ঢাকা, ১০ জুলাই- দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া চলচ্চিত্রের মানুষদের জেগে ওঠার আন্দোলনকে ঘিরে আবারো চলচ্চিত্র সরব রিয়াজ। যৌথ প্রযোজনার অনিয়ম ও সাফটা চুক্তির আড়ালে কলকাতার ছবি দিয়ে ঢাকার বাজার সয়লাব করার ষড়যন্ত্র রুখতে কঠিন আন্দোলনে নেমেছে চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ১৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চলচ্চিত্র ঐক্যজোট। এর আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকাই ছবির মিয়াভাই খ্যাত অভিনেতা ফারুক। সঙ্গে আছেন প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরু, পরিচালক সমিতির নেতা মুশফিকুর রহমান গুলজার, বদিউল আলম খোকন, শিল্পী সমিতির নেতা মিশা সওদাগর, জায়েদ খানসহ আরও অনেকেই। আর শিল্পী সমিতির সহসভাপতি হিসেবে এই আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা রেখে চলেছেন চিত্রঅভিনেতা রিয়াজ। অবশেষে আন্দোলনের মুখে তথ্য মন্ত্রণালয় বাধ্য হয়েছে অনিয়মের যৌথ প্রযোজনা বন্ধ করাসহ চলচ্চিত্র পরিবারের বেশ কিছু দাবি মেনে নিতে, যা সার্বিক চলচ্চিত্রের জন্যই ইতিবাচক। গতকাল রোববার (৯ জুলাই) বিকেল ৪টার দিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সহ মন্ত্রণালয়ের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও চলচ্চিত্র পরিবারের মানুষেরা। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, নীতিমালা সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। এই খবর প্রকাশ হওয়ার পর চলচ্চিত্রাঙ্গনে উৎসব আমেজ বিরাজ করে। আর এই সভাকে চলচ্চিত্রের জন্য আশির্বাদ হিসেবে মনে করছেন অভিনেতা রিয়াজ। বললেন, কোনো ভিনদেশির দোসর, মিথ্যেবাদী বা স্বার্থবাজ ব্যবসায়ীর নয়, অবশেষে চলচ্চিত্রের মানুষদেরই জয় হয়েছে। তিনি তথ্য মন্ত্রণালিয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, আমি বলবো গতকালকের দিনটি ছিলো চলচ্চিত্রের দিন। চলচ্চিত্রের মানুষদের দিন। অনেকগুলো দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ দানা বাঁধছিলো। শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে বাধ্য হয়েই আমাদের রাস্তায় নামতে হয়েছে। আন্দোলনটি হয়েছে শিল্পী সমিতির নতুন কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পর এই কমিটির সক্রিয় ভূমিকা রাখায়। শিল্পীরা এর আগে আর কোনো আন্দোলনে এভাবে মাঠে থাকেনি। আমি শিল্পী সমিতি ও শিল্পীদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। শিল্পী ও অন্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আর তীব্র আন্দোলনের মুখেই একটি কুচক্রী মহলের হাত থেকে ইন্ডাস্ট্রিকে রক্ষা করার জন্য মনযোগী হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত এসেছে। আমি এই প্রাপ্তিগুলোকে চলচ্চিত্রের মানুষদের আন্দোলনের জয় হিসেবে দেখছি। রিয়াজ আরও বলেন, গতকাল অনেকগুলো বিষয়ে আলোচিনা হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনেক আন্তরিক ছিলো চলচ্চিত্রের প্রতি। এটা স্বস্তির বিষয়। সেখানে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যতোদিন সংস্কার না হচ্ছে ততোদিন এই সিস্টেমে ছবি নির্মাণ বন্ধ থাকবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মহাপরিচালক হারুন অর রশিদকে মন্ত্রণালয় থেকে আগামী দুদিনের মধ্যে নতুন যৌথ প্রযোজনার প্রিভিউ কমিটির নির্বাচন চূড়ান্ত নামের তালিকা মন্ত্রণালয়কে দিতে বলা হয়েছে। চূড়ান্ত কমিটি গঠন না হওয়া পর্যন্ত সকল যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হবে না। এরইমধ্যে কোরবানী ঈদকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মিত হচ্ছে। নীতিমালা সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত সেগুলোর শুটিং কী বন্ধ থাকবে? এই প্রশ্নের জবাবে মোল্লাবাড়ির বউ ছবির নায়ক বলেন, কেউ যদি জেনেশুনে নিজেকে ক্ষতির মুখে ফেলতে চায় তবে আপনি-আমি বলার কেউ নই। যারা যৌথ প্রযোজনার ছবি করছেন এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই তারা সবকিছু শুনেছেন ও জেনেছেন। নীতিমালা সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত যৌথ প্রযোজনা বন্ধ থাকবে। এরমধ্যে তাদের কী করা উচিত সেটা তারাই বিবেচনা করুক। যদি তারা অনুমোদন নিয়ে কাজ করতে পারে সেটা ভালো। আমরা চেয়েছি একটি কাঠামো মেনে কাজ হোক। সেটা হতে যাচ্ছে। শাকিব খান ও জাজ প্রধান আব্দুল আজিজকে চলচ্চিত্র পরিবার আজীবন নিষিদ্ধ করেছে। কালকের সভায় এ নিয়ে কোনো আলোচনা ছিলো কী না জানতে চাইলে রিয়াজ বলেন, না, এ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। এই বিষয়ে যা কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার চলচ্চিত্র পরিবারই নেবে। আমি তাদের নিয়ে শুধু এটুকু বলতে পারি, এটা আজ প্রমাণ হয়ে গেছে যে তারা বারবার মিথ্যে বলে অনিয়মকে নিয়ম করতে চেয়েছে। তিনি আরও জানান, এর সঙ্গে সঙ্গে সাফটা চুক্তি নিয়েও কথা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, যেহেতু এই চুক্তির সঙ্গে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও জড়িত তাই সবার সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে সাফটা চুক্তিতে চলচ্চিত্র আমদানি-রপ্তানির ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে এই চুক্তিতে চলচ্চিত্র বিনিময় বন্ধ করা হবে। কৃষ্ণপক্ষ ছবির এই অভিনেতা বলেন, গতকালকের আলোচনায় আরও একটি বিরাট সাফল্য রয়েছে। আমি বলবো এটাই সবেচেয়ে বড় সাফল্য। সেটি হলো সরকার কোরবানি ঈদের আগেই ৫০টি এইচডি প্রজেক্টর মেশিন কিনে সিনেমা হলগুলোর প্রজেকশন কার্যক্রমে যুক্ত করা হবে। পরবর্তীতে এর সংখ্যা আরও বাড়বে। এই মেশিনগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন অর্থাৎ এফডিসি। সুতারাং কোনো অসাধু ব্যবসায়ী এখানে নাক গলাতে পারবে না। ছবি মুক্তিতেও একটা ভারসাম্য আসবে। ছবি নির্মাণে অনেক প্রযোজকই এখন আগ্রহী হবে। আর জিম্মি হয়ে থাকা হলগুলো নিয়েও সরকারের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। সেগুলোও এফডিসি বা তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হবে ধীরে ধীরে। আরো যোগ করে তিনি বলেন, চলতি মাসের মধ্যেই জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা বাস্তবায়নের লক্ষে জাতীয় নির্বাহী কমিটিও গঠন করা হবে। চলচ্চিত্র পরিবার কর্তৃক পেশকৃত দাবিসমূহ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করা হবে শিগগিরিই। সরকার চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরাতে আন্তরিকভাবে পাশে থাকবে বলেও কথা দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী। সবকিছু মিলিয়ে গতকালকের দিনটি ছিলো আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য দারুণ একটি দিন। আমাদের দাবি যে অযৌক্তিক ছিলো না, আমরা যে অন্যায় পথে ছিলাম না সেটা কাল প্রমাণ হয়ে গেল। রিয়াজ আরও জানান, আমরা যখন আন্দোলনে নেমেছিলাম প্রচুর লোক ছিলাম। দিনে দিনে অনেকেই লোভে পড়ে, আতংকিত হয়ে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। অনেক বিশ্বাসঘাতকতার গল্পও শুনতে হয়েছে। অনেক প্রিয় মানুষদের দেখেছি লোভ সামলাতে না পেরে অপশক্তির দল বাড়িয়েছেন, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। আরও কষ্টের বিষয় হলো, যারা চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করে খ্যাতি পেয়েছেন, দেশ-বিদেশে সম্মান পাচ্ছেন তারা এই দুর্দিনে নিরব থেকেছেন। আর আমাদের নিয়ে অনেক বাজে বাজে কথা ছড়ানো হয়েছে। গালাগাল পর্যন্ত শুনতে হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো চোখই রাখা যায় না চলচ্চিত্রের মানুষদের নিয়ে অশ্লীল বাক্যবাণে। ফারুক ভাই, আলমগীর ভাইয়ের মতো গুণী ও সম্মানী মানুষদেরকেও হেয় করা হয়েছে। সবই উদ্দেশ্যমূলক সন্দেহ নেই। এরা চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে মানে না, সম্মানও করে না। অনেক সাংবাদিকরাও শুরুতে চলচ্চিত্রের আন্দোলনের পক্ষে থেকে শেষমেষ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ নিরপেক্ষ থেকে গেছেন। তবে অনেকে আমাদের নি:স্বার্থভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন। আমি বলবো এটা তাদের দেশপ্রেমের দায়বদ্ধতায়। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অনেক কিছুই আমরা দেখেছি ও সহ্য করেছি। আমাদের কোনো দুঃখ নেই এতে। ইন্ডাস্ট্রি ভালো জায়গায় দাঁড়াতে যাচ্ছে, আবারও ছবির বাজারে ইতিবাচক কিছু হতে যাচ্ছে এই আনন্দে আমরা সব ভুলে যেতে চাই। আমি আহ্বান করবো, যে যেখানেই ছিলেন ভুলে যান। সবাই মিলেমিশে আসুন চলচ্চিত্রের পাশে দাঁড়াই। আবারো চাইলে সুদিন আনা সম্ভব। দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে, দর্শকের চাহিদার কথা মাথায় নিয়ে আবারও ভালো চলচ্চিত্র বানাই। ইন্ডাস্ট্রি কারো একার নয়। এখানে সবাই কাজ করবে। সিনিয়রদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে সিনেমায়। একঘেয়েমি অভিনয়, একই মুখ, একই স্টাইল পরিহার করতে হবে। আমরা আগেও পেরেছি, আন্দোলন করে ভিনদেশিদের দোসরদেরও থামাতে পেরেছি, আগামীতেও পারবো। প্রসঙ্গত, বাংলা চলচ্চিত্রে তার আবির্ভাব হয়েছিলো দারুণ প্রতিযোগিতার এক সময়ে। প্রয়াত অভিনেতা জসীমের হাত ধরে বাংলার নায়ক ছবি দিয়ে অভিষেক হয় তার। নায়ক হিসেবে তখন তুমুল জনপ্রিয় অমর নায়ক সালমান শাহ, ওমর সানি, আমিন খান, রুবেল, মান্নারা। ইলিয়াস কাঞ্চনও সমান তালে অভিনয় করতেন। তিদের ভিড়েও নিজেকে আলাদা করে পরিচিত করে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন রিয়াজ। প্রাণের চেয়ে প্রিয়, নারীর মন, বিয়ের ফুল, মন মানে না, মন, প্রেমের তাজমহল, ও প্রিয়া তুমি কোথায়সহ অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবি দিয়ে হয়ে ওঠেছিলেন সুপারস্টার। ঢাকাই ছবির অন্ধকার যুগে সবাই যখন গা ভাসিয়েছে অশ্লীলতায় তখন শাবনূর-পূর্ণিমাকে নিয়ে প্রায় একাই সুস্থ ধারার দর্শককে হলে টেনেছেন রিয়াজ। হঠাৎ করে নানামুখী রাজনীতির মুখে পড়ে ইন্ডাস্ট্রি। সিনিয়ররা একে একে নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকেন সম্মান, সম্মানী, গুরুত্বহীনতার রাজত্ব দেখে। অনিয়মিত হয়ে পড়েন রিয়াজ ও তার সমসাময়িক অভিনয়শিল্পীরাও। তবে আশার কথা হলো, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আবারও সরব হয়েছেন রিয়াজ। এফডিসিতে নিয়মিতই আসছেন ফারুক, আলমগীর, সোহেল রানা, রোজিনা, অঞ্জনা, পূর্ণিমা, পপি, ফেরদৌসের মতো নন্দিত তারকারা। তারা অনেকেই চলচ্চিত্রের ব্যবসায়ে ইতিবাচকভাবে আশার আলো দেখে অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনাতেও আসতে চাইছেন। সরব হয়েছেন অনেক প্রবীন প্রযোজক ও নির্মাতারাও। তারা কেবল ছবি সারাদেশব্যাপী মুক্তির স্বাধীনতা চান। হল ব্যবসাকে চলচ্চিত্র বান্ধব দেখতে চান। আরও আনন্দের তথ্য হলো- শোনা যাচ্ছে, হলের পরিবেশ ও জিম্মিদশা কেটে গেলে শিগগিরই দেশে ফিরবেন শাবনূর। নামবেন চলচ্চিত্র পরিচালনাতে। প্রিয় মানুষদের হাত ধরেই সুদিন আসুক চলচ্চিত্রে। এআর/১৭:৫৮/১০ জুলাই
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2u95Cj1
July 10, 2017 at 11:57PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন