আজ ১২ ফেব্রুয়ারি মুন্নার প্রয়াণের একযুগ। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের ফুটবলকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। মোনেম মুন্না-এদেশের ফুটবল অঙ্গনের এক অনন্য নক্ষত্রের নাম। যে নক্ষত্রের আলো কমে আসবে না। প্রজন্ম ভুলে যাবে, ফের মনে পড়ে চমকে উঠবে। যে ফুটবলার এক সময় দেশের শীর্ষ সাময়িকীতে প্রচ্ছদ হন আজ তিনি কোথাও খবরে নেই। মনে আছে ১৯৯৪ সাল। আমার মেঝ ভাই মাথায় একটা কাগজের টুপি পড়ে বাসায় আসে। টুপিটায় হালকা নীল রঙের আধিক্য। জিজ্ঞেস করলে বলে এটা আবাহনীর টুপি। এরপরে বলে এই দলে মুন্না খেলে বুঝলি! আমিও বুঝলাম আর কি! আবাহনী নামটা সেই সময় মাথায় বসে যায়। সেই সময় দীর্ঘ কয়েক মাস ঢাকায় থাকার কারণে আবাহনীর সাথে পরিচয়টা আরো সমৃদ্ধ হয়। শুধু জানি মুন্না একজন বিশাল বড় ফুটবলার। তখন, মাত্র দু বছর আগে মুন্না আবাহনীর সাথে ২০ লাখ টাকা দিয়ে চুক্তি করে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে নতুন ভাবে নাম লিখিয়েছেন। দলবদলে হইচই ফেলে দেওয়া মুন্নাকে নিয়ে বিচিত্রার প্রচ্ছদ মোনেম মুন্না শুধু বাংলাদেশ নয়, তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার এক সেরা ফুটবলার। স্টপার পজিশনে খেলেও যিনি সর্বসাধারণের মাঝে তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। মাঠে শুধু চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্য নয়, বরাবরই দলের নেতৃত্ব এবং ফুটবলে দুর্দান্ত পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করে রীতিমতো ফুটবল আইকনে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। আর এ কারণেই কিংব্যাকে উপাধি তার জন্য ছিল অনিবার্য। আশির দশকের শেষ লগ্ন এবং নব্বই দশক জুড়ে যে দেশের ফুটবলাঙ্গন ছিল মুন্নাময় এতে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি যেমন নিজে খেলতেন তেমনি সতীর্থদের খেলাতেনও। কখনও কখনও তারুণ্য নির্ভর আবাহনীকে নেতৃত্ব দিয়ে একাই টেনে নিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ উচ্চতায়। আবাহনীর সাথে মুন্নার ছিল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও তিনি নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন আবাহনীর সাথে। নব্বই-এর গণ অভু্ত্থানের পর দেশের সেরা সব ফুটবলার চড়া দামে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে নাম লেখালেও সে সময় মুন্না একাই আবাহনীতেই ছিলেন। এবং সেবছর মুন্না একাই একদল তরুণ খেলোয়াড়দের সাথে নিয়ে আবাহনীর মর্যাদা সমুন্নত রেখেছিলেন। শুধু আবাহনীই নয়, মুন্না যতদিন মাঠে ছিলেন ততদিন দেশের জন্যেও নিজেকে উজাড় করে খেলেছেন। সবসময়ই নিজের সর্বোচ্চটুকু দেশের জন্য দিতে সচেষ্ট থেকেছেন। ৮০-৮১ সালে পাইনিওর লিগে নাম লেখানোর মধ্যে দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে অভিষেক ঘটেছিল মুন্নার। পরের মৌসুম শান্তিনগরে খেলার পর মুন্না যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদে। পরের বছরই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। মুন্না চলে আসেন লাইমলাইটে। ৮৬ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নে নাম লেখান মুন্না। এ মৌসুমে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সবার নজর কাড়েন। এসময়ই আবাহনী কর্মকর্তাদের নজরে পড়েন তিনি। পরের মৌসুমেই মুন্না যোগ দেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রে। আবাহনীর এই শুরুই ছিল ভালোবাসার প্রথম ধাপ। এ সময় আবাহনীর হয়ে খেলে যারা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন তারা হলেন- আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, গোলাম রাব্বানী হেলাল, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, খোরশেদ বাবুল, গাফফার । তরুণ ফুটবলার মুন্না এসে এই অভিজ্ঞদের মাঝে নিজের জায়গা করে নেন। মুন্নাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। যেখানেই মুন্না পা রেখেছেন সেখানেই সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে। একটানা ৯৭ সাল পর্যন্ত আবাহনীতে খেলেছেন মুন্না। আবাহনীর হয়েই ফুটবলের বর্ণাঢ্য জীবন ছেড়ে অবসরে যান। তবে ফুটবল খেলা ছাড়লেও মুন্না কর্মকর্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আবাহনীর ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কিডনি রোগে তার মৃত্যুর পর আবাহনী মাঠেই তার শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মুন্না ছিলেন সত্যিই বৈচিত্রময় খেলোয়াড় । আবাহনীর হয়ে যেমন দাপটের সাথে খেলেছেন তেমনি কলকাতা ফুটবল লিগেও টানা তিন বছর খেলে সমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ৯১ সালে ইস্ট বেঙ্গলের কোচ নাইমুদ্দিনই প্রথম মুন্নাকে প্রস্তাব দেন কলকাতা লিগে খেলার । কলকাতা লীগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মুন্না লিবেরো পজিশনে খেলে দারুণ আলোড়ন তোলেন। সেখানেও তুমুল জনপ্রিয় একটি নাম হয়ে ওঠে মুন্না। বাংলাদেশে জাতীয় দলের হয়ে মুন্না প্রথম খেলার সুযোগ পান ৮৬ সালে। ওই বছর সিউলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের জন্য নির্বাচিত দলে তিনি প্রথমবারের মতো ডাক পান। একটানা আধিপত্ত্ব বিস্তার করে খেলেন ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ৯৫ সালে তারই নেতৃত্বে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের বাইরে প্রথম বাংলাদেশ কোনও ট্রফি জেতার অনন্য কৃতিত্ব দেখায়। এই টুর্নামেন্টে মুন্নার একক পারফরম্যান্স ছিল আলোচিত ব্যাপার । একথা সত্য যে, মুন্না যতদিন মাঠে ছিলেন সেসময় ঢাকার মাঠে যত বড় স্ট্রাইকারের আবির্ভাবই ঘটুক না কেন মুন্নাকে সমীহ করতেই হয়েছে। মুন্নাকে ভেদ অথবা পরাজিত করে জালে বল প্রবেশ করানোটা কোনও স্ট্রাইকারের কাছেই সহজ কাজ ছিল না। মুন্নার সময়ে বাংলাদেশে যত বিদেশি কোচ এসেছেন সবাই মুন্নার খেলার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মুন্না শুধু খেলাতেই নন, তারকা ফুটবলার হিসেবে লাইফবয়ের একটি বিজ্ঞাপন করে ব্যাপকভাবে আলোচিত হন। বিজ্ঞাপনটি সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। সেই মুন্নার জন্যে আমাদের দেশে দৃশ্যমান তেমন কিছুই করা হয়নি। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে মুন্নার অবদান ভোলার মতো নয়। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মুন্নার অস্তিত্ব নেই। এটা খুবই দুঃখজনক। ধানমন্ডি ৮ নম্বরে মোনেম মুন্না সেতু মুন্নার স্মরণে ধানমন্ডির ৮ নম্বর সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে মোনেম মুন্না সেতু যেটা আমরা অনেকেই জানি না। আর জানবোই বা কিভাবে! অযত্নে অবহেলায় ফলক চোখ এড়িয়ে যায়। মুন্নার মৃত্যুবার্ষিকীতে জন্মশহর নারায়ণগঞ্জে মোনেম মুন্না স্মৃতি সংসদ শোকর্যালি, কবর জিয়ারত, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। নারায়ণগঞ্জ সোনালী অতীত ক্লাব মিলাদ মাহফিলের পাশাপাশি কাঙালি ভোজের আয়োজনও করেছে। এক নজরে মোনেম মুন্না জন্ম : ৯ জুন ১৯৬৮, নারায়ণগঞ্জ মৃত্যু : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, ঢাকা ফুটবল ক্যারিয়ার ১৯৮০-৮১ : পাইওনিয়ার ফুটবল পোস্ট অফিস ১৯৮২ : দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল শান্তিনগর ১৯৮৩ : দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ১৯৮৪-৮৫ : প্রথম বিভাগ ফুটবল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ১৯৮৬ : প্রথম বিভাগ ফুটবল ব্রাদার্স ইউনিয়ন ১৯৮৭-৯৮ : প্রথম বিভাগ ফুটবল আবাহনী ১৯৯১-৯৩ : ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কলকাতা জাতীয় দল : ১৯৮৬-১৯৯৭। এফ/১৬:৪২/১২ ফেব্রুয়ারি



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2l7t8aD
February 12, 2017 at 10:41PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top