ভানু-জহরের কমেডিতে এখনও হাসেন দর্শক। বাংলায় কমেডিয়ানদের নিয়ে স্ট্যান্ড-অ্যালোন ছবি করার ট্রেন্ড বন্ধ হয়ে গেল কী কারণে? কমেডিয়ানরা কি শুধু পার্শ্বচরিত্র হয়েই থেকে যাবেন? মেনস্ট্রিম ছবিতে মজার মানুষদের জায়গাটা ঠিক কোথায়? মীর এই মুহূর্তে নানা ধরনের ছবি নিয়ে অনেকে এক্সপেরিমেন্ট করছেন। টেলিভিশনের পরদায় যে পারিবারিক, নাটকীয়, চড়া দাগের গল্প দেখতে দর্শক অভ্যস্ত, সেরকম বড় পরদাতেও দেখতে পছন্দ করছেন তাঁরা ইদানীং। কিন্তু কমেডি এত সূক্ষ্ম একটা বিষয়, যে কোথাও একচুলও যদি বেড়ে যায়, স্ল্যাপস্টিক হয়ে যায়। তখন সেটাকে কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা বলে মনে হয়। যেটা দর্শক নেন না। আবার কিছু মাপকাঠি রয়ে গিয়েছে। ভানু-জহর-রবি ঘোষের। এঁদের কমেডি সামান্য চড়াদাগের হলেও সেই সময়ে দিব্যি মানিয়ে যেত, ভালও লাগত। আক্ষরিক অর্থে কমেডি ফিল্ম বলতে যা বোঝায়, সেটা তখন হতো। এখন আর হয় না। কেন হয় না, সেটার স্পষ্ট ব্যাখ্যা সত্যিই আমার কাছে নেই। টেলিভিশনে দীর্ঘদিন কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, মানুষ আগে যে জিনিসগুলোয় মজা পেতেন, এখন সেগুলোতে আর ততটা মজা পান না। আবার সেই জিনিসটাই যখন মোবাইলে মিম হয়ে আসছে, তখন তাঁরা মজা পাচ্ছেন, ফরওয়ার্ড করছেন। অর্থাৎ প্রাইভেট স্পেসে কমেডিটা অনেক বেশি এনজয় করছেন তাঁরা। বছরের পর বছর মীরাক্কেল করতে গিয়ে আমারও কখনও মনে হয়েছে, কীসের যেন একটা অভাব। কোথাও হয়তো একটু ওভারডোজও হয়েছে। ন্যাশনাল টেলিভিশনে আবার দেখুন, কপিল শর্মা এত বড় একটা ব্র্যান্ড। মোস্ট ওয়াচ্ড টিভি শো, হাই টিআরপি! অথচ সেই কপিল শর্মাই যখন কিস কিস কো পেয়ার করুঁতে ডেবিউ করলেন, কেউ দেখলই না! আমাদের এখানে কাঞ্চন, বিশ্বনাথ, রুদ্রনীল, এরাও কিন্তু বড় পরদায় আর কমেডি করতে চাইছে না। অন্য ধারার বিভিন্ন চরিত্রে এক্সপেরিমেন্ট করছে। এদের তো বেঁধে রাখা যাবে না। কাঞ্চন যেমন ওর চেহারাটাকে কাজে লাগিয়ে বুম্বাদার ছবিতে পার্শ্বচরিত্র করেছে। গ্যাদগ্যাদে করে বানানো কমেডি সিনে। পরিচালক কিন্তু একবারও সার্ভে করে দেখেননি, মানুষ ওটা ওভাবেই দেখতে চাইছেন কি না! ভূতের ভবিষ্যৎ আবার একটুও লাউড ছিল না। বুদ্ধিদীপ্ত স্ক্রিপ্ট, অসাধারণ অভিনয়ের কম্বিনেশন। কমেডি ফিল্মে আসল হচ্ছে জোরাল একটা কনটেন্ট। এখানে ভাল অভিনেতাদের দুর্বল স্ক্রিপ্টে অভিনয় করতে হচ্ছে দিনের পর দিন। আর এখন মানুষের এক্সপোজার প্রচুর বেড়ে গিয়েছে। হয় হিরো আলম হও, নাহলে বুদ্ধিদীপ্ত, সাট্ল কমেডি কর। মাঝামাঝি কিচ্ছু নেই! কাঞ্চন মল্লিক কমেডি দুরকমের হয়। একটা কমেডি-অভিনেতাকে নির্ভর করে ছবি। আরেকটা কমেডি বিষয়-নির্ভর ছবি। বাই বাই ব্যাংকক বা ভূতের ভবিষ্যৎ যেমন। কিন্তু এখন ভানু পেল লটারি বা পানুগোপালের বিয়ের মতো কমেডিয়ান-নির্ভর ছবি আর হয় না। কারণটা গল্পের অভাব হতে পারে, প্রযোজকের সাহসের অভাবও হতে পারে। পরিচালক আছেন কিন্তু। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় যেমন অসাধারণ কমেডি হ্যান্ডল করতে পারেন। রুদ্র, পরাণদা, খরাজদাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে কমেডি ছবি বানালে তাঁরা পারফরম্যান্সের ব্যাপারে ভরসাটা দিতে পারবেন অন্তত। এবার প্রযোজক টাকার দিকটা ভাববেন। কারা কতটা সেলেব্ল, সেটা দেখবেন। আমরা যারা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করি, কোটি টাকার ছবির মধ্যে যাদের অন্তত ১৫০০ টাকার সেলেবিলিটি আছে, তাদের উপর বাজি ধরেও একবার দেখতে পারেন কিন্তু। দর্শক রেডি আছেন। এই দর্শকই কিন্তু ফাংশনে আমাদের নিয়ে হইহই করছেন। তাঁদের দিনের পর দিন নিমপাতার চচ্চড়ি খাওয়ালে টেস্টটা তৈরি হবে কীভাবে? আমাদের এখানে হয়তো দঙ্গল হবে না। কিন্তু চ্যাম্পএর মতো একটা ছবি তো আসছে। অন্তত চেষ্টাটা আছে। যদি গল্প আর ভাল পরিচালক থাকে, আর প্রযোজক বলেন, পাশে আছি, চালিয়ে যাও...আমরা কিন্তু ফাটিয়ে দেব! শুধু কমেডিয়ানদের নিয়েও ছবি হয়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু হাতে বাইসেপ নিয়ে পার্ট করেননি। রবি ঘোষ তো ছফুট লম্বা ছিলেন না বা জহর রায়কেও নিশ্চয়ই ক্লিন্ট ইস্টউডের মতো দেখতে ছিল না! আসলে তখন খুব ভাল অভিনয়টা হতো। আর আমরা ইচ্ছে করলেও পারব না। কেন জানেন তো? আমাদের তো আর গুয়ার্দিওলা নেই। তাই আমাদের বার্সেলোনাও হবে না (পেপ গুয়ার্দিওলা বার্সেলোনার প্রাক্তন কোচ)। পেয়ারাবাগানের মাঠেই ভেলকি দেখাতে হবে! গ্রামবাংলায় গত ১৭ বছর ধরে শো করেছি। গুগল সার্চ করলে যে গ্রামের হয়তো নাম পাওয়া যাবে না, সেখানেও লোকের পকেটে চাইনিজ অ্যান্ড্রয়েড। কোথায় পিছিয়ে আছে বলুন তো? কোন গ্রামের মেয়ে এখন কলাবিনুনি করে হাঁটুর উপর শাড়ি পরে ক্ষেতের উপর দৌড় লাগায়? আম কোনটা, আমসত্ত্ব কোনটা, তাঁরা চেনেন। ওঁদের আর বোকা বানানো যাবে না। ওঁরা যদি রণবীর কপূরকে দেখতে পারেন, আমাদের কেন দেখবেন না? আমরা নলেনগুড়ের পাটালি দিলে ঠিক খাবেন। ভেলিগুড় দিলে কেন খাবেন? প্রযোজকদের আমাদের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। যে চিত্রনাট্যকারেরা ঢিশুম ঢিশুম লিখছেন, তাঁদেরও ব্যাগে লুকনো দুর্দান্ত স্ক্রিপ্ট রয়েছে। প্রোডিউসারের গ্রিন সিগনাল পেলেই তাঁরা সেগুলো বার করবেন। বল ঘুরিয়ে দেবেন কমেডির। আমরা কমেডিয়ানরা হয়তো সাত নম্বরে নামি, কিন্তু ম্যাচটা ঘোরাতে পারি। অডি-ও নেই, বডিও নেই, মাথাটা তো আছে! শুভাশিস মুখোপাধ্যায় এখন ছবির নায়করাই তো কমেডি করেন। কাজেই আলাদা করে সিনেমায় আর কমেডিয়ানদের জায়গাটা তেমন রাখা হচ্ছে না ইদানীং। আর হলেও সেটা যে খুব উচ্চমানের কমেডি হচ্ছে, এমনটাও নয়। কমেডির নামে এখনও বহু ক্ষেত্রেই ভাঁড়ামো করা হয়। অথচ এখনও কিন্তু বাংলায় খুব দক্ষ কমেডিয়ানরা আছেন। যাঁদের দিয়ে ভাল কাজ করানো যেতে পারে। কিন্তু সেটা করানো হচ্ছে না। প্রযোজক-পরিচালকেরা ঝুঁকি নিতে ভয় পাচ্ছেন আসলে। একটা সময় আমি একচেটিয়াভাবে কমেডিয়ান হিসেবে কাজ করতাম বাংলা ছবিতে। তখনও প্রযোজক-পরিচালকেরা স্ট্যান্ড-অ্যালোন কমেডি ছবি বানাতে ভয় পেতেন, এখনও পান। আরেকটা জিনিসও মনে হয় যে ভাল কমেডি লেখার মতো চিত্রনাট্যকারের অভাব রয়েছে। যে ধরনের কাজ রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায় কিংবা অনুপ কুমারদের নিয়ে হতো, সে রকম কাজ করার সাহস দেখাতে পারছেন না এখনকার ছবি-করিয়েরা। তাছাড়া এখন বেশিরভাগ পরিচালকই প্রযোজকের হাতের পুতুল হয়ে থাকেন! প্রযোজকদের বোঝানোর ক্ষমতাটুকুও নেই। আর মজার ছবি তৈরি করতে যে রসবোধ, মুনশিয়ানার প্রয়োজন, সেটা এখনকার বেশিরভাগের পরিচালকেরই নেই। যাঁদের আছে, তাঁরাও ঠিকমতো এগোতে পারছেন না। এর সমাধানের রাস্তাটা অভিনেতাদের হাতে নেই। তাঁরা বড়জোর পরামর্শ দিতে পারেন। আর টেলিভিশনের কমেডি শোগুলোর ফলেও যে বিশেষ লাভ হচ্ছে, এমনটা বলব না। সেখান থেকে কতজন উঠে আসছেন? দুএকজন এসেছেন, যাঁরা খুবই দক্ষ। কিন্তু সিনেমায় তাঁরা সেরকম সুযোগ পাচ্ছেন কই? অপূর্ব রায় কিংবা মৃদুল ভট্টাচার্যকে তো সেভাবে ব্যবহার করছে না বাংলা ছবি! যাঁরা শুধু স্ট্যান্ড-আপ কমেডিই করেন, সিনেমায় তাঁদের কমেডির পাশাপাশি অভিনয়টাও করতে হয়। যেটা কঠিন। সেই দক্ষতা সকলের আছে বলে মনে হয় না। বরং যাঁরা ফিল্ম বা থিয়েটারে কাজ করেন, তাঁদের ফ্লেক্সিবিলিটি বেশি। ভাল কমেডি দর্শককে উপহার দিতে প্রযোজক-পরিচালকরাই এগিয়ে আসুন। খরাজ মুখোপাধ্যায় বাংলা কমেডিয়ানরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন সেটা জানার আগেও জানা জরুরি, বাংলা ছবি এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। নামী ব্যানার যে কটা আছে এই মুহূর্তে, তারাও বড় বাজেটের ছবিতে ঝুঁকি নিতে চাইছে না বেশি। আশা করা যায়, এরপর থেকে মৌলিক গল্প নিয়ে আরও বেশি করে এক্সপেরিমেন্টাল ছবি হবে। যে ধরনের ছবি আমরা করতে চাইছিলাম এতদিন ধরে। ভিন্ন রুচি, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন মানসিকতা নকল করে অভিনয় করে যেতে হচ্ছিল দিনের পর দিন। ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ছবিগুলো করার কোনও কারণ খুঁজে পাইনি। পেটের দায়ে করে গিয়েছি। সেটাকে আমরা আদৌ কমেডি বলছি না। কমেডি বলতে যেটা বুঝি, সেটা তো হয়ইনি! বেলাশেষে কিংবা ভূতের ভবিষ্যৎএ হয়েছে কিছুটা। সেগুলো কোনওটাই কিন্তু অন্য ছবির কপিক্যাট নয়। নতুন গল্প। মৌলিক ভাবনা। বাংলার মানসিকতা, ধরন বুঝে তৈরি করা। এই যে এখন ছবি-নির্মাতাদের বাজেট নিয়ে একটা চিন্তা হয়েছে, সেটা একদিক থেকে শাপে-বর হয়েছে আমাদের পক্ষে। তাঁরা এখন ভাল গল্প খুঁজবেন। বলবেন, কী মজার গল্প আছে বার করুন দেখি! যাঁরা এতদিন বসেছিলেন, তাঁরা ভাল অভিনয় করার সুযোগ পাবেন। কমেডিয়ানদের অবস্থা এখন যা, তার চেয়ে ভাল হওয়ার চান্স আছে কিন্তু। পাতালঘরএর চরিত্রটা করে যেমন খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। সে রকম চরিত্র আরও করতে চাই। খুঁতখুঁতানিটা তো থেকেই যাবে। মানুষের আগে পড়াশোনার বাতিক ছিল। পরিচালকরা প্রচুর বই পড়তেন। বড় বড় লেখকদের গল্প নিয়ে ছবি হতো। পড়াশোনা করে ছবি করতে আসতেন সকলে। এখন আর সেটা হয় না। রুদ্রনীল ঘোষ শুধু কমেডি নয়, আমাকে নিয়ে আলাদা রকমের ছবিও হয়। আমার মনে হয়, কমেডিয়ান শব্দটা এই মুহূর্তে এগজিস্ট করে না। চেহারা বা কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে এখন আর কমেডি হয় না। হলেও দর্শক সেটা গ্রহণ করেন না। মানুষ এখন সিচুয়েশনাল কমেডি দেখতে পছন্দ করেন। সেখানে কমজোরি স্ক্রিপ্ট হলে সমস্যা তৈরি হয়। পদ্মনাভ দাশগুপ্তকে বাদ দিলে নতুন ধরনের রসিক লেখা কেউ লিখছেন না সেরকম। অনিকেত চট্টোপাধ্যায় বাই বাই ব্যাংকক বানিয়েছিলেন কতদিন আগে। আগে নায়ককে দেখে লোকে সিনেমা হলএ যেত। অমুক অভিনয় করছেন মানেই সবাই দেখতে যাবে! এখন তো কনটেন্টই হিরো। আমাদের সমাজে হাসার উপাদান কমে যাচ্ছে। সিনেমা তো শুধু ব্যবসা নয়। কারণ এতে অনেকগুলো মানুষের মন একসঙ্গে ভাল বা খারাপ হয়ে যায়। কমেডি তিনিই করতে পারেন, যাঁর কাছে বাকি চরিত্রে অভিনয়গুলো দুধভাত। টাইমিং ইজ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট ইন কমেডি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, অভিনেতাদের ঠিকমতো ব্যবহার না করা। যেমন যিশু ব্রিলিয়ান্ট কমেডি করে। কিন্তু সেরকম চরিত্র কটা পায় ও? সত্যজিৎ রায় কিন্তু গুগাবাবাতে কমেডির প্যাকেজে দামি কথা বলেছেন। ফেলুদার মধ্যেও বিরাট বড় একটা কমেডির লেয়ার রেখেছেন জটায়ুকে দিয়ে। কমেডি তো আট থেকে আশি সকলে দেখেন। পরিচালক-প্রযোজকদের ব্যবসার ক্ষেত্রেও এটা বিরাট বড় অস্ত্র। পরিবারের সকলে মিলে দেখতে গেলে তো ব্যবসা বাড়বেই। টিভিতে ভাল কমেডি সিরিয়াল আর হয়ই না। অমরীশ পুরীর ভিলেনি হাবভাব বা নিরূপা রায়ের কান্না এখন আর মানুষ নেবেন কি? ইরফান খানেরা এসে সে সব কনসেপ্ট চুরমার করে দিয়েছেন। কমেডির ক্ষেত্রেও তাই। এখানে ব্যবসা পড়ে রয়েছে। প্রযোজকদের তো দায়িত্ব নিয়ে বোঝাতে হবে সেটা!
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2tVPyNz
June 23, 2017 at 10:10PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন