ওয়াশিংটন, ১৩ জুন- আমেরিকার মোটরযানশিল্পে অবদান রাখছেন বাংলাদেশি নারীরা। কর্মদক্ষতা ও একাগ্রতার কারণে অনেক নারী ধীরে ধীরে পৌঁছে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে। তাঁদের নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটি গর্ব করছে, স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশের গাড়ি (মোটরযান) প্রকৌশলী নারীদের অনেকেই মা-বাবার সঙ্গে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণে প্রকৌশলী বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। অনেকে বিয়ে করে স্বামীর উৎসাহে আবার শুরু করেন পড়াশোনা। কেউ আবার পড়াশোনা করতেই এসেছেন আমেরিকায়। পড়াশোনা শেষে চাকরি করছেন বিশ্ববিখ্যাত গাড়ি নির্মাণ ও গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা, গাড়ি প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি বা চাকরিতে টিকে থাকা কোনো পথই খুব সহজ না। প্রকৌশলীদের জন্য গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্বপ্নের চাকরির ক্ষেত্র। কঠোর পরিশ্রম, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা, সৃষ্টিশীল মনন এবং প্রতিকূল পরিবেশকে উতরে ওঠার অদম্য সাহস বাংলার এ নারীরা আজ সফলতার এ স্তরে। নেতৃত্বগুণের কারণে দ্রুত উঠে যাচ্ছেন ব্যবস্থাপনার আসনে। এ ছাড়া বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশির। উজ্জ্বল করছেন বাংলাদেশি আমেরিকানদের নাম। সর্বোপরি বাংলাদেশের নাম। তানজিমা মুস্তারিন, ফিচার ওনার, ড্রাইভার নোটিফিকেশন, কানেকটিভিটি। যিনি জেনারেল মোটরসে টেকনিক্যাল লিডার হিসেবে প্রথম বাংলাদেশি নারী। বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর শেষ করে উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকায় চলে আসেন। পারডু ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষে জেনারেল মোটরসে যাত্রা শুরু। ধারণা করা হয়, তিনি জেনারেল মোটরসে প্রথম বাংলাদেশি নারী। ১৯৯৮ সালে গাড়ি প্রকৌশলী হিসেবে যাত্রা শুরু। কাজ করেছেন গাড়ির বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল গ্রুপে। সফটওয়্যার লিড ও ইনস্ট্রুমেন্ট ক্লসাটারের দায়িত্বে ছিলেন। কর্মক্ষেত্র ও পরিবারে সময় এর ভারসাম্য রক্ষায় তাঁর প্রতিষ্ঠানকে পুরো কৃতিত্ব দিলেন। কাজের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের সাহায্য করতে সর্বদা উন্মুখ। প্রকৌশলীদের সব অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশ নেন। মৌলি আহমেদ জেনারেল মোটরস স্টিয়ারিং হুইল ও ড্রাইভার এয়ার ব্যাগ, প্রকৌশলী ব্যবস্থাপক। গাড়ি প্রকৌশলে কাজ শুরু অটোমোটিভ সাপ্লায়ার্স কোম্পানি ডেলফাই অটোমোটিভ সিস্টেমসে। এর আগে কাজ করেছেন মেগনা অটোমোটিভসে। জেনারেল মোটরসের পথচলা শুরু ২০১০ সালে। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে জেনারেল মোটরসে প্রকৌশলী ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পান মৌলি। তিনি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সংগঠন আবিয়ার মিশিগান শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। আফরোজা আক্তার, লিড অ্যানালাইসিস প্রকৌশলী, জেনারেল মোটরস। গাড়ি প্রকৌশলে কাজ করছেন ২০০০ সাল থেকে। গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ডেলফাইসহ আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। সাড়ে ১০ বছর হয়ে গেল জেনারেল মোটরসে। নতুন টুল প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করেছেন। এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। পড়াশোনা-বুয়েটের যন্ত্রপ্রকৌশল বিষয়ে ব্যাচেলর ও ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলিনা থেকে মাস্টার্স। কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও কমিউনিটি প্রোগ্রামে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। ছিলেন প্রকৌশলীদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে উপদেষ্টা। এ ছাড়া মিশিগান সায়েন্স সেন্টারের সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথ (স্টিম) প্রজেক্টের রোল মডেল হিসেবে কাজ করছেন। উইমেন ইন মোশন এর সদস্য। বেকার সায়েন্স অলিম্পিক টিমের কোচ হিসেবে আমেরিকায় জাতীয় পর্যায়ে গিয়েছেন। সফল নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে জনপ্রিয় মুখ তিনি। রেজওয়ানা হক, ক্যালিব্রেশন প্রকৌশলী, বশ। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে ব্যাচেলর শেষ করে বাংলাদেশে এক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। বিয়ের পর আমেরিকার প্রবাসী জীবন। দুই সন্তানের জন্ম ও লালন-পালনে কেটে গেছে কয়েক বছর। রেজওয়ানা হাল ছাড়েননি, বাচ্চারা একটু বড় হলে ভর্তি হন মাস্টার্স প্রোগ্রামে। মাস্টার্স শেষে জার্মান অটোমটিভ সাপ্লায়ার্স বশ-এ চাকরি শুরু করেন। ২০১২ সালে গাড়ির বডি ইলেকট্রিক ও হিউম্যান-মেশিন ইন্টারফেস গ্রুপে কাজ করছেন। নতুন পরিবেশ, বিয়ে-বাচ্চা কোনো কিছুই এখানে তাঁর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পরিবার, কর্মজীবনের ব্যস্ততার পাশাপাশি জড়িত হয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সংগঠনে। বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমোক্রেটিক ককাস (বিএডিসি)-এর কার্যনির্বাহী কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। প্রকৌশলীদের সংগঠনেও বেশ তৎপর। মাসুমা খন্দকার, এরো থারমাল প্রকৌশলী, ফিয়েট ক্রাইস্লার আটোমোটিভ। বুয়েট যন্ত্র প্রকৌশল, ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটি ডেট্রয়েট থেকে মাস্টার্স। ব্যাচেলর শেষ করে বাংলাদেশে এক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। প্রায় সাত বছর বর্তমান চাকরিতে। বর্তমানে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সংগঠনে সক্রিয় সদস্য। নতুন পড়তে আসা বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের নাম মাসুমা। নিগার সুলতানা রিম্পি-সিস্টেম প্রকৌশলী, ফোর্ড মোটর কোম্পানি। বাংলাদেশে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে ব্যাচেলর শেষ করেন। দেশে গ্রামীণফোন কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন বছরখানেক। উচ্চ শিক্ষার্থে ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশলে মাস্টার্স শেষ করেই ফোর্ড এ যোগ দেন। মা-বাবা ছেড়ে একা এত দূরে এসে পড়াশোনাচাকরি সম্ভব হয়েছে তার একাগ্রতা আর ওপরে ওঠার প্রেরণা। সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ তার। রিম্পি বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রিয়মুখ। এ ছাড়া ফোর্ড মোটর কোম্পানিতে রয়েছেন মেহনাজ চৌধুরী। গ্লোবাল কাপাসিটি প্লানিং এ কাজ করছেন। জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর শেষ আমাজন, টার্গেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ২০১৫ তে ফোর্ড মোটর কোম্পানিতে যোগ দেন। আছেন ফিন্যান্স ও প্ল্যানিংয়ের কাজ করছেন সফলতার সঙ্গে। ইতিমধ্যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স ও প্ল্যানিংয়ের ওপর সার্টিফিকেট কোর্স করেন। নিপা দে, ব্যাটারি প্রকৌশলী, জেনারেল মোটরস। জিএম এ কাজ করছেন প্রায় তিন বছর। এইচএসসি পাস করে মা-বাবার সঙ্গে চলে আসেন মার্কিন মুলুকে। নিউইয়র্কে কমিউনিটি কলেজ ও নিউইয়র্ক সিটি কলেজ থেকে কেমিক্যাল প্রকৌশলে ব্যাচেলর শেষ করে মিশিগানে জেনারেল মোটরসে চাকরি পান। মা-বাবা ছেড়ে একা চলে আসেন মিশিগান। উন্নত ব্যাটারি প্রযুক্তির বিভিন্ন টেস্ট, ভ্যালিডেশন, প্রজেক্ট লিডার বিভিন্ন পদে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করে চলেছেন। জিনাত নাজনীন লিজা, ভ্যালেও এর হয়ে জেনারেল মোটরসে গাড়ির রেয়ারভিও ক্যামেরার কাজ করেন। এর আগে উনি প্যাসিভ সেফটি ডিজাইনে অটোলিভ এবং এল্পস ইলেকট্রিকের হয়ে কাজ করেছেন। জিনাত মিশিগানের ওকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর শেষ করেন। জেনারেল মোটরসের অনিয়া কুতুব, ভেলিডেশন প্রকৌশলী হিসেবে শুরু ২০১২ সালে। বর্তমানে গাড়ি নির্মাণ লাইনের ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস সিমুলেশনে কাজ করেন। উদ্বোধন করে চলেছেন একের পর এক প্রোগ্রাম। বাংলাদেশে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) থেকে যন্ত্র প্রকৌশলে ব্যাচেলর শেষ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স। দুই সন্তানের জননী অনিয়া কাজ, পরিবার ও সামাজিকতা নিয়ে সদা ব্যস্ত। তবুও হাসিমুখে সারা বেলা, সবার প্রিয় মুখ। ফারাহ আহমেদ, কম্পিউটার আইডেড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএই) জেনারেল মোটরস। বাংলাদেশি কানাডীয়। জন্ম বাবার কর্মক্ষেত্র কুয়েত। নবম শ্রেণিতে পুরো পরিবারের সঙ্গে কানাডায় চলে আসেন। কানাডার রাজধানীর অটোয়া ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিক্যাল প্রকৌশলে ব্যাচেলর ও পরিবেশ প্রকৌশলে মাস্টার্স শেষ করে আড়াই বছর যাবৎ জেনারেল মোটরসে কর্মরত। বর্তমানে থাকেন মিশিগানে। ফারজানা রহমান, সিএই প্রকৌশলী-স্ট্রাকচারাল অ্যানালাইসিস ট্রান্সমিশন সিস্টেম। বুয়েট থেকে ২০০৯ সালে যন্ত্র প্রকৌশলে ব্যাচেলর এবং আমেরিকার আউবারন ইউনিভার্সিটি থেকে যন্ত্র প্রকৌশলে মাস্টার্স শেষ করে জেনারেল মোটরসে যোগ দেন। যে রাঁধে সে চুল ও বাঁধে বাংলা সাহিত্যের এক প্রচলিত প্রবাদ। প্রবাসী সফল এ বাংলাদেশি নারী প্রকৌশলীরা সংসার, সন্তান, পরিবারের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র সফল। নারী প্রকৌশলীরা অনেক সময় বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেন। অনেকে পড়াশোনার পর বিয়ে হয়ে কোনো দিন চাকরির চেষ্টাও করেন না। এ বিষয়টি বেশি লক্ষণীয় যেসব নারী বিয়ের পর প্রবাসে চলে আসেন। গাড়ি প্রকৌশলের এ নারীরা হতে পারেন আমাদের রোল মডেল। বাংলাদেশি নারী প্রকৌশলীরা সফলতার সঙ্গে গাড়ি নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন। এগিয়ে আসছেন নেতৃত্বে। কর্মক্ষেত্রে তাঁরা হয়ে উঠছেন সফল ব্যবস্থাপক হিসেবে। এই সফল নারীরা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ উজ্জ্বল করছেন বাংলাদেশের মুখ। জয়তু বাংলার নারী, জয়তু বাংলাদেশ। এ আর/১৩:৩৫/১৩ জুন
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2rVjP0N
June 13, 2017 at 07:32PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন