আবুধাবি, ০১ মার্চ- বাংলাদেশ স্কুল। স্কুল বলে না কথা! একুশ পালন করা হবে। আপনি আসবেন। শুধু ইলেকট্রন মেইল বা চিঠিই না, ফোনেও কথা বললেন স্কুলের অধ্যক্ষ। জানালেন শহীদ মিনার বসানোর আদ্যোপান্ত। এবারই প্রথম এই আবুধাবিতে। এর আগে এখানে মুক্তাঙ্গনে শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। বিষয়টির জন্য ফোনের ওপারের বন্ধুকে অভিনন্দন জানালাম। একই সময়, অবশ্যই আসব, এই নিশ্চয়তাও দিলাম। ফুলের তোড়া নিয়ে শহীদ মিনারে কয়েকজন একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই দিনে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে এসেছিল বাংলার তরুণেরা। মাগো ওরা বলে, সবার কথা কেড়ে নেবে/ তোমার কোলে শুয়ে, গল্প শুনতে দেবে না/ বলো মা, তাই কি হয়? হয় না বলেই তারা সেদিন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু পাষাণের বুক কাঁপে না। ওরা গুলি করে। একই সময় এদের চিৎকারে আকাশ বাতাস এক হয়ে যায়। রক্ত রঞ্জিত হয় রাজপথ। আ-আ ধ্বনিতে মিশে যায় চরাচর। উত্তরসূরিরা চলে অবিরাম। শহীদের আত্মদানে আরও আরও সুহৃদ শামিল হয় রক্তের মিছিলে। তারা কণ্ঠে ধারণ করে আবেগের সুর। তাতে ধ্বনিত হয় রক্তের সম্পর্কের সঙ্গে জ্বলে ওঠারও দারুণ তাগিদ। শহীদ মিনারের পাদদেশে পুষ্পার্ঘ্য আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। আবুধাবিতে বাংলাদেশ স্কুলের শহীদ মিনার চত্বর টইটম্বুর। শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে ভরে উঠেছে এখানকার পরিবেশ। হাতে ফুলের তোড়া, মনের শহীদের শ্রদ্ধা। আকাশে ছিল মেঘ। পেজা তুলার চাদর ভেঙে বেড়ায় বাতাসে। কিংবা কখনো তা মুখমণ্ডল হয়ে জলের কণায় নামে। তাতে কি? তারা দমে না। এরই মধ্যে এসে যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। তিনি দূতাবাসের পক্ষ থেকে শহীদ বেদিতে ফুল দিলেন। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করলেন অধ্যক্ষ মীর আনসুল হাসান। এ সময় এ প্রহরে ছিলেন দূতাবাস মিনিস্টার ইকবাল আহমেদ খান, রাজনৈতিক কাউন্সেলর শহীদুজ্জামান ফারুকী। ছিলেন স্কুলের শিক্ষক ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দলে দলে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাল স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ভাষার গানের পরিবেশনা স্কুলের অডিটোরিয়াম ছিল ভরাট। এখানকার অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে বাংলাদেশ দূতাবাস। আর এতে তাৎপর্যময় করে তুলেছিল স্কুল। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, স্কুলের শিক্ষার্থীরাই ছিল এর আকর্ষণ। প্রাণের সৌন্দর্যও ছিলা এরা। শিক্ষক ও দূতাবাস কর্মকর্তারা এদের গড়ে তুলেছেন অনুষ্ঠানের কুশীলব হিসেবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারা রচনা লেখে, মনের মাধুরী দিয়ে চিত্রাঙ্কন করে। সবচেয়ে ছোটরা করে আঁকা আঁকি। প্রশস্ত কাগজে তারা রঙের পেনসিল চালায় ইচ্ছেমতো। কী সুন্দর শিল্পীদের মন তাদের। শহীদ মিনার, তারই পাশে সবুজ গাছগাছালি, সেখানে ওড়ে পাখি। কোনোটাই বাদ যায়নি। তারা তাদের ক্যানভাসে তুলে এনেছে স-ব। দর্শক শ্রোতা তারাই সেদিনের সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের মেধা মনন কোনোটার মূল্য থেকে তারা বঞ্চিত হয়নি। রাষ্ট্রদূত শিশুদের কাছে টেনে নিয়েছেন। মঞ্চে দাঁড় করিয়েছেন। সবার সামনে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন। এ সময় চমৎকার একটি পর্ব উপভোগ করেন দর্শক-শ্রোতা। ছোটদের মুখে তারা দেখেন স্বর্গীয় ঝিলিক। পুরস্কার বিতরণের আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন মোহাম্মদ ইমরান। তিনি বলেন, একুশের পথ ধরে আসে এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন। এই আন্দোলন সংগ্রামে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের আছে পাহাড় সমান অবদান। তিনি পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুকে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭০। এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকার আছে এক মহিমা। সে এক জ্বলজ্বলে ইতিহাস। তিনি এ বিষয়টিরও উল্লেখ করে তাঁর বক্তব্যে। স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্কুলের অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, বাংলা ভাষার আছে সেই বিশালত্ব যার বলে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তিনি আশা করেন, পৃথিবীর ছোট ছোট ভাষা তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবে। আর এর মধ্য দিয়ে সমাজ ও সভ্যতা এগিয়ে যাবে। তিনি স্কুলের অন্য ভাষাভাষী শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে তার বক্তব্যের কিছু অংশ ইংরেজিতেও বলেন। নিমতলায় বাংলাদেশ স্কুলের শিক্ষকেরা অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন অধ্যাপক এস এম আবু তাহের। শিক্ষাকে শাণিত করার প্রত্যয় তাঁর। মানস সংস্কৃতি এবং বস্তুগত সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে জীবনবোধ উজ্জীবিত করার তাগিদটি তুলে ধরেন তিনি। রাষ্ট্রদূতও বলেছেন এই কথাটি। তবে তা অন্যভাবে। ছাত্ররা বাংলাদেশের ইতিহাস সংস্কৃতি পড়ার জন্য কিছু সময় ব্যয় করবে। তিনি শিক্ষকদের আহ্বান জানান, যত্ন নিয়ে এ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার। রাষ্ট্রদূত স্থানান্তরযোগ্য শহীদ মিনারটি দৃশ্যমান জায়গায় রাখা এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সাংস্কৃতিক পর্বে আলতাফ মাহমুদের সুরে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কালজয়ী একুশের গানের পর ছিল আর একটি ভাষার গান। মোদের গরম মোদের আশা আ মরি বাংলাভাষা। অতুল প্রসাদ সেন কী আবেদনই না সৃষ্টি করেছেন! এখানেও তার প্রতিফলন। বৃন্দ আবৃত্তি করে জুসান আর তানজিমা। তারা তাদের কণ্ঠে আনে নির্মলেন্দু গুণের অঙ্গীকার আর রোমাঞ্চ জড়ানো কবিতা আমাকে কী মাল্য দেবে দাও। চমৎকার ওদের প্রক্ষেপণ। আবেগ ছিল, ছিল নিবেদন, ছিল স্তোক। আকন্দ ধুন্দুল নয়, রফিক সালাম বরকত আমি/আমরাই আত্মার প্রতিভা সে এই দেখো আগ্নেয়াস্ত্র/কোমরে কার্তুজ, অস্থি ও মজ্জার মধ্যে আবার বিদ্রোহ/ওরা প্রশংসা কুড়ায়, ভালোবাসা পায় শ্রোতাদের। ছিল বৃন্দ নৃত্য। সেও বাংলা মায়ের সঙ্গে সরাসরি যোগ। রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম। দারুণ প্রকাশ তাদের। অনন্য সৌন্দর্যে জ্বলে ওঠে ওরা। প্রাণের আবেগে ছুটে আসা প্রাণের মানুষগুলোর কথা না শুনলেই নয়। নীলা পারভিন। এই স্কুলের ব্যবস্থাপনার শিক্ষক। বললেন, একুশ আমার গর্ব। কী অনুপম করে বললেন। বুকের গভীর থেকে আসা সে উচ্চারণ। কলজে ভরা কথা বললেন বিজ্ঞানের শিক্ষক রুবাইয়া নিশাত। শব্দ সঞ্চয়নে সে কথা স্পষ্ট। আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ, একুশ আমার অস্তিত্ব। ছবি তুলছে মির্জা আশফাক। তারও প্রাণের টান। ক্লিক ক্লিক! এক এক করে মুহূর্তকে ধারণ করার সচল গতি তার। পরিবেশ তার ভাব-গাম্ভীর্য বজায় রেখেছে। বলল, একুশের অনুষ্ঠান সত্যিই আলাদা! মোদের গরব মোদের আশা গেয়ে ভালো লাগা অনুভূতি সামরিন, তাসনিম, মেহেনা, রুহামা, রাফসানা, রামিকার। প্রথমজন একটু এগিয়েই বলল, আরও গান জানি আমি। অভিনন্দন জানালাম। নাচের মেয়ে মাইশা বলল, আজকের নাচে ছিল টানাপোড়েন। সঙ্গে সঙ্গে আবার জানায়, এখন আমি খুশি। সানজিদারও মনের তৃপ্তি অনেক। বলল, ভালো, অনেক ভালো এক অনুভূতি। সে যেন তখনো নাচে। আঞ্জুমান আরা এক তরুণীর মা। তিনি তার ট্যাব ধরিয়ে দিলেন। ছবি তুলে দিতে হবে। তিনি দাঁড়ালেন ছোটদের নিয়ে। এমন ছবি তার আগের অনুষ্ঠানগুলোতেও তুলে দিয়েছি। আজকেও দিলাম। তৃপ্তির ছাপ তার মুখে। এবার আসি শহীদ মিনারের কথায়। স্থানান্তরযোগ্য এ সৃষ্টি। অ্যালুমিনিয়াম আর লোহা উপাদানে তৈরি। রাস আল খাইমা বাংলা স্কুলের সভাপতি পিয়ার মোহাম্মদ। নির্মাণের দায়িত্ব নেন তিনি। কিন্তু এ সম্পর্কে এ দেশের আছে অনেক নিয়ম কানুন। অনুমতির জন্য অধ্যক্ষ ধরনা দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। তারা বলেন সময় শেষ হয়ে গেছে এবার। তিনি ক্ষমা চেয়ে লিখলেন বাংলা ভাষা-আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার কথা। সূত্র উল্লেখ করলেন, দুবাই সরকার এবার ভাষা বর্ষ ঘোষণা করেছে। বরফ গলল। রাষ্ট্রদূত এগিয়ে এলেন। দুধে চিনি সংমিশ্রণ ঘটল। তিনি ঘোষণা দিলেন, শহীদ মিনারের জন্য যাবতীয় খরচ বহন করবে বাংলাদেশ দূতাবাস। সূর্য দেখা যায় না। শেষ আকাশে। শুরুতে যেমন ছিল এখনো তাই। এমনি এক অবস্থাতে দলে দলে মানুষ ত্যাগ করছে স্কুল ক্যাম্পাস। আমরা বসলাম অধ্যক্ষের কার্যালয়ে। এখানে দেশের প্রসঙ্গ ওঠে। সেখানকার গল্প বলে কেউ। অন্যরা শোনে। যোগ করে নিজের অনুভূতি, আপন কথা। এও কি একুশের আয়োজনের অংশ! হয়তো বা তাই। এফ/০৭:৫৫/০১মার্চ
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2mbekZu
March 01, 2017 at 02:00PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন