ইউরোপ ::
সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে সমর্থন দেবার’ অভিযোগ এনে সৌদি আরবসহ কয়েকটি আরব দেশ যে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছ্ন্নি করেছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তবে কাতারকে যে এই প্রথম আরব দেশগুলোর অবরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে তা নয়। ২০১৪ সালে নয় মাসের জন্য কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন রেখেছিল উপসাগরীয় প্রতিবেশী দেশগুলো।
উত্তেজনা শুরু হয় যখন কাতার ইসলামপন্থী দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দেয়া শুরু করে, যে দলটির তালেবান ও আল কায়েদা সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া ইরানের সঙ্গেও কাতারের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠার বিষয়টি অন্যান্য আরব দেশগুলো ঠিকভাবে নেয়নি।
সম্প্রতি সৌদি আরব কাতারের রাষ্ট্র অনুমোদিত আল জাজিরা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলে যে এটি ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে। ইয়েমেনে সরকারের সাথে হুতি বিদ্রোহীদের লড়াই চলছে, যেখানে সরকারি সেনাদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
তবে রিয়াদের এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে দোহা বলেছে, প্রতিবেশী অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় কাতারে সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ বেশী গ্রহণ করা হয়েছে।
সৌদি আরব সহ কয়েকটি আরব দেশ কাতারকে যেভাবে একঘরে করার চেষ্টা করছে, তাতে কাতারের শক্তিশালী অর্থনীতির বিষয়টি এখন আলোচনায় চলে এসেছে।
এপ্রিল মাসেই কাতার রাজপরিবারের অপহৃত সদস্যদের মুক্তির জন্য এক চুক্তির অংশ হিসেবে সিরিয়ায় আল কায়েদার সাবেক এক সদস্য এবং ইরানের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের প্রায় এক বিলিয়ন ডলার মুক্তিপন দেয়।
কাতারের রাজপরিবারের ওই ২৬ জন গত ডিসেম্বর মাসে ইরাকি শিয়া মিলিশিয়াদের দ্বারা অপহৃত হন।
আর তাদের মুক্তির বিনিময়ে মিলিশিয়াদের টাকা প্রদানের ঘটনায় কাতার ‘সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে ও অর্থায়ন করছে’ সেই অভিযোগটিও জোরেসোরে উঠে।
‘কাতারকে আরো অনেক কাজ করতে হবে’
৯/১১’র পর থেকে জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধ করতে উঠেপড়ে লাগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের আরো কয়েকটি দেশ।
দেশীয় আইনসহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজলিউশনও পাশ করা হয়। জঙ্গি অর্থায়নে সাহায্য করতে পারে এমন সন্দেহভাজন পথগুলোও আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেয়া হয়। যেমন -অনেক রেমিটেন্স কোম্পানি ও চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও কাতার সহ কয়েকটি দেশের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট এবং অর্থনৈতিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা ডেভিড কোহেন ২০১৪ সালে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন “যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র কাতার বহু বছর ধরে হামাসকে অর্থায়ন করে আসছে। যে গোষ্ঠীটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা চায় না। এছাড়াও সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন খবরে দেখা যাচ্ছে কাতার সিরিয়ায় চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থনও দিচ্ছে”।
কাতারের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি এটাও ইঙ্গিত দেন যে আল কায়েদা এবং তথাকথিত ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজটিও দেশটিতে সহজেই করতে পারছে সংশ্লিষ্টরা।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টে মি: কোহেনের স্থলাভিষিক্ত হন অ্যাডাম সুবিন, তিনিও এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে অর্থায়ন’ ঠেকাতে কাতারকে ‘আরো অনেক কাজ করতে হবে’। জঙ্গিবাদে মদদের হুমকি ঠেকানোর জন্য সন্ত্রাসবিরোধী অর্থনৈতিক আইন প্রণনয় করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা যথেষ্ট প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র কাতারের কয়েকজন নাগরিকের বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ এনে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল।
সৌদি সন্দেহ
তবে কাতারের মতো সৌদি আরবকেও সমালোচনা ও প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছিল।
৯/১১ এর ঘটনায় যে ১৯ জন বিমান ছিনতাই করেছিল, তার মধ্যে ১৫ জনই ছিল সৌদি আরবের নাগরিক।
উইকিলিকস প্রকাশিত ২০০৯ সালের যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক নথিপত্রে দেখা যায়, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ঠেকাতে সৌদি সরকারের কৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত হতাশা। সৌদি সরকার স্কুল ও মসজিদসহ বিশ্বজুড়ে ওয়াহাবি মতবাদ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নিজেদের সম্পদও ব্যবহার করেছে , যেটি চরমপন্থা ছড়িয়ে দেয়ার একটি বিরাট উৎস হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
যদিও সৌদি আরবের খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সৌদি সরকারের প্রচেষ্টা ও সমর্থন কাতারের তুলনায় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।
আর সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের সময় দুই দেশই সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন একটি বড় হুমকি ও এটি মোকাবেলায় সবাইকে একত্রিত হওয়ারও ঘোষণা দেয়া হয়। বুঝা যাচ্ছে যে ওয়াশিংটন মনে করছেন, জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়টি মোকাবেলা করতে পারলে গাল্ফভুক্ত দেশগুলোর সমস্যারও একটি সমাধান হবে।
চরমপন্থা মতাদর্শ
সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় অর্থায়ন ঠেকানোর জন্য সৌদি আরবের এই অঙ্গীকারই হয়তো সমাধানের পথ নয়।
যদিও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো যেন সরাসরি কোনো অর্থ সহায়তা না পায় সেটিই নীতিনির্ধারণী ও নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। সম্প্রতি নজর দেয়া হচ্ছে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চরপন্থা মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে কিনা।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে লন্ডনের হাউজ অব কমন্সে বিতর্ক হয়- ইরাক থেকে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীর কার্যকলাপ নিয়ে। সেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন “চরমপন্থাকে উসকে দিতে যুক্তরাজ্যে কোনো ধরনের অর্থায়নের উৎস থাকলে সেটা বন্ধ করা হবে”।
যুক্তরাজ্যে ইসলামী চরমপন্থা কার্যক্রমের উৎস কোথায়, তার ধরন কী, মাত্রা কতটুকু , বাইরের দেশের সাথে সংযোগ কতটা এ বিষয়েও অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি দেন মি: ক্যামেরন।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়-এসব অনুসন্ধান কার্যক্রম যদি সম্পন্নও হয়ে যায়, সেটা জনসম্মুখে আনা অসম্ভব।
আর এসবকিছুর সাথে গাল্ফভুক্ত দেশগুলোর সাম্প্রতিক উত্তেজনার বিষয়টি সম্পৃক্ত কিনা সে প্রশ্নও জাগে।
এর আগে এ ধরনের সংকট তৈরি হলেও, তাড়াতাড়ি সেটি সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে কাতারকে ঘিরেই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে সমর্থনের বিষয়ে সন্দেহ আর প্রশ্ন জেগেছে- সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ও চরমপন্থা মতাদর্শ সমর্থনের জন্য রাজধানী দোহাই হয়তো সন্দেহের কেন্দ্রেই থেকে যাবে বহুদিন।
from মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্য – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2ruAolv
June 15, 2017 at 04:44PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন