লন্ডন, ২৫ জুন- বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল বিদেশের মাটিতে প্রথম ঈদের দিনে। লক্ষ্য করেছিলাম এখানে জন্ম ও বেড়ে ওঠা তরুণতরুণীরা ঈদের দিনে উল্লাস করছে অদ্ভুত এক পন্থায়। বরং বলা উচিত অদ্ভুত এক রচনাশৈলীতে। তরুণেরা ঈদের দিন ভাড়া করছে রোলস-রয়েস আর লিমোজিনের মতো বিলাসবহুল গাড়ি। অত্যন্ত উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে ড্রাইভ করছে লোকাল রোডগুলোতে আর তরুণীরা দুই চোখ বন্ধ করে লাফিয়ে উঠছে খোলা ছাদের গাড়িগুলোতে। ইস্ট লন্ডনের মসজিদে ঈদের নামাজের দৃশ্য আমার জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা। তাই স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল হওয়ার কথা। তার ওপর অভিজ্ঞতাটা হলো ইস্ট লন্ডনে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মূলত বাংলাদেশ থেকে এসেছেন আর ওই তরুণ-তরুণিরা তাদেরই সন্তান। কবি-সাহিত্যিকেরা আবার কৌতূহলপ্রবণ! যেহেতু আমি নিজে তখন একজন তরুণ কবি ছিলাম (নিজেকে কবি মনে করতাম), তাই দু-একজনকে প্রশ্ন করার লোভ সংবরণ করতে পারিনি যে, এ বিচিত্র ভঙ্গিতে ঈদের দিনে উল্লাসের রহস্য কি! উত্তরটা ছিল আরও রহস্যময়। মজা, শুধুই মজা! জানতে চাইলাম গাড়িচালক ও যাত্রীদের পূর্ব পরিচয় আছে কিনা। উত্তরটা শুনে আরও আশ্চর্য হলাম। পূর্ব পরিচিতি জরুরি নয়। আজ থেকে ১৯ বৎসর আগের বিদেশের মাটিতে এ হলো আমার প্রথম ঈদের অভিজ্ঞতা। ১৯ বৎসর পর বাংলাদেশে এই সংস্মৃতি আমদানি হয়ে গিয়েছে কিনা জানতে ইচ্ছে করে। পাঠকেরা জানিয়ে খুশি করবেন আশা করি। দয়া করে ভাববেন না যে, আমি একটা কাজ দিয়ে দিচ্ছি ফাঁকে। তবে এ কাজটা ঐচ্ছিক। দেশে থাকতে ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িরই উদ্দেশে যাত্রার প্রারম্ভে গোছগাছ যখন করতাম তখন থেকেই ঈদের ছোঁয়া লেগে যেতো হৃদয়ে। ট্রেন টিকিট করতে হতো কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে। এ ছিল এক মহাকাণ্ড! কালোবাজারিদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যেও পারাবতের টিকিট পাওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। যারা ঈদের মৌসুমে ঢাকা থেকে সিলেট ভ্রমণ করেন তাদের হয়তো সেই অভিজ্ঞতা আছে। আর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছার পর এক অন্যরকম অনুভূতি। বস্তুত বাড়িতে পৌঁছার পূর্বেই অনেক দূর থেকেই মাটির গন্ধ আসত বাতাসে ভেসে ভেসে। দৃশ্যগুলো আজও অম্লান। সেই দৃশ্য হলোধানের খেতে ঢেউ খেলে যাওয়া বাতাস আর পৌষ মাসের ওই রাঙা মাটির পথ। দুই একটা ঈদ যে ঢাকায় করি নাই, তা নয়। ঢাকায় ঈদ করা আনন্দের চেয়ে বিষাদে ভরা ছিল। ঈদে ঢাকা এক ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হতো। নতুন ঢাকা একেবারেই জনশূন্য। রাস্তাঘাটে গাড়ি-রিকশা একেবারেই নেই। খুবই ভয় হতো। রাস্তায় যখন বের হতাম তখন শুনতে পেতাম ওই দূর থেকে কে যেন জোরে শব্দ করছে। কোনো গানের শব্দ ছিল না। মানুষ একা হলে কেন জোরে জোরে চিল্লায়। ভয়ে নাকি এমনিতেই! আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি তখন অন্ধকার রাতে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন ভয় এড়ানোর জন্য জোরে জোরে গান গাইতাম। কিন্তু ঈদে জনশূন্য ঢাকায় যে শব্দ শোনা যেত, আমি নিশ্চিত সেটা গানের শব্দ নয়। বাবা আমি দারুচিনি দ্বীপে কখনো একা থাকতে পারব না। সেটা একটা উপন্যাস লেখার অভিপ্রায়ই হোক অথবা এমনকি আমাকে নির্বাসনেই পাঠানোর কারণেই হোক। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। আল্লাহ জানেন কবরের মধ্যে কীভাবে এক থাকব! ইস্ট লন্ডনের মসজিদে ঈদের নামাজের দৃশ্য হারিকেনের আলো যেমন আপন মনে হয়, সোডিয়াম লাইটের আলোটা ততটা আপন মনে হয় না কখনো। ৫ হাজার ২৫ মাইল দূরে, পৃথিবীর অন্য প্রান্তের এক শহরে এসে ঈদের আমেজ কেন যেন সোডিয়াম বাতির আলোর মতো কৃত্রিম কৃত্রিম ঠেকছিল। জীবনে প্রথম ঈদ করছিলাম মা-বাবাকে ছেড়ে। বিদেশে ঈদের দিনটাকে ঈদের দিনের মতো মনে হলো না। এ অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। ঈদের দিন সাদামাটা আরও দশ দিনের মতো আরেকটি দিন। সাতসকালে ঈদের নামাজ পড়ে কাজে যেতে হয়। ছুটি নাই। তো বিদেশের মাটিতে জীবনের প্রথম ঈদ খুব একটা সুখকর ছিল না। মনের অবস্থা ছিল বাদলা দিনের আকাশের মতো বিষণ্ন। তারপর ক্রমাগতভাবে জীবনের সীমিত দিনগুলি থেকে একে একে ১৯ বছর ঝরে পড়ে কেটে গেল। চলে গেল ৩৮টি ঈদ বিদেশের মাটিতে। এর মধ্যে ১৯টি ছিল ঈদুল ফিতর। যা সিলেটে মাসি ঈদ নামে পরিচিত। এই মাসি ঈদ নামটা যে কে কখন এবং কেন দিয়েছিল তা আজও অজানা। ইংল্যান্ডের ঈদগুলো যে প্রতি বছর কাজে কাজে কাটিয়েছি তা কিন্তু নয়। পুরো এক মাস রোজা রাখার পর ঈদের দিনে সামাজিকতা একটু আধটু তো করতেই হয়। প্রথম কয়েক বৎসর এখানে রোজার দিনগুলি ছিল খুবই ছুটো। সকাল হতে না হতেই সন্ধ্যা হয়ে যেত। একটুও বানিয়ে বলছি না। ৭-৮ ঘণ্টা পর দিনের আলো আবৃত হতো অন্ধকারে। কনকনে শীতে রোজার ঈদ ছিল। আর এখন ২০ বৎসর পরে রোজা এসেছে এই দেশের গ্রীষ্মে। ১৯ ঘণ্টা লম্বা দিন। বাংলাদেশের পাঠকদের বলে রাখা দরকার যে, এখানে শীতের দিনগুলো খুবই ছোট। দিন শুরু হয় সকাল সাড়ে ৮টায়। আর ৩টা ৪৫ মিনিটে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমরা যারা এসেছি সিলেট থেকে তাদের কাছে লন্ডন অনেকটা স্বদেশের মতোই মনে হতে পারে। কারণ এখানে সবারই আত্মীয়স্বজন কেউ না কেউ অনেক আগে থেকেই বসবাস করছেন। আর বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই তাদের বাবা-মার সঙ্গে অনেক আগেই এসে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে আছেন। আবার কেউ বা এসেছেন আমি আসার পরে। ইস্ট লন্ডনের মসজিদে ঈদের নামাজের দৃশ্য প্রবাসে ঈদের দিন অনেকেই কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার চেষ্টা করেন। আমি ওই দলেরই একজন। আইন পেশায় একটা সুবিধা হলো, কেস ফাইলগুলি ঘরে নিয়ে এসে ঘরেই কাজ শেষ করা যায়। তবে কোনো পূর্ব নির্ধারিত কোর্টের তারিখ থাকলে তো যেতেই হবে। তো আমাদের যাদের আত্মীয়স্বজন আছেন তারা দিবসের একটি অংশ রেখে দেন আত্মীয়ের ঘরে সময় কাটানোর জন্য। আরেকটি অংশ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। আর আমার ক্ষেত্রে প্রতিবারেই ঈদে কিছু সময় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না দিলেই নয়। পাঠকদের মধ্যে যারা ইংল্যান্ডে বসবাস করেন অথবা বেড়িয়ে গিয়েছেন তারা হয়তো জানেন আর যারা বাংলাদেশে তাদের অবগতির জন্য বলতে চাই হোয়াটচ্যাপেল হলো লন্ডন শহরের পূর্বদিকে এবং ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এখানে প্রধানত বাংলাদেশি অধিবাসীরাই বেশি। খুব অল্পসংখ্যক ইংলিশ লোক এখানে দেখা যায় দিনেরবেলায়। দিনের বেলা বললাম এ জন্য যে, রাতে কিন্তু অনেক ইংলিশ লোক এখানে আসেন বাংলাদেশি মজাদার ঝাল ঝুল খাবারের আস্বাদ নিতে। কারণ এখানে ও এর একটু পাশের রোড ব্রিকলেনে প্রচুর বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। তাই রাতেরবেলা বাইরের ডিস্ট্রিক্ট থেকে সবাই এখানে আসেন। রাতে লন্ডনের এই অংশটুকু অন্য রকম এক আমেজ মেতে ওঠে। সেই প্রথম ঈদ থেকে এখন পর্যন্ত আমরা বন্ধুবান্ধবেরা সমবেত হয়ে ঈদের দিনে ওই রেস্টুরেন্টগুলোতেই কমপক্ষে ২-৪ ঘণ্টা আড্ডা দিই। এই অনুশীলন সর্বদা অন্যান্য বাংলাদেশিদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ঈদের দিন রংবেরঙের শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে এখানে চলে আসেন আড্ডা দিতে। আত্মীয়দের ঘরে ঈদের দিনে পিঠা-পায়েসের নিমন্ত্রণ রক্ষা করা অনেক কঠিন এখানে। কারণ সবাই ব্যস্ত আগেই বলেছি। যখন সব আত্মীয়স্বজনই এখানকার বাসিন্দা তখন কার ঘরে যাবেন আর কাকে উপেক্ষা করবেন! কিন্তু তারপরও ঈদের দিনে নিত্য কর্মসূচির অন্যতম আত্মীয়ের ঘরে বেড়াতে যাওয়া। কাউকে নেগেটিভ উত্তর দেওয়া আমার জন্য অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার মনে হয়। তাই টেনেটুনে দু-একজনের ঘরে যাওয়া হয়। বিদেশ বিভুঁইয়ে ব্যাচেলর অথবা বন্ধুদের মধ্যে যারা এখনো তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের এখানে আনেননি তাদের ঘরে আড্ডায় স্বাদই আলাদা। আমার এ রকম কিছু বন্ধুবান্ধব আছেন। তারা আবার সেমাই ছাড়া আর কিছু তৈরি করতে অপারগ! সেমাই রান্না তো একেবারেই সোজা। মাত্র দুধ গরম করবেন আর তার ওপর সেমাই ছেড়ে দেবেন। হয়ে যাবে সেমাই। বিদেশে ঈদের স্পেশাল খাবার! ১৯ বৎসর আগে এ দেশে আসার পর, দিনের পর দিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ছিল পড়ালেখার অংশবিশেষ। সেটা করতে হতো স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। কারণ গ্রুপ ওয়ার্ক ছাড়া আইন শাস্ত্র পড়াশোনা মোটেই সম্ভব ছিল না। প্রতিটি বিষয়ে বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনা প্রয়োজন ছিল বিধায় সবসমই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেই আড্ডা দেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। তো ঈদেরদিনে সবাই মিলে ওয়েস্টএন্ড চলে যেতাম। ওয়েস্টএন্ড হলো সেন্ট্রাল লন্ডনে। এখানে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর অন্যতম ছিল হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কয়ার, বাকিংহাম প্যালেস ইত্যাদি। ভ্রমণের মওকা হতো ঈদ উপলক্ষে। আবার সবাই মিলে গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতাম বিভিন্ন সাগর পারে। বাংলাদেশে একটিমাত্র সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে। বর্তমানে সেখানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এখানে অনেকগুলো সমুদ্র সৈকত রয়েছে এবং প্রতিটি সাগর পারে সুন্দর সুন্দর হোটেল ও দোকানপাট গড়ে উঠেছে। রয়েছে চমৎকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। ইস্ট লন্ডনের মসজিদে ঈদের নামাজের দৃশ্য পর্যটন শিল্প এ দেশের আয়ের অন্যতম উৎস। এ শিল্প প্রতিটি দেশে অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের উৎস হতে পারে। সেটা যে দেশি পরিদর্শকই হোক না কেন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। বিভিন্ন আকর্ষণপূর্ণ স্থান রয়েছে। যা এখনো অবহেলিত ও উপেক্ষিত। অথচ সামান্য সরকারি অথবা বেসরকারি উদ্যোগ নিলেই প্রচুর লোকের যেমন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো তেমনই করপোরেট এবং সরকারি আয়ের এক অন্যতম উৎস হতে পারতো। কিন্তু সেটা হচ্ছে কি? তো যা বলছিলাম এই বন্ধুবান্ধবের অনেকেই ব্যারিস্টারি শেষ করে দেশে চলে গিয়েছেন এবং কর্মরত আছেন অনেক উচ্চ উচ্চ পদে অথবা জড়িত আছেন আইন ব্যবসায়। পাঠকেরা তাদের অনেককেই চিনবেন। কেউ কেউ হয়তো স্মৃতির সাগরে সাঁতরাচ্ছেন আমার এই লেখাটা পড়ে পড়ে। সেই প্রথম দিন থেকে ঈদের নামাজ হোয়াটচ্যাপেলের ইস্ট লন্ডন মসজিদে পড়ছি। বর্তমানে এই মসজিদটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ। বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য বলে রাখি, এখানে প্রায় সাত হাজার মানুষ শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়েন এর মধ্যে দুই হাজার নারীর নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে এখানে ৩০ হাজারের মতো মুসল্লি নামাজ পড়েন এবং বৎসরে ১.৭ মিলিয়ন মানুষ নামাজ পড়েন। ঈদের দিন প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঈদের জামাত এবং কমপক্ষে ৬টি ঈদের জামাত হয় এখানে। সুতরাং আপনি কখন ঘুম থেকে উঠলেন সেটা কোনো ব্যাপার নয়। দেশে থাকতে একবার আমি একটা ঈদের নামাজ মিস করে খুবই অনুতপ্ত হয়েছিলাম। এ জন্য রীতিমতো দুই দিন বিষণ্ন ছিলাম। কারণ আমার ছোটবেলায় আমাদের মসজিদে একটি মাত্র ঈদের জামাত হতো। ওই সময় আমাদের গ্রামে কোনো ঈদগাহ ছিল না। হোয়াইটচ্যাপেল গেলে আপনার কাছে মনে হবে সিলেটের বন্দর বাজারের এসেছেন। এই অনুভূতি নেওয়ার জন্য সমগ্র ব্রিটেন থেকে প্রচুর বাংলাদেশি এখানে সমবেত হন। চলনে, বলনে, ভাবভঙ্গিতে এবং পরনে যেমন বাংলাদেশের সংস্মৃতি তেমনি বাংলাদেশি দোকানপাটেও পরিপূর্ণ লন্ডনের এই অংশে। ঈদের দিন এখানে লক্ষ্য করবেন বাংলাদেশি নারীরা এসেছেন রংবেরঙের শাড়ি আর পুরুষেরা পাঞ্জাবি পরে। অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করবেন নারীরা শাড়ি পরেন গাড়ির রঙের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে। ঈদে এখানে যে ট্রাফিক তা ঢাকা শহরের ফকিরাপুলের রিকশার ট্রাফিক জামের কথাই স্মরণ করিয়ে দেবে। এই ফকিরাপুলের ট্রাফিকের সঙ্গে লেখকের এক আন্তরিক আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে। কিন্তু সর্বোপরি ইংল্যান্ডের ঈদের যে আমেজ, ঈদের যে উল্লাস, ঈদের যে অনুভূতি তাতে যেন কোথাও শূন্যতা অনুভূত হয়। কী যেন অনুপস্থিত। যেন কৃত্রিমতায় ভরা। বিদেশে আনন্দ করার বিভিন্ন উপলক্ষ আসে। যেমন বাংলাদেশ যদি ক্রিকেটে বড় সাফল্য নিয়ে আসে সবাই এখানে সমবেত হয়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন। রাস্তাঘাট বা কাজে, যে যেখানেই থাকুক না কেন, সবাই আনন্দে মেতে ওঠেন। সবাইকেই দেখবেন উৎফুল্ল। সম্প্রতি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে পৌঁছা ছিল বড় একটি সাফল্যে। যেমন বাংলাদেশ এখানে প্রথম ওয়ার্ল্ডকাপ ক্রিকেট খেলে প্রবাসী বাঙ্গালদেশিদের করেছিল গর্বিত। এখানে প্রতিবছর হয় বৈশাখী মেলা, দেখা যায় ইস্ট লন্ডনে এসেছেন বাংলাদেশিরা সমগ্র ব্রিটেন থেকে। কিন্তু ঈদের এ হলদে আনন্দ সবুজে সবুজে মোড়া নয়! বাংলাদেশের ঈদের আমেজ থাকে সবুজে মোড়া। ছোটবেলার ঈদের আনন্দ হৃদয়ের গভীরে কোথাও যেন দাগ কেটে আছে। যা এখনো অম্লান। রোজার পরের মাসি ঈদে সূর্য ওঠার আগে অন্ধকার থাকতে আমাদের গোসল সেরে নেওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হতো। তা সে যতই ঠান্ডা হোক না কেন। বলা হতো, সৌদি আরব থেকে জমজমের পানি নাকি পুকুরে আসে এবং সেটা ভোর হতে না হতেই উধাও হয়ে যায়। সেই ছোটবেলায় আরেকটি কারণ দেখানো হতো যে, জলপরির নাকি আসে পুকুরে এবং তাদের সঙ্গে গোসল করতে সূর্যোদয়ের আগে অন্ধকারেই গোসল করতে হয় পুকুরে। আমি আবার জলপরিদের প্রতি ছোটবেলা থেকেই আকৃষ্ট। তাই জলপরি দেখতে অনেকটা উৎসাহী হয়ে অন্ধকারে গোসল করতে আরও চাচাতো ভাইবোনদের সঙ্গে পুকুরে যেতাম। একটু বড় হয়ে ভাবতাম কেন যে এই অদ্ভুত কারণগুলো দেখানো হতো! কেন এই কষ্ট দেওয়া হতো। আরও একটু ঘুমিয়ে উঠে গোসল সেরে নিলে দোষ কী ছিল! আরও একটু ঘুমাতে পারলে হয়তো ভালো হতো। সেই অসম্পূর্ণ ঘুম মনে হয় এখনো ক্লান্ত করে রেখেছে। আমাদের গ্রামে (নাম কামালপুর) ঈদে অলিখিত একটি নিয়ম ছিল যে, গ্রামের সকল ছেলেদের পিঠা-পায়েস খাওয়ার জন্য প্রত্যেক বাড়ি যেতে হতো। আমাদের গ্রামটি অত্যন্ত ছোট একটি গ্রাম, এখানে মাত্র ৯০ থেকে ১০০টি বাড়ি হবে। আমরা যখন ছোট ছিলাম হাতেগোনা কিছু ছেলে ছিলাম সমস্ত গ্রামে। তাই সবাইকে যেতে হতো প্রত্যেকের বাড়িতে। বড়রা সবাই আমাদের স্নেহ করতেন। সেই অকৃত্রিম ভালোবাসা কখনো ভুলি নাই, ভোলা সম্ভব নয়। ঈদের দিনের কর্মসূচির অন্যতম ছিল বিকেলে বন্ধুরা বিশ্বনাথ জড় হয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া। ছোট একটি ছিদ্রের ভেতর হাত ঢুকিয়ে টিকিট কিনতে হতো প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে। আহা সে কী কষ্ট। আর প্রচণ্ড ভিড়! সকালে পড়শির ঘরে পিঠা-পায়েসের আমন্ত্রণ রক্ষা করা ছিল জরুরি কর্মসূচির অন্যতম। তারা শুধু মানসিক কষ্ট পাবেন এ জন্য নয়, বরং সে আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করতে ভয় পেতাম। গ্রামের প্রায় সব ঘরেই যেতে হতো। এই যে স্নেহ ও ভালোবাসা সেই ভালোবাসা আমার ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণাগুলোর অন্যতম। গ্রামের সম্মানিত মুরুব্বিদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গিয়েছেন। তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। যত দিন যাচ্ছে সেই অকৃত্রিম ভালোবাসাগুলো যেন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতে। মানুষে মানুষে ভালোবাসা কেন এখন আর নাই? আর/১৭:১৪/২৫ জুন
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2u339mf
June 26, 2017 at 12:39AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন