২০১৫ সালে এডিলেডের ওভালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থান ছিল অনস্বীকার্য। গতি ও সুইং ডেলিভারি দিয়ে রুবেল হোসাইন বিশ্বকাপ থেকে ইংল্যান্ডকে আউট করে দেন। আর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নিশ্চিত করে কোয়ার্টার ফাইনাল। লজিস্টিক, টুর্নামেন্টের আয়োজন, মার্কেটিং থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বোর্ডের সঙ্গে ১৯৭৮ সাল থেকেই যুক্ত আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। বাংলাদেশ দলের পুরো জার্নিটাই কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি বলেন, বিদেশের ভেন্যুতে ইংল্যান্ড হারানো অনেক কিছু ছিল। বর্তমানে বোর্ডের অন্যতম ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন তিনি। তার জন্ম ঢাকায়, ১৯৫৯ সালে। তখন এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান। কিশোর বয়সে প্রথম টেস্ট ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন। ম্যাচটি ছিল পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। যদিও তাতে পূর্ব পাকিস্তানের অংশগ্রহণ ছিল না। পাকিস্তানের অর্ধেক মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের হলেও সরকার বাজেটের তিনভাগের একভাগ খরচ করতো এখানে। ববির মুখে, ২০০ বছরে ব্রিটিশ উপনিবেশ শেষে ২৫ বছরের পাকিস্তানি শোষণ। এসব বৈষম্য গ্রাস করেছিল ক্রিকেটকেও। ক্রিকেট টিমের সব নির্বাচক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা শুধু পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতেন। তাও মাঝে মাঝে। কারণ অর্থের অভাব। ২৫ বছরের ইতিহাসে পাকিস্তান দলে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের একজন খেলোয়াড়ই জায়গা পেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ঢাকায় কমনওয়েলথ একাদশের সঙ্গে একটি ম্যাচের আয়োজন করা হয়। ততক্ষণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন শুরু হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট) নির্দেশে পরে স্টেডিয়ামে ছাত্ররা আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়। এর কয়েক সপ্তাহের মাথায় যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত নব্য স্বাধীন দেশে তখন মানবিক সংকট চলছে। অন্য সবকিছুর মতো ক্রিকেটও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ববি বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির জন্য খেলাটা তখন বিলাসিতাই ছিল। দ্রুত এগিয়ে যাওয়াটা ছিল তখন বেশ অসম্ভব। ১৯৭২ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ বাতিল হয়ে যায়। ওই সময় একটি ক্রিকেট ব্যাটের দাম ছিল একজন সরকারি কর্মকর্তার এক মাসের বেতনের সমান। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা যখন অনুশীলন করতেন তখন বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাদের পানি পর্যন্ত সরবরাহ করতে পারতো না। ১৯৭৫ সালে স্বাগতিক বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সাবেক সাসেক্স খেলেয়াড় ও সাংবাদিক রবিন মার্লার বাংলাদেশের ক্রিকেট যাত্রাকে গুরুত্ব দিয়ে আর্টিকেল লিখেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৬-৭৭ সালে মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের সফরে সেটি ভূমিকা রেখেছিল। ববির মুখে, এর মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য প্রথম জানালাটি খুলে গেল। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে খেলার মধ্যে ফুটবলের আধিপত্য ছিল বেশি। ওই ঘটনার পর ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯৭৯ সালে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়। এর পর আরও চারবার বাংলাদেশ এ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। কোয়ালিফাই পর্বে ডেনমার্ক ও মালয়েশিয়ার মতো দেশের বিপরীতেও বাংলাদেশকে হারতে হয়েছে। প্রত্যেক ব্যর্থতাই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে চার বছর করে পিছিয়েছে। ফলে ক্রিকেটের বিষয়ে বাংলাদেশের হীনমন্যতাও স্থায়ী হয়েছে দীর্ঘদিন। ১৯৮৬ সালে এশীয় কাপে খেলে বাংলাদেশ। ওয়াসিম আকরামরা তখন বাংলাদেশের সঙ্গে খেলার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। দেরিতে হলেও আইসিসিও তাতে মনোযোগ দিয়েছিল। ১৯৯৮ সালে প্রথম চ্যাম্পিয়ন ট্রফির আয়োজন করে বাংলাদেশ। কিছু সময় আগেই বাংলাদেশকে ভয়ানক বন্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ববি বলেন, বাংলাদেশের জন্য টুর্নামেন্ট আয়োজন বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু বাঙালিরা তাদের সামর্থ্য প্রমাণ করেছিল। এর এক বছর পরেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলে। তারা স্কটল্যান্ডের পর পাকিস্তানকেও হারিয়ে দিয়েছিল। সেই জয় বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৭২টি ম্যাচের মধ্যে ৭১টিতেই হেরেছিল বাংলাদেশ। মূলত অনভিজ্ঞতা এবং নিজেদের আবিস্কার করতে না পারার ব্যর্থতাই এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে। ববি বলেন, দেশীয় ক্রিকেটকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে আমাদের অনেক সময় লেগেছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য একটা উপায়ই ছিল তখন। সেটি হচ্ছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলা। ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ মাঝে মাঝেই তাদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে থাকে। ২০০৫ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো, ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা ডিগবাজি খাইয়ে ছাড়া, ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে ওয়ানডে সিরিজে ৪-০তে বাংলাওয়াশ। তারপরও তাদের পিছু হটার প্রবৃত্তি যেন ছিলই। ২০০৭ সালে ভারত ক্রিকেট লীগ (আইসিএল)তে খেলার জন্য ১৪ খেলোয়াড়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কার্ডিফে সেঞ্চুরি করা মোহাম্মদ আশরাফুলকেও দুর্নীতির দায়ে নিষিদ্ধ করা হয়। সেই অ্যাডিলেডেই যেন নতুন বাংলাদেশ দলের জন্ম হয়েছে। নিজ ঘরে ছয়টি ওডিআই সিরিজ জেতার পর বাংলাদেশে চ্যাম্পিয়ন ট্রফির খেলারও গৌরব অর্জন করেছে। পেছনে ফেলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ছয়ে র্যাংকিং ধরে রেখেছে। গত অক্টোবরে টেস্টে শক্তিশালী দল ইংল্যান্ডকেও হারায় বাংলাদেশ। গত মার্চে ১-১ সমতায় শ্রীলঙ্কার সঙ্গে টেস্টে ড্র করেছে তারা। বাংলাদেশের ক্রিকেট যাত্রার এটাকেই শুরু বলা উচিত। টেস্ট খেলুড়ে দেশের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত, পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশ। দেশের ১৬ কোটি মানুষ, ক্রিকেটের প্রতি অতৃপ্ত ক্ষুধা, অবকাঠামো, খেলার ধরনসহ সবকিছু উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আগামীর বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ নিজেকে বড় শক্তিশালী দল হিসেবে জানান দিতে যাচ্ছে। ববি বলেন, ক্রিকেটে ম্যাচ জেতাই সবকিছু নয়- এই খেলা বাংলাদেশকে একটি ইতিবাচক পরিচয় এনে দিয়েছে এবং পুরো দেশকে একতাবদ্ধ করেছে। ক্রিকেট দেশের পুরো প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখার সাহস দিয়েছে। ববির ভবিষ্যৎবাণী ২০২০ সালের মধ্যে ওডিআইয়ে সেরা পাঁচে জায়গা করে নেবে বাংলাদেশ। এটার বলার সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে শুধরে নেন ববি। না, ২০২০ সালে বাংলাদেশ থাকবে সেরা তিন-এ।
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2rswyV6
June 14, 2017 at 07:31AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন