সিঙ্গাপুর, ২০ জুন- মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম। বাংলাদেশে নিজের পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন সিঙ্গাপুরে। সেখানে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এই দ্বীপরাষ্ট্রে যেতে বাবার জমি, মাছের খামার বিক্রির পাশাপাশি পরিচিতজন এবং ব্যাংক থেকে টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। গত বছর বিভিন্ন সংস্থায় ১২ হাজার মার্কিন ডলার (প্রায় ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৩৬০ টাকা) খরচ করার পর তিনি কাজ পান। কিন্তু গত ডিসেম্বরে তার নিয়োগকর্তা জানিয়ে দেন, পর্যাপ্ত কাজ নেই। এতে পরের এক মাস সিঙ্গাপুর জনশক্তি মন্ত্রণালয় ঘুরে আরেকটি চাকরির চেষ্টা করেন। সেখানে কাজ জোগাতে ব্যর্থ হয়ে ছয় হাজার ডলার খরচ করে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। অথচ সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর থেকে মাত্র পাঁচ হাজার ডলার আয় করতে পেরেছিলেন তিনি। সেটাও দৈনন্দিন নির্দিষ্ট সময়ের কাজের বাইরে তিন ঘণ্টা ওভারটাইম করেন। সিঙ্গাপুরে অস্থায়ীভাবে শ্রমিকরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে পারেন। নির্মাণ শিল্প, জাহাজে, উৎপাদন ও সেবা খাতসহ হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে। সময় যখন ভালো যায়, তখন সিঙ্গাপুরে চাকরির অভাব থাকে না। তবে অর্থনীতি একটু দুর্বল হয়ে পড়লে বেকারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। গত এক বছরে সিঙ্গাপুরে এমন ঘটনাই ঘটেছে। বিদেশি কর্মীদের ছাঁটাই করা সেখানে অনেকটাই সহজ। শ্রমিকদের জন্য এটা একেবারেই নৃশংস ব্যাপার। ঋণ নিয়ে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর আবার তাদের হতাশা নিয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে। বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে সিঙ্গাপুরে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অাশরাফুল জানান, আমি কীসের জন্য ফিরে যাব? মাছ নেই, জমি নেই; আমার ফিরে যাওয়া আর মরে যাওয়া এখন সমান। আশরাফুলের আগের নিয়োগকর্তা এলছিম কন্সট্রাকশন সার্ভিসেসের মালিক মকবুল আহমেদ খান বাংলাদেশি এই যুবকের দুর্দশার কথা স্বীকার করেন। গত বছর বাজার পড়ে যাওয়ার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে বাজার পড়ে যাওয়ার বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করেননি। সিঙ্গাপুর কন্ট্রাক্টরস অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড এবং দ্য অ্যাসোসিয়েশন অব সিঙ্গাপুর মেরিন ইন্ডাস্ট্রিজ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয় বলছে, আমরা আশা করবো সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে যেসব এজেন্সির মাধ্যমে লোকজন এখানে আসে; অ্যাম্বাসির উচিত এজেন্সিগুলোকে ফি নির্দিষ্ট করে দেয়া। ২৫ বছর বয়সী আশরাফুলের মতো আরও শতাধিক শ্রমিক নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে। তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিক। নির্মাণ কাজ করতেন তাদের অনেকেই। তবে নির্মাণ কাজে ৩০ শতাংশ ঘাটতি এবং অ্যানার্জি ড্রিংকস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে সংকটের কারণে অনেকের চাকরি চলে যায়। ২০০৯ সালের পর এবারই প্রথম স্বল্প দক্ষ চাকরিতে বিদেশিদের ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। রয়টার্সের সিঙ্গাপুর প্রতিনিধি সম্প্রতি ২৪ জনের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যাদের প্রত্যেকের কথায়ই এরকম দুঃখ আর হতাশার চিত্র উঠে এসেছে। তবে অনেক শ্রমিক এখনও সিঙ্গাপুরে কাজ করছেন। তারা সেখানে ভাল থাকার কথাও জানিয়েছেন। জীবনের সফলতার গল্পও অনেকে শুনিয়েছেন। সিঙ্গাপুর থেকে নিজের দেশে ফিরে ব্যবসা করার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ। সেখানে কাজের পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়ছে। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়; ছুটি থাকে মাসে মাত্র একদিন। তারপরও বাংলাদেশের তুলনায় সেখানে তারা ভাল থাকার কথা জানান। সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয় বলছে, ২০১৬ সালে বিভিন্ন ওয়ার্ক পারমিট হোল্ডারের অধীনে ১২ হাজার ছয়শ শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। তবে এদের মধ্যে গৃহকর্মীরা নেই। এর ফলে বাইরে থেকে আসা সাত লাখ ৫৩ হাজার শ্রমিক সেখানে আছেন। যাদের বেশিরভাগই নির্মাণ এবং জাহাজ শিল্পে কাজ করেন। সিঙ্গাপুর অবশ্য বিদেশি শ্রমিকদের পরিচয় গোপন রাখে। তবে সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর আয়েশা শেলী বলেন, গত বছর ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ায় এখন এক লাখ ২০ হাজার শ্রমিক সেখানে আছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগকারী সংস্থা পিপল ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড লিওং বলেন, প্রত্যেকদিন আমার সহকর্মীরা কাউকে না কাউকে দেশে ফেরত পাঠাতে বিমানবন্দরে যায়। গত বছর তাদের সরবরাহ করা শ্রমিকের ৪০ শতাংশ এবার নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। এতে করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কারণ তৈরি পোশাক রফতানির পর রেমিট্যান্স হল দেশটির দ্বিতীয় অর্থনৈতিক উৎস। শ্রমিকরা ফিরে আসায় ২০১৬ সালে ১১ শতাংশ রেমিট্যান্স কম পেয়েছে দেশটি।
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2sP1MuO
June 21, 2017 at 02:36AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন