জার্মানি এই আদেশের সমালোচনা করেছে। যুক্তরাজ্য অস্বস্তি প্রকাশ করেছে। ফ্রান্স ও কানাডা এই আদেশের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান কয়েকজন সিনেটরও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তবে মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র কায়রো ও রিয়াদ বিস্ময়করভাবে চুপ রয়েছে।

সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান গত রোববার টেলিফোনে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেন। তবে জনসম্মুখে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করেননি তিনি। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিও এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি। এমনকি ৫৭টি দেশের সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনও (ওআইসি) নীরব রয়েছে।

যে সাতটি দেশের নাগরিকদের ৯০ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন ট্রাম্প সেগুলো হলো ইরান, ইরাক, সোমালিয়া, সুদান, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেন। এর মধ্যে ইরান ও ইরাকের ইসলামি নেতারা গত রোববার ওই আদেশের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

তবে ট্রাম্পের ওই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নেই, এমন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর নীরবতার মধ্য দিয়ে একতার অভাবই প্রতিফলিত হয়। এতে করে ট্রাম্পের নির্দেশনার বিষয়ে স্থায়ী অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।

ট্রাম্প কি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নেবেন? মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন? সিরিয়ার সংঘাতের বিষয়ে তিনি কি রাশিয়ার সঙ্গে একই অবস্থান নেবেন? জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ নাথান জে ব্রাউন বলেন, ‘ওই সবগুলোই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। তবে তিনি শিগগিরই এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা শুরু করবেন কি না তা পরিষ্কার নয়।

মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের অভাব একটি পুরোনো সমস্যা। মুসলিম নেতারা উম্মাহ বা বৈশ্বিক মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য কেবল মুখেই অনেক কথা বলেন। তবে তাঁরা সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত হন। এমনকি তাঁদের নিজেদের লোকেরা যখন অপমানের শিকার হন তখনো। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের ইসাম ফেয়ারস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো রামি জি খুরি বলেন, ‘নিজ দেশেও তাঁদের বৈধতার শক্ত ভিত্তি নেই। সূক্ষ্মভাবে তাঁরা নিজ দেশের জনগণের ক্ষোভ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন।’

সাতটি দেশের নাগরিকদের নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ট্রাম্প তাঁর নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী প্রবেশ স্থগিত করেছেন। এই আদেশের ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাজুড়ে সন্দেহ, উদ্বেগ এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। বিমানবন্দরগুলোতে আসা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য আলাদা হয়ে পড়ছেন পরিবারের সদস্যরা। দীর্ঘ পরিকল্পিত সফর শুরুতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

কায়রো বিমানবন্দরে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ৫১ বছর বয়সী ইরাকি কুর্দ ফুয়াদ শরিফ গত শনিবার নিউইয়র্কগামী বিমানে চড়তে যাচ্ছিলেন। পরে পরিবারসহ তাঁকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়। ফুয়াদ বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আমেরিকায় প্রতিষ্ঠান ও গণতন্ত্র রয়েছে। মনে হচ্ছে এ ধরনের সিদ্ধান্ত এসেছে সাদ্দাম হোসেনের মতো স্বৈরশাসকের কাছ থেকে।’

গত রোববার ট্রাম্প প্রশাসন জানায়, গ্রিন কার্ডধারীদের যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ওই দিন সন্ধ্যায় ট্রাম্প ফেসবুক পোস্টে বলেন, তাঁর নীতি মুসলিমদের নিষিদ্ধ করা নয়। এবং তিনি ভুল প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য গণমাধ্যমকে অভিযুক্ত করেন। এর কয়েক ঘণ্টা আগে টুইটারে ট্রাম্প ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে লড়াইয়ের প্রকৃতিকে নগ্নভাবে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিষ্টানদের ব্যাপক হারে মারা হচ্ছে। আমরা এই ভয়াবহতা অব্যাহত রাখার অনুমোদন দিতে পারি না!’

বস্তুত, আইএসের হাতে মৃত্যুবরণ করা বেশির ভাগ লোকই মুসলিম। তাঁদের অনেককে গুলি করে, পুড়িয়ে এবং শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। আইএসের ঘাঁটি থেকে যেসব মুসলিম ব্যক্তিরা পালাতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরাই শরণার্থী, ট্রাম্প যাঁদের নিষিদ্ধ করেছেন।

জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল মুখপাত্র স্টিফেন সিবার্ত বলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনার সময় ম্যার্কেল ১৯৫১ সালের শরণার্থী সম্মেলনের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। ওই সম্মেলনে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানো ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশই ম্যার্কেলের মতো ট্রাম্পকে এ ধরনের কোনো কথা শোনায়নি। বরং কেউ কেউ ট্রাম্পের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন।
গত বুধবার ট্রাম্পের পক্ষে সাফাই গেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান বলেন, সাতটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের শরণার্থীদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত ট্রাম্পের সিদ্ধান্তটি ইসলামবিরোধী দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া নয়। প্রতিবেশী সৌদি আরবের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র।

ট্রাম্প মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসিকে তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে বর্ণনা করেন এবং সিসিকে ‘দারুণ লোক’ বলে অভিহিত করেন। পাশাপাশি ট্রাম্প সিসির শত্রু মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়টি বিবেচনা করছেন বলে জানান। গত সপ্তাহে ওই দুই নেতার মধ্যে টেলিফোনে আলোচনা হয়। সেখানে সিসির সম্ভাব্য হোয়াইট হাউস সফরের বিষয়ে আলোচনা হয়। অথচ সিসি প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এই ঘনিষ্ঠতা ওবামা প্রশাসনের সময় ছিল অকল্পনীয়।

ট্রাম্প তাঁর ওই আদেশের বিষয়ে বলেন, উগ্রপন্থীদের যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে রাখাই তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি ১/১১ হামলার কথা তিনবার উচ্চারণ করেন। যদিও ১/১১ হামলাকারী ১৯ জনের মধ্যে ১৫ জনই সৌদি আরবের নাগরিক। কিন্তু যেসব দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেই দেশগুলোর তালিকায় সৌদি আরব নেই। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যকার গভীর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ককেই প্রতিফলিত করছে। পাশাপাশি সৌদি আরবের সঙ্গে ট্রাম্পের নিজেরও ব্যক্তিগত আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০১৫ সালে ট্রাম্প অর্গানাইজেশন সৌদি আরবের আটটি কোম্পানিকে নিবন্ধিত করে। জেদ্দা শহরের হোটেলগুলোর উন্নয়নের সঙ্গে ওই কোম্পানিগুলোর সম্পর্ক ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানো নাগরিকদের মধ্যে আরেকটি দেশ হলো পাকিস্তান। এই দেশটিকেও ট্রাম্প তাঁর তালিকার বাইরে রেখেছেন। গত নভেম্বরে নির্বাচনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের উষ্ণ ফোনকল পান ট্রাম্প। পাকিস্তানের প্রতিবেশী আফগানিস্তান থেকে ট্রাম্প সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন কি না সেটি উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ রাখছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের ইসলামাবাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘উদ্বেগের অনেক কারণ রয়েছে। এখন তারা নীরব থাকতে চায় এবং কি ঘটতে যাচ্ছে তা লক্ষ রাখতে চায়।’

২০০০-এর দশকের শুরুতেও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ও ইরাকের ওপর অবরোধ আরোপের মতো ইস্যুগুলোতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বেশির ভাগ দেশগুলোর মধ্যেই ঐকমত্য ছিল। বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ও জাতিগত বিবাদের উত্থানের পর দেশগুলোর একতা নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বকারী বহুজাতিক সংগঠনগুলো দন্তহীন সত্তা বলে বিবেচিত। মিসরের সিসিকে নিয়ে রসিকতা করায় ওআইসির প্রধানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বকারী ওই সংস্থার সদর দপ্তর সৌদি আরবে।

ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার শুরু সময়ে মিসরের কায়রোতে ইসলাম শিক্ষার প্রাচীন প্রতিষ্ঠান আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি পণ্ডিতেরা ‘আমেরিকায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা’র বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তবে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ জারির পর এখনো পর্যন্ত তাঁরা এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি।যেসব দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষিদ্ধ করেছেন ট্রাম্প সেসব দেশের নেতাদের তোষণনীতি তাদের জন্য হতাশাজনক। কাতারের দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের শিক্ষক সামের এস সেহাতা বলেন, তাঁর অনেক ছাত্র এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে কেউ এই বিভ্রমে রয়েছে যে আপনি যদি মুসলিম বা আরবের নাগরিক হন তবে ট্রাম্পের আমলে আপনি ভিন্ন আচরণ পেতে যাচ্ছেন।’

আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের রামি জি খৌরি বলেন, শাসকগোষ্ঠী ও জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হওয়া ক্ষোভের কারণে ২০১১ সালের আরব বসন্তের জন্ম হয়। তিনি বলেন, ‘এমনকি আমেরিকা যখন মুসলিম ও ইসলামের অপমানের পদক্ষেপ নিয়েছে তখনো তারা এ বিষয়ে কিছুই করছে না। এটি আরও ক্ষোভের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। আরব বিশ্বের আরও চাপ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। এটা ভয়াবহ।’



from যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2kx1zb8

February 03, 2017 at 08:04PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top