কুমিল্লার বার্তা রিপোর্ট ● অপরিকল্পিত নগরায়নের শিকার হয়ে ধুঁকছে ঐতিহ্যবাহী শহর কুমিল্লা। সৌন্দর্য হারানোর পাশাপাশি সমস্যা-সংকট দিন দিন বাড়ছেই। নগরীর যত্রতত্র ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে খোদ সিটি কর্পোরেশন থেকে। সিটি কর্পোরেশন হওয়ার পর গত ৫ বছরে নগরী জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য ভবন। ক্ষমতা ছাড়ার আগে চার মাসের ব্যবধানে ২ দফায় ৯৫৮টি নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছেন সদ্য বিদায়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। এ ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অর্থাৎ বিল্ডিং কোড মানা হয়েছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় নগর পরিকল্পনাবিদসহ বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, গত ৫ বছরে কুমিল্লায় নির্মিত হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য ভবন। অনেক ভবন রাস্তার একেবারেই পাশে নির্মাণ করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এসব ভবনে রাখা হয়নি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা। ছোট হয়ে আসছে রাস্তার পরিধি। এতে হুমকির মুখে পড়ছে ড্রেনেজ সমস্যাও- যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলেও মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। তারা এও বলছেন, অপরিকল্পিভাবে এসব ভবন হওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে নগরীর যানজট, জলাবদ্ধতাসহ নানা সমস্যা।
কুমিল্লা জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি শাহ্ মো. আলমগীর খান জানান, গত ৫ বছরে কুমিল্লা নগরীতে যেসব বহুতল ভবন তৈরি করা হয়েছে, সব ভবনই কিন্তু পরিবেশবান্ধব হয়নি। ড্রেন ভরাট করে রাস্তার ওপর ভবন তৈরি করা হয়েছে।
ফলে দিন দিন নগরীর রাস্তাঘাট ও অলিগলি ছোট হয়ে যাচ্ছে। একটি রাস্তা দিয়ে একসঙ্গে দুইটি গাড়ি সহজে যাতায়াত করতে পারছে না। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। বাড়ছে জলাবদ্ধতা। সদ্যবিদায়ী মেয়র রাস্তা ও ড্রেনেজের নির্মিত ভবন ভাঙতে নোটিশ দিয়েছেন। কিন্তু সমন্বয়হীনতার ফলে তিনি এতে সফল হননি। ফলে ক্রমাগত অপরিকল্পিত নগরায়নে সমস্যা আরো জট পাকাচ্ছে।
আলমগীর খান বলেন, কুমিল্লা নগরজুড়ে রয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা। এগুলো সম্পূর্ণ অবৈধভাবে চলাচল করছে, কোনো অনুমোদন বা লাইসেন্স নেই। কার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব চালানো হচ্ছে, সেটাও আমরা কেউ জানি না। আর সাধারণ রিকশা তো আছেই। একেতো রাস্তা ছোট। রাস্তার ওপর যত্রতত্র এসব ছোট ছোট যানবাহন পার্কিং করায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এসব গাড়ি যেখানে সেখানে থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে। কোনো নিয়ম-নীতিই মানা হচ্ছে না। তিনি বলেন, নগরীর পানি নিষ্কাশনেও তেমন উন্নত ব্যবস্থা নেই। বিদায়ী মেয়র ড্রেনেজের জন্য কিছু কাজ করেছেন। তবে তা যথেষ্ট নয়। সবমিলিয়ে বলা যায়, ক্রমাগত কুমিল্লা একটা অপরিকল্পিত নগরীতে পরিণত হচ্ছে। দ্রুত এ থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এ নগরীকে বাঁচানো যাবে না। এছাড়া, নগরাসীর জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। শিশুদের জন্য খেলার মাঠ ও পার্ক আরো তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন সচেতন নাগরিক কমিটির এই নেতা।
একই অভিযোগ করলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কুমিল্লা সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজবাউল হক রানা। তিনি বলেন, শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য ছিল কুমিল্লা পৌরসভার। এটি সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হওয়ায় কুমিল্লার মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল কুমিল্লা উন্নত শহরে পরিণত হবে। রাস্তাঘাট বড় হবে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। কুমিল্লা হবে পরিকল্পিত নগরী। কিন্তু গত ৫ বছরে সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কারণ যত্রতত্র বহুতল ভবন নির্মাণ হওয়ায় রাস্তা ও অলিগলি ছোট হয়ে আসছে। এর প্রভাবে যানজট ও জলাবদ্ধতা বাড়ছে। যেসব ভবন তৈরির অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যথাযথ নিয়ম মেনে সেগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও কুমিল্লায় খুব একটা উন্নয়ন হয়নি বলে উল্লেখ করেন স্থানীয় এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও মুক্ত চিন্তার চর্চা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য নগরীতে ভালো কোনো অডিটোরিয়াম নেই। বিনোদনের জন্যও জায়গার স্বল্পতা রয়েছে। এখানে পার্ক ও খেলার মাঠ নির্মাণ করা প্রয়োজন। আগামীতে যিনিই মেয়র নির্বাচিত হোন না কেন, এসব বিষয়ে বিশেষ নজর দেবেন বলে আশা করেন তিনি।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, কুমিল্লায় যেসব বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, অনুমোদন দেয়ার আগে সে বিষয়ে কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি সিদ্ধান্ত নিতেন। তারপর মেয়র সেগুলোর অনুমোদন দিতেন। ইমারত নির্মাণ আইন যথাযথ অনুসরণ করে সেগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জোনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, সিটি কর্পোরেশনের মাপকাঠি অনুযায়ী কুমিল্লায় তেমন উন্নয়ন হয়নি। যা হয়েছে তা যথসামান্য। বিগত মেয়র ড্রেন পরিষ্কার, রাস্তা পরিষ্কার, সড়কের পাশে বাগান করা, লাইটিং ব্যবস্থার কিছুটা উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু একটি মহানগরীর জন্য তা যথেষ্ট নয়। এছাড়া যা করা দরকার ছিল, তাও কিন্তু করা হয়নি। যেমন স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে কোনো কাজ করা হয়নি। অনেক বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে। কোনো কোড মানা হয়নি। ফলে উচ্ছিষ্টাংশ যাবে কোথায়। এসব বিল্ডিং থেকে যে পানি নিষ্কাশিত হবে তা যাবে কোথায়? তাই সবকিছু মিলিয়ে বলা চলে, মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার তেমন প্রতিফলন হয়নি। আরো শুনেছি, ক্ষমতা ছাড়ার আগে আগে মেয়র বেশকিছু নতুন ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রেও কতটুকু নিয়ম মানা হয়েছে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে এসব ভবন যদি আগের মতো করেই গড়ে তোলা হয়, তাহলে আরো কঠিন সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে নগরবাসীকে। সময় থাকতে এসব বিষয়ে সচেতন না হলে কুমিল্লা নগরী বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়বে।
বিশিষ্টজনরা বলছেন, শহরের অদূরে ডাকাতিয়া নদীটি খনন করা না গেলে কুমিল্লার জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেবে। এছাড়া নগরবাসীর চিত্তবোনেদনের জন্য মহানগরীর আওতাভুক্ত পুরাতন গোমতি নদীটি দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। সেটি এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে নদীটি। গোমতি নদীটি উদ্ধার করে সেখানে ঢাকার হাতিরঝিলের মতো একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলারও দাবি জানান তারা।
from Comillar Barta™ http://ift.tt/2mPMXnW
March 12, 2017 at 11:33PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন