ঢাকা::
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ, আমার শোলক বালার কাজলা দিদি কই। শিশুসন্তান মারিয়াকে এভাবেই পড়াচ্ছিলেন বাবা। হঠাৎ মারিয়া প্রশ্ন করল বাবা বাঁশ বাগান দেখতে কেমন? বাবা বললেন, অনেক বাঁশ মিলে সারিবদ্ধভাবে গড়ে ওঠে বাঁশবাগান। বাবার উত্তরে ছোট মারিয়া কিছু বুঝতে পারল না। কারণ ছোটবেলায় কখনো গ্রামে যাওয়া হয়নি মারিয়ার। ফলে বাঁশবাগান তো দূরের কথা বাঁশ দেখাই তার সৌভাগ্যে জোটেনি। বাবা উদ্যোগ নিল মেয়েকে বাঁশবাগান দেখাবে। কিন্তু ইট কাঠের এই রাজধানীতে বাঁশবাগান কোথায় পাবে? ভেবেচিন্তে বের করল মেয়েকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে যাবে। হয়তো সেখানে দেখা মিলতে পারে বাঁশবাগানের। চলুন আমরাও বাবা মেয়ের সাথে ঘুরে দেখি রাজধানীর সমৃদ্ধ উদ্ভিদ উদ্যানকে। ঢাকা শহরে বিশাল আকারে প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব বেশি নেই। অল্প যেক’টি আছে, তার মাঝে একটি হলো মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন। এখানে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে চোখে পড়বে বিভিন্ন প্রকৃতির গাছ। উঁচু টিলা আর নিচু জলাশয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে ভালোই লাগবে সবার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত মানুষের পদচারণে মুখরিত থাকে দেশের সবচেয়ে বড় এ উদ্ভিদ উদ্যান। অনেকেই নগরজীবনের কোলাহল ভুলে একটু নির্জনতার স্বাদ নিতে এবং নিজেকে প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দিতে ঘুরে আসতে পারেন সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এ উদ্যানে। সপ্তাহের প্রতি দিনই বেড়াতে যেতে পারেন উদ্ভিদ উদ্যানে। উদ্ভিদ উদ্যানের প্রায় পাঁচ একর জায়গা জুড়ে একটি নার্সারি রয়েছে। এ নার্সারিতে ফুল, ফল, লতা, গুল্ম ইত্যাদি উদ্ভিদের চারা চাষ করা হয়। সরকার নির্ধারিত মূল্যে এই নার্সারি থেকে চারা কেনা যায়।
ইতিহাস
১৯৬১ সালে মিরপুরে এ উদ্যানের যাত্রা শুরু হয়। বিচিত্র প্রজাতির উদ্ভিদের সমারোহে ৫৭টি বিভাগে বিভক্ত এ উদ্যানটি। এর মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও জিনপুল তৈরি। এ উদ্যানে রয়েছে গোলাপ বাগান, পাইন বাগান, ফলগাছের বাগান, বাঁশবাগান, পামগাছের বাগান, মৌসুমি বাগান, ঔষধি গাছের বাগান, পদ্ম পুকুর, শাপলা পুকুর, ক্যাকটাস হাউস, অর্কিড হাউস এবং ইন্ডোর গাছের জন্য রয়েছে নেট হাউস। ছোট-বড় জলাশয় আছে সাতটি, মোট আয়তন প্রায় ১১ একর। প্রতি বছর উদ্ভিদপ্রেমীসহ শিক্ষা ও গবেষণার কাজে এ উদ্যান পরিদর্শনে আসেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এখানে বর্তমানে ১১৭টি উদ্ভিদ পরিবারভুক্ত ৯৫২ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। যার মধ্যে ২৫৬টি প্রজাতির ৩৫ হাজার বৃক্ষ, ৩১০ প্রজাতির ১০ হাজার গুল্ম ও ৩৭৮ প্রজাতির ১২ হাজার বিরুৎ ও লতা জাতীয় উদ্ভিদ।
উদ্যান পরিচিতি
রাজধানীর সবচেয়ে বড় ও দৃষ্টিনন্দন স্থান হিসেবে পরিচিত উদ্ভিদ উদ্যান ২০৮ একর জমির ওপর মিরপুরে অবস্থিত। এ উদ্যানে আছে লেক, ঘূর্ণায়মান হাঁটার পথ, ১১৭টি উদ্ভিদ পরিবারভুক্ত ৯৫২ প্রজাতির দেশী-বিদেশী উদ্ভিদ। এখানে রয়েছে বহু প্রজাতির উদ্ভিদ। উদ্ভিদগুলো শনাক্ত করার সুবিধার্থে প্রতিটি উদ্ভিদের গায়ে নামফলক দেয়া আছে। বিশাল আয়তনের এ উদ্যান ঘুরে দেখতে অনেক সময় লাগতে পারে। তাই ইচ্ছা করলে কিছু খাবারও সঙ্গে নিতে পারেন। জীবন্ত এ উদ্ভিদ সংগ্রহশালায় রয়েছে বিরল প্রজাতির অ্যাভেনিয়াম, বচ ইপিসিয়া, আক্সিফানসহ অস্ট্রেলিয়ার সিলভার ওক জ্যাকারান্ডা ও ট্যাবেবুইয়া।
উদ্যানের আদ্যোপান্ত
প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা বাওবাব গাছ। এর একটু পাশেই নানা জাতের গোলাপ বাগান। প্রধান পথ ধরে একটু সামনে এগোলেই পাওয়া যাবে অস্ট্রেলিয়ার সিলভার ওক, জাকারান্ডা ও ট্যাবে বুইয়া, জাপানের কর্পূর, মালয়েশিয়ার ওয়েল পাম, থাইল্যান্ডের রামবুতাম। রাস্তার দুই পাশে রয়েছে দেবদারু ও অস্ট্রেলিয়া থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন প্রজাতির ইউকেলিপটাসের সমারোহ। চৌরাস্তা থেকে উত্তরের রাস্তাটি ধরে এগোলে আছে কর্পূর, ম্যাগনোলিয়া, শ্বেত চন্দন, গ্লিরিসিডিয়া, ফার্ন কড়ই, তুন, কেশিয়া নড়ুসা, ট্যাবেবুইয়া ও চেরি গাছ। এখানে আছে ক্যাকটাসের এক বিশাল সংগ্রহ। ওল্ডম্যান, ফিসহুক ক্যাকটাস, ম্যামিলারিয়া, ক্ষেপালিয়া, মেলো ক্যাকটাস, গোল্ডেন ব্যারেল, সিরিয়াম হেক্সোজেনাস, র্যাট টেইল, আপাংসিয়া সিডাম, হাওয়ার্থিয়া, পিকটোরিয়া রাখা হয়েছে স্বচ্ছ কাচঘরে। উদ্যানের গোলাপ বাগানের অভ্যন্তরে পাকা জলাধারে আছে ব্রাজিলের একটি জলজ উদ্ভিদ, নাম তার আমাজান লিলি। অফিস আঙ্গিনা ঘেঁষে আছে নেট হাউস ও নার্সারি। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির চারা, বিক্রিও করা হয়। উদ্যানের অফিস এলাকার পশ্চিম পাশে অর্কিড হাউস। চোখে পড়ল, জারবেরা, অ্যানথুরিয়াম, বরুন ফেলসিয়া, ক্যামিলিয়া, পারুল, হেলকুনিয়াসহ নানা বাহারি বৃক্ষ। সঙ্গেই রয়েছে অ্যামহাসটিয়া অ্যাভোকাডো, বেগুনি এলামান্ডা, থাইল্যান্ডের গন্ধরাজ। গর্জন বাগানের উত্তর পাশে ভেষজ উদ্ভিদ বাগান। কালো মেঘ, তুলসী, আতমোরা, শতমূলী, পুনর্নভা, থানকুনি, কুমারি লতা, বাসক, বচসহ আছে হরেক রকম ভেষজ উদ্ভিদের সংগ্রহ। সবকিছু মিলিয়ে এখানে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে।
সুবিধাবঞ্চিত দর্শনার্থী
অব্যবস্থাপনা ও নজরদারির অভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বোটানিক্যাল গার্ডেন। সন্ত্রাসী-মাদকসেবী-ছিনতাইকারীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে এই গার্ডেনটি। এ ছাড়া উদ্যানের ভেতরে দিন-দুপুরে চলে অসামাজিক কাজ। যৌনকর্মী এবং তাদের দালালদের দৌরাত্ম্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন উদ্যানে ঘুরতে যাওয়া দর্শনার্থীরা। গত ১০ বছরে এই গার্ডেন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নারী-শিশুসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির লাশ। সব মিলিয়ে পর্যটকদের কাছে মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন এখন ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। ঢাকায় উদ্ভিদের যেক’টি উদ্যান আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আয়তনের ভূমির ওপর অবস্থিত এ উদ্যান। এখানে লোক সমাগমটাও একটু বেশি। দর্শনার্থীদের জন্য কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা থাকার কথা থাকলেও এখন তারা সেসব থেকে বঞ্চিত। উদ্যানে বসার বেঞ্চগুলোর অবস্থা একেবারেই খারাপ। অধিকাংশ বেঞ্চই ভাঙা। বৃষ্টি এলে একটু আশ্রয়ের ব্যবস্থাও নেই। বিশ্রাম ছাউনিগুলো একেবারে নোংরা। কতৃপক্ষ এসব ব্যাপারে দৃষ্টি দিলে ঢাকার অন্যতম বিনোদনের যায়গা হতে পারে।
from ঢাকা – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2qSYlm6
June 05, 2017 at 04:38PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন