লন্ডন, ২৭ মে- যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি হয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলররা। তাঁরা শুধু কাউন্সিলর হিসেবেই নিজেদের প্রমাণ করেননি, নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্পিকার, মেয়র ও ডেপুটি মেয়র হিসেবেও। যুক্তরাজ্যে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অনেক। কাউন্সিল নামে পরিচিত স্থানীয় সরকার এর আওতাধীন এলাকার বাসিন্দাসের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতাসহ যাবতীয় সেবা প্রদানের কাজটি করে থাকে। আর কাউন্সিল পরিচালনা ও এর নীতিনির্ধারণ করেন নির্বাচিত কাউন্সিলররা। বিলেতের বিভিন্ন প্রান্তের স্থানীয় সরকারে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলরের সংখ্যা বছর বছর এতটাই বাড়ছে যে তা এখন আর আলাদা মনোযোগ আকর্ষণের বিষয় নয়। তবে এই কাউন্সিলরদের কেউ কেউ যে স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পদে আসীন হচ্ছেন, তা সত্যিই চমকপ্রদ। সম্প্রতি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চারজন কাউন্সিলর চারটি কাউন্সিলে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের স্পিকার হয়েছেন সাবিনা আক্তার। বৃহত্তর লন্ডনের আওতাধীন বার্কিং অ্যান্ড ডেগেনহাম কাউন্সিলের অ্যাসেম্বলি প্রধান (চেয়ার অব দ্য অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হয়েছেন সৈয়দ ফিরোজ গণি, স্যান্ডওয়েল মেট্রোপলিটন বারা কাউন্সিলের মেয়রের দায়িত্ব পেয়েছেন আহমেদুল হক এবং সুইন্ডন বারা কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জুনাব আলী। তাঁরা চারজনই লেবারদলীয় কাউন্সিলর। যুক্তরাজ্যে দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়। স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানিত পদে জায়গা করে নেওয়া এসব বাঙালি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে বলে নেওয়া ভালো, যুক্তরাজ্যে মোট ৪১৮টি কাউন্সিল রয়েছে। এসব কাউন্সিলে মোট কাউন্সিলরের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার ৮০০। পরিচালন পদ্ধতিভেদে কাউন্সিলগুলোর শীর্ষ পদের নামও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে নির্বাহী মেয়র-পদ্ধতি। এখানে নির্বাচিত মেয়র এককভাবে ক্ষমতাশালী। এ কাউন্সিলে স্পিকারের পদটি শীর্ষে, তবে অালংকারিক। আবার স্যান্ডওয়েল কাউন্সিলে মেয়রের পদটি শীর্ষে। কিন্তু এখানে কাউন্সিল লিডার সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলরের সম্মতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পদে দায়িত্বশীল স্পিকার বা মেয়র নিজ নিজ এলাকার প্রথম নাগরিক (ফার্স্ট সিটিজেন) হিসেবে সম্মান পান। তাঁরা ব্রিটিশ রানির প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রাখেন। রাজপরিবারের কেউ কোনো কাউন্সিল এলাকায় গেলে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্পিকার বা মেয়রই তাঁকে স্বাগত জানান। শীর্ষ এসব পদে দায়িত্বের মেয়াদ হয় সাধারণত এক বছর। টাওয়ার হ্যামলেটসের স্পিকার সাবিনা আক্তার পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি-অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে মেয়র কিংবা স্পিকার পদে বাঙালিদের দায়িত্ব পালন নতুন কিছু নয়। তবে সাবিনা আক্তার এ কাউন্সিলে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী হিসেবে স্পিকার হলেন। ১৭ মে তিনি কাউন্সিলের সাধারণ সভায় স্পিকার নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালের জুন মাসে স্টেপনি ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলর সাবিনা গত এক বছর ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বেশ সুনাম কুড়ান। সাবিনা আক্তার প্রায় ২০ বছর ধরে লেবার পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। স্পিকার হিসেবে তাঁর মূল কাজ কাউন্সিলের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করা এবং অধিবেশন পরিচালনা করা। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে কাউন্সিলের প্রতিনিধিত্ব করা। সেই সঙ্গে স্পিকার্স ডিনার আয়োজনের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের পছন্দমতো দাতব্য সংস্থার জন্য তহবিল জোগান দেবেন। পূর্ব লন্ডনে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি নারীর আদিবাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। সাবিনা বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখনো অটুট। প্রায় প্রতিবছরই আত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটাতে বাংলাদেশ ঘুরে আসি। সাবিনার সঙ্গে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আরেক কাউন্সিলর আয়াছ মিয়া। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মোট ৪৭ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। ডেপুটি মেয়র জুনাব আলী সুইন্ডনের ডেপুটি মেয়র জুনাব আলী উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের উইটসশায়ারে সুইন্ডন বারা কাউন্সিল। এখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বলা চলে হাতে গোনা। গত ১০ বছরে টানা তিনবার এই কাউন্সিলের সেন্ট্রাল ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন জুনাব আলী। ১৯ মে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় তিনি আগামী এক বছরের জন্য ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। আগামী বছর তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সুইন্ডন কাউন্সিলটি কনজারভেটিভ পার্টির নিয়ন্ত্রণে। লেবার পার্টির কাউন্সিলর জুনাব আলী বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলরের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হওয়ায় ডেপুটি মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছি। জুনাব আলীর জন্ম সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লালাবাজার ইউনিয়নে। ১৯৭৪ সালে মাত্র চার বছর বয়সে তিনি মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাজ্যে যান। প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি লেবার পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত। ২০১৪ সালের জুন থেকে গত মাস পর্যন্ত তিনি স্থানীয় লেবার পার্টির ডেপুটি লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসেবে সুইন্ডন কাউন্সিলে জুনাব আলীই প্রথম শীর্ষ পদে আসীন হলেন। এখানে ৫৭ জন কাউন্সিলরের মধ্যে বাঙালি আছেন দুজন। লন্ডনের বাইরে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেয়র আহমেদুল হক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) স্যান্ডওয়েলের মেয়র আহমেদুল হক লন্ডনের বাইরের কোনো কাউন্সিলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম কোনো মেয়র হলেন আহমেদুল হক। ১৯ মে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের মিডল্যান্ড বিভাগের স্যান্ডওয়েল মেট্রোপলিটান বারা কাউন্সিলের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ১৯৯৬ সাল থেকে টানা তিনি স্থানীয় ট্রিপটন গ্রিন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ১৯৩২ সালে সিলেটের বিশ্বনাথের দশঘর ইউনিয়নের শাবাজপুর গ্রামে আহমেদুল হকের জন্ম। ১৯৬৩ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। লেবার পার্টির সক্রিয় সদস্য ১৯৬৪ সাল থেকে। চার সন্তানের জনক আহমেদুল হক বলেন, ২০০৯ সালে ডেপুটি লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এই কাউন্সিলের ২৪টি ওয়ার্ডে বাঙালির সংখ্যা হবে মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার। আমার নিজের ওয়ার্ডে বাঙালি ভোটার একেবারে নগণ্য। তারপরও স্থানীয় ভোটারদের ভোট পেয়েছি। মেয়র হিসেবে তাঁর কাজ পুরোটাই স্পিকারের মতো। তাঁর স্ত্রী সুরমা হক মেয়রেস বা বারার ফার্স্ট লেডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আহমেদুল হকের সঙ্গে ডেপুটি মেয়র হিসেবে আছেন কাউন্সিলর সুজান ইভস। বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রসঙ্গ তুলতেই প্রবীণ এই মেয়র মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে বার্মিংহাম থেকে আন্দোলন করার স্মৃতি তুলে ধরলেন। বিলেতে আসার আগে ইত্তেফাক ও ইনসাফ পত্রিকায় পেস্টিং কর্মী হিসেবে কাজ করার কথাও শোনালেন। এই কাউন্সিলে সাইদা আমিনা খাতুন নামে একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলরও আছেন। চট্টগ্রামের সন্তান সৈয়দ ফিরোজ গণি বার্কিং অ্যান্ড ডেগেনহাম কাউন্সিলের চেয়ার অব দ্য অ্যাসেম্বলি চেয়ার অব দ্য অ্যাসেম্বলি সৈয়দ ফিরোজ গণি বৃহত্তর লন্ডনেরই অংশ বার্কিং অ্যান্ড ডেগেনহাম কাউন্সিল। এ কাউন্সিলে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য চেয়ার অব দ্য অ্যাসেম্বলি নির্বাচিত হয়েছেন চট্টগ্রামের সন্তান সৈয়দ ফিরোজ গণি। ১৭ মে তিনি কাউন্সিলরদের ভোটে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে পদটি ধরে রাখেন। ফিরোজ গণি প্রথম কোনো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, যিনি এই কাউন্সিলে চেয়ার অব দ্য অ্যাসেম্বলির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। এ কাউন্সিলে অনুষ্ঠাননির্ভর সভাগুলোতে সভাপতিত্ব করেন মেয়র। আর চেয়ার অব দ্য অ্যাসেম্বলির কাজ হলো কাউন্সিলের সভায় সভাপতিত্ব করা, যেখানে কাউন্সিলের নীতিনির্ধারণ ও বাজেট পাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। ফিরোজ গণি স্থানীয় ভ্যালেন্স ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ২০১৪ সালে প্রথম কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে তিনি দুই দফা ডেপুটি চেয়ার অব দ্য অ্যাসেম্বলি ছিলেন। এই কাউন্সিলে মোট ৫১ জন কাউন্সিলরের মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। লেবার পার্টির রাজনীতিক ফিরোজ গণি বলেন, চট্টগ্রাম শহরের চাঁদগাঁও এলাকায় তাঁর জন্ম। ১৯৯৬ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। লেবার পার্টির সদস্য হিসেবে যোগ দেন ২০০২ সালে। স্ত্রী নাইম আরা ও দুই সন্তান নিয়ে ফিরোজ গণি তাঁর নির্বাচনী ওয়ার্ডেই বসবাস করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে এই পরিবারের বেশ ভালো যোগাযোগ রয়েছে। কাউন্সিলর হওয়া সহজ নয় স্থানীয় সরকারে বাঙালিদের বিচরণ দেখে যুক্তরাজ্যে কাউন্সিলর হওয়া সহজ মনে করা ঠিক হবে না। এখানে কাউন্সিলর পদে দলগুলোর মনোনয়ন পেতে চারটি ধাপ পাড়ি দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে অবশ্যই দলের সদস্য হতে হয়। আবেদনপত্রের সঙ্গে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে হয়। এ পর্বের বাছাইয়ে পার পেলে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের কাছে সাক্ষাৎকার। এখান থেকে ছাড়া পেলে যে ওয়ার্ডে প্রার্থী হতে চান, সেই ওয়ার্ডের দলীয় সদস্যদের ভোটাভুটি। এই ভোটাভুটিতে টিকলেই মেলে চূড়ান্ত মনোনয়ন। আর/০৭:১৪/২৭ মে
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2qp4mma
May 27, 2017 at 01:50PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন