লন্ডন, ১৫ জুন- আইসিসির যে কোনো টুর্নামেন্টে এবারই প্রথম সেমিফাইনাল খেলছে বাংলাদেশ। তবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির চলতি আসরে সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠে আসা কোনোভাবেই অঘটন নয়। দলটির গত এক যুগের পারফরম্যান্সকে পাখির চোখে পরখ করলে দেখা যাবে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়েই এই অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বলা যায়, আইসিসির অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এই টুর্নামেন্টে মৃত্যুকূপেই পড়েছিলো বাংলাদেশ। কঠিন এই গ্রুপে মাশরাফিবাহিনীকে খেলতে হয়েছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে। মাঠে নিজেদের লড়াই ও ভাগ্য - এই দুই মিলিয়ে এমন কঠিন গ্রুপ থেকে শেষ চারের টিকিট নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের। ১৫ জুন, বৃহস্পতিবার বার্মিংহামের এজবাস্টনে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের পর ওয়ানডে ফরম্যাটে আবারও আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে মুখোমুখি বাংলাদেশ-ভারত। সেবার হেরেই বিদায় নিতে হয় সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবালদের। তবে কি আবারও সেই কোয়ার্টার ফাইনালের পুনরাবৃত্তিই হতে যাচ্ছে? তারকা খেলোয়াড় কিংবা অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে ভারত। কিন্তু তারকা ক্রিকেটার সব সময় ম্যাচ জেতাতে পারেন না। জিততে হলে দরকার আরও অনেক কিছুর! আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেই অনেক কিছু দিয়েই ভারতের বিপক্ষে এগিয়ে থাকবে মাশরাফিবাহিনী। এমন পাঁচটি কারণ তুলে ধরা হলো:- আশীর্বাদের নাম তামিম: বাংলাদেশ, নিউজিল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ছিলেন তামিম ইকবাল। পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সামনে রেখে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচেও খেলেছেন ১০২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস। সেই ফর্মের ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মূল আসরেও। উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪২ বলে ১২৮ রানের একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন বাংলাদেশ ওপেনার। যা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও তামিম খেলেছেন অনবদ্য ইনিংস। স্টার্ক, কামিন্স এবং হ্যাজলউডের গতি এবং বাউন্সের সামনে যখন দলের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা খাবি খাচ্ছিলেন, তখন তিনি অপরপ্রান্তে দৃঢ়তার সাথে ব্যাট করছিলেন। শেষপর্যন্ত তিনটি ছয় এবং ছয়টি চারের মারে ১১৪ বলে ৯৫ রানের ইনিংস খেলে সাজঘরে ফেরেন। এজন্য নিজেকে কিছুটা অভাগা ভাবতেই পারেন তিনি। কারণ পুরো ইনিংসে সাবলীলভাবে ব্যাট করে সেঞ্চুরি থেকে মাত্র পাঁচ রান দূরে থাকতে স্টার্কের বলে হ্যাজলউডের হাতে ক্যাচ দিয়ে বসেন। এই নিয়ে তৃতীয়বার নড়বড়ে নব্বইতে কাটা পড়েন তিনি। তিনবারই তিনি ৯৫ রানে আউট হন। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শূন্য রানে সাজঘরে ফিরলেও তিন ম্যাচে মোট ২২৩ রান নিয়ে শীর্ষ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন তামিম ইকবাল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির চলতি আসরে শীর্ষ রান সংগ্রাহক ভারতের ওপেনার শিখর ধাওয়ান। তার রান সংখ্যা ২৭১। আর ২৪৪ রান নিয়ে তালিকার তৃতীয় স্থান নিয়ে কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। গত টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে একমাত্র আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি শতক হাঁকানোর পাশাপাশি টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেট- সব জায়গাতেই তামিম ইকবালের ব্যাট জয়ের হাসি হেসেছে। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে তিনি শেষ দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৪৬ এবং ক্যারিয়ার সেরা ১৫৭ রানের ইনিংস খেলেছেন। বিপিএল, পিএসএলের মতো ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতেও তার রানক্ষুধা ছিলো চোখে পড়ার মতো। প্রতিপক্ষ ভারতকে পেলেই যেন জ্বলে ওঠে তামিমের ব্যাট। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে ভারতের হারের ম্যাচে ৫৩ বলে ৫১ রানের চমৎকার এক ইনিংস খেলেছিলেন তামিম। ২০১২ সালে এশিয়া কাপেও ভারতকে হারানোর ম্যাচে তামিমের ব্যাট থেকে এসেছিল সর্বোচ্চ ৭০ রানের ইনিংস (৯৯ বলে)। এবারও হয়তো তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। অন্তত সেমিফাইনালেও দেশসেরা এই ওপেনারের দিকে তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ। সাকিবের রানে ফেরা: অনেকদিন ধরেই ফর্মে ছিলেন না বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজেও ব্যাট-বল হাতে ব্যর্থ হন সাকিব। ত্রিদেশীয় সিরিজের বাজে ফর্ম বজায় রেখেছিলেন আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ব্যাট হাতে করেন ১০ রান আর বল হাতে ৬২ রান খরচ করলেও দেখা পাননি উইকেটের। দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও ব্যর্থ ছিলেন সাকিব। তবে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে এসে যেন জ্বলে উঠলেন বাংলাদেশ প্রাণভোমড়া। সেমিফাইনাল স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে কিউইদের বিপক্ষে জয় ছাড়া বিকল্প ছিলো না বাংলাদেশের। এমন ম্যাচে ২৬৬ রানে লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৩৩ রানেই চার উইকেট হারায় বাংলাদেশ। সেখান থেকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ। রেকর্ড ২২৪ রানের জুটি গড়ার পথে ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরি তুলে নেন বাঁ-হাতি এই অলরাউন্ডার। সেঞ্চুরি তো নয় যেন সোনার কাঠিই ছিলো সাকিবের সেই ১১৪ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস। সেমিফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচেও সাকিবের দিকে তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ। ব্যাট-বল হাতে বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডারের দিনে যেকোনো প্রতিপক্ষকেই গুড়িয়ে দিতে পারে বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে এক্সফ্যাক্টর-ই হবেন ৩০ বছর বয়সী এই বাঁ-হাতি অলরাউন্ডার। বড় মঞ্চে শাণিত মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ: বাংলাদেশ দলের মিডল অর্ডারের অন্যতম প্রধান শক্তি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। বেশিরভাগ সময়ই অন্য তারকার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তার কাব্যিক ইনিংসগুলো। দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোতে হাফ সেঞ্চুরিকে সেঞ্চুরিতে পূর্ণ করতে না করলেও আইসিসির টুর্নামেন্ট মানেই যেন জিয়ন কাঠিতে পরিণত হয় মাহমুদউল্লার ব্যাট। ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে পর পর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন ডানহাতি এ ব্যাটসম্যান। প্রথমটা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে। সে ম্যাচটা জিতেছিলো বাংলাদেশ। সেই বিশ্বকাপেই পরের ম্যাচে মাহমুদউল্লাহর দ্বিতীয় সেঞ্চুরি ছিলো এই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যামিলটনে। যদিও ওই ম্যাচ হেরে যায় মাশরাফিবাহিনী। তবে হারলেও ব্যাপক প্রশংসায় ভেসেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। চলতি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ৩১ বছর বয়সী এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রুপকথার জন্ম দেওয়া সেই ম্যাচে সাকিবের পর সেঞ্চুরি তুলে নেন অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান। শেষ পর্যন্ত ১০২ রানে অপরাজিত থেকেই মাঠ ছাড়েন। ২০১৫ বিশ্বকাপে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরির মালিক কি এবার আইসিসির অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এই টুর্নামেন্টেও পরপর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকাবেন? অপেক্ষায় বাংলাদেশের কোটি সমর্থক! পেস আক্রমণ: গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চার পেসার নিয়ে মাঠে নেমেছিলো বাংলাদেশ। সাকিব-মাহমুদউল্লাহর মহাকাব্যিক জুটিতে শেষ পর্যন্ত পাঁচ উইকেটের জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে মাশরাফিবাহিনী। সেমিফাইনালেও বাংলাদেশের চার পেসার নিয়েই মাঠে নামার সম্ভাবনা প্রবল। অধিনায়ক মাশরাফির সঙ্গে রুবেল হোসেন, তাসকিন আহমেদ ও কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান কাঁপন ধরাতে পারে ভারতীয় শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপে। বল হাতে গতি তোলার জন্য রুবেল-তাসকিন তো আছেনই। সেই সঙ্গে কাটার ও স্লোয়ার দিয়ে মুস্তাফিজুর রহমান ভয়ঙ্কর অস্ত্র হয়ে উঠতে পারেন সেমিফাইনালে। এছাড়া অধিনায়কের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংও আছে। যদিও ইংল্যান্ডের মাটিতে সেভাবে কাজ করছে না মুস্তাফিজের কাটার। তবে প্রতিপক্ষ যখন ভারত আর মঞ্চ যখন সেমিফাইনাল তখন জ্বলে উঠতেই পারেন বাঁ-হাতি এই বোলিং বিস্ময়। সেমিফাইনালে ভারতকে হারাতে এদিন রুবেল-তাসকিনের সঙ্গে জ্বলে উঠতে হবে মুস্তাফিজকেও। ভারতের অধারাবাহিকতা: টানা খেলার মধ্যে আছে ভারতের খেলোয়াড়রা। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আসার আগে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) দশম আসর মাতিয়েছেন ধাওয়ান-কোহলি-পান্ডেরা। মাঝে আইসিসির সঙ্গে আর্থিক সংঘাতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অংশ নিয়েও ছিলো টানাপোড়েন। তবে চলতি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে হারিয়ে শুভ সূচনাই করে বিরাট কোহলির দল। যদিও সেই ম্যাচে ভারতের ফিল্ডিংয়ে বেশ দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। পরের ম্যাচ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সাত উইকেটে হারে গত আসরের বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। সেদিন ব্যর্থ হয় ভারতের উদ্বোধনী জুটিও। রান সংগ্রাহকের তালিকায় শীর্ষে থাকা শিখর ধাওয়ানও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। পুরো ম্যাচেই পিছিয়ে থাকে ভারত। যদিও গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আট উইকেটের বড় ব্যবধানে হারায় ভারত। সেই সঙ্গে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে কোহলির দল। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে যদি ভারতের তিন বিভাগ মিলিয়ে কোনো দুর্বলতা দেখা যায়, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ছাড় দেবে না মাশরাফিবাহিনী। ম্যাচে সুযোগের কোনো ছিটেফোঁটা পেলেও কোহলির দলকে হারিয়ে স্বপ্নের ফাইনালে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ! মজার ব্যাপার হলো গত ২৮ মে বার্মিংহামেই প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিলো ভারত। রানের পাহাড় গড়া ভারতের বিপক্ষে ১০০ রানের নিচেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। আবারও সেই ভারতের মুখোমুখি বাংলাদেশ। সেই বার্মিংহামেই। তবে পার্থক্যটি হলো আগেরটি ছিলো প্রস্তুতি ম্যাচ আর এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল। এবার দেখার অপেক্ষা বার্মিংহামে কি হয় ম্যাচের ফলাফল। যদিও গত আসরের চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে উপভোগের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই মাঠে নামবে মাশরাফিবাহিনী! আর/০৭:১৪/১৫ জুন
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2rj5W9D
June 15, 2017 at 02:12PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন