ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতায় অনুষ্ঠানের অন্ত নেই। নগরের নানা প্রান্তের নানা সংস্থা আয়োজন করেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দমদম দিয়ে চলাচলের সময় বাংলাদেশের অদিতি মহসীনের সঙ্গীতানুষ্ঠানের পোস্টার দেখে ভালো লাগলো। ইচ্ছা ছিল কলকাতার ডোভার লেনের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাতব্যাপী আয়োজন দেখার। সেটা শীতকালে হয়। ফলে দেখা হলো না। পুরনো কলকাতার স্থাপত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে বহুজনের নাম উৎকীর্ণ হয়ে আছে। আদি অভিজাত সম্প্রদায় হিসাবে সুবর্ণবণিকরা সুপরিচিত। সোনা ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করে এঁরা যেমন বিপুল অর্থ উপার্জন করেছিলেন, তেমনই ভূমিকা ছিল তাঁদের সংস্কৃতি চর্চায়। বৃষ্টির কলকাতায় রবীন্দ্র সরোবরে বর্ষার গান চিত্রশিল্পী ভবানীচরণ লাহা, কবি অক্ষয়কুমার বড়াল, সংগীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল, পক্ষীবিদ সত্যচরণ লাহা, সমাজসেবী মতিলাল শীল, ইতিহাসবিদ বিমলাচরণ ও নরেন্দ্রনাথ লাহা, শিল্পোৎসাহী রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক এমন আরও অনেকের কথাই উল্লেখ্য। এঁদেরই উত্তরসূরি বর্তমান প্রজন্মকে উৎসাহ দিতে প্রতি বছর পি সি চন্দ্র জুয়েলার্সের পক্ষ থেকে কৃতী ছাত্রছাত্রীদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রকাশিত হয় সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের মুখপত্র সুবর্ণরেখা। সম্পাদনা করেন সুস্মেলী দত্ত। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে, একটি সম্প্রদায় শুধু ব্যবসা নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতকে আলোকিত করছে। সোনার দোকান ঘুরতে ঘুরতে এই খবরটি জেনে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারি নি। মহানগরী কলকাতায় এমন চর্চা একটি নয়, একাধিক। কালীঘাটের কাছে হিব্রু চর্চা কেন্দ্র দেখেছি। আরও চোখে পড়েছে পর্বতারোহণ ক্লাব, প্রকৃতি নিরীক্ষণ চক্র ইত্যাদি। পাড়ায় পাড়ায় নানা রকম সংঘ শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন দিকে তৎপরতা চালাচ্ছে। আরেকটি চমৎকার বিষয় না বলরেই নয়। ছোট-বড় পাঠাগার ও ব্যায়ামাগার প্রায়-প্রতিটি পাড়াতেই আছে। বিবেকানন্দ, সূর্যসেন প্রমুখের নামে নানা প্রতিষ্ঠানের সামনে স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের আবক্ষ মূর্তি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধনকে অটুট ও মজবুত রাখতে নানা আয়োজন চলছে কলকাতার নাগরিক জীবনের নানা স্তরে। কলকাতা অবস্থান কালে নকশালবাড়ি আন্দোলনের নানা আলাপ কানে এসেছে; চোখে পড়েছে নানা লেখা। জানি না, বিপ্লবের কি কোনও জন্মদিন হয়? যেমন ১৯৬৭-র ২৪ মে! সে দিনই কি নকশালবাড়ির অদূরে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ-এর সৃষ্টি? নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছর উপলক্ষে অনেকগুলো প্রকাশনার একটি এবং অন্য কথা (সম্পা: বিশ্বজিৎ ঘোষ ও জলধি হালদার) শিরোনামে যে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে তাতে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের এই অধ্যায়ে নতুন ভাবে আলো পড়েছে। আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িতদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা প্রবন্ধ, স্মৃতিকথন, চিঠি, গল্প, আখ্যান, বিভিন্ন নিবন্ধের পুনর্মুদ্রণ রয়েছে এই সংকলনে। ১৯৪৭-এ তেভাগা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৭-র মে মাসে নকশালবাড়ি পর্যন্ত কৃষক ও চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। সন্তোষ রাণা, অমিতদ্যুতি কুমার, অভিজিৎ মজুমদার, মধুময় পাল, পুণ্যব্রত গুণ, শুভেন্দু দাশগুপ্ত প্রমুখের প্রবন্ধ, স্ত্রীকে জেল থেকে লেখা চারু মজুমদারের চিঠি, কৃষ্ণ সিংহ মোক্তানের স্মৃতিকথনের মতো লেখা সংকলনকে সমৃদ্ধ করেছে। কলেজ স্ট্রিটে নতুন নতুন অনেক প্রকাশনায় নকশালবাড়ি প্রসঙ্গ প্রাধান্য পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কলকাতার জীবনে আবশ্যিক। সুর ও বাণীর সঙ্গে নাটকীয়তার এক অপূর্ব মেলবন্ধনে সৃষ্ট রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলির মধ্যে শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা এবং চণ্ডালিকা অনন্য। এই তিনটি নৃত্যনাট্যেই বিচ্ছেদের অগ্নিদহনে প্রেম পেয়েছে পরিশুদ্ধতা। এই বিষয় ভাবনাকে কেন্দ্র করেই শিল্পী সুছন্দা ঘোষ কণ্ঠ দিয়েছেন রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের গান। তিনটি নৃত্যনাট্যের নির্বাচিত অংশ। ইতিপূর্বে সিঁডিতে পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য অথবা শুধু গানের নির্বাচন শোনা গেলেও একটি বিশেষ ভাবের সূত্রে গেঁথে গানের সঙ্গে নাট্যভাবনাকেও একক প্রয়াসে মূর্ত করে তোলার প্রচেষ্টাটি সত্যিই অভিনব। পিয়ানোশিল্পী স্যাম ইঞ্জিনিয়ারের অদম্য উৎসাহে সুজিত সরকার ১৯৯২ সালে দক্ষিণ কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন সাদার্ন স্কুল অব মিউজিক। তখন সাকুল্যে ৮-১০ জন শিক্ষার্থী। সংখ্যাটা এখন বটবৃক্ষের মতো। ১৯৯৮ থেকে ফি বছর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আয়োজিত হয় বাৎসরিক অনুষ্ঠান। লন্ডনের রয়্যাল স্কুল অব মিউজিক এবং ট্রিনিটি কলেজের অধীনে এই কেন্দ্রে পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত হয় একটি অনুষ্ঠান আইসিসিআর-এ। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত, স্ট্রিং অর্কেস্ট্রার সঙ্গেই ছিল বাংলা এবং হিন্দি গানের পরিবেশনা মন কাড়ে। সমাজ উন্নয়নের নানান ক্ষেত্রে দীর্ঘ কাল কাজ করে চলেছে টাটা ট্রাস্ট। গ্রামীণ জীবনযাত্রা থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি। পাশাপাশি গণমাধ্যম, শিল্পকলা, কারিগরি ও সংস্কৃতিরও রক্ষণাবেক্ষণ সক্রিয় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এ বছর তাদের ১২৫তম বার্ষিকী। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে তাদের পরাগ উদ্যোগ গ্রন্থাগারগুলিতে ছোটদের সঙ্গে বই নিয়ে আলোচনা, শিশুসাহিত্যের লেখক ও অলংকরণ শিল্পীদের সঙ্গে ছোটদের কর্মশালা, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গল্পপাঠের অধিবেশন ইত্যাদি। এ বার পরাগ উদ্যোগ শুরু করছে বিগ লিটল বুক টক এতে ভারতের শিশুসাহিত্য সম্পর্কে ভাষণের আয়োজন দেশ জুড়ে, লেখকদের সঙ্গে বলবেন চিত্রশিল্পীরাও। দমদমে আশিয়ানা-য় অনাথ ছেলেমেয়েদের নাচ শেখান অনুশ্রী। অনুশ্রীর নিজের নৃত্যগোষ্ঠী দমদম রিদমস্কেপ। রিদমস্কেপ-এর বিষয়টি ওই মাতৃভূমির বিপন্নতা নিয়েই। যে ভাবে আজ দূষণ, উষ্ণায়নের দাপটে ধ্বংস হতে বসেছে পৃথিবী, মানুষই তৈরি করেছে এমন বিপদ, আবার মানুষই পারে তার যত্ন, সহিষ্ণুতা আর ভালবাসা দিয়ে এই মায়াময় পৃথিবীকে বাঁচাতে। সংস্কৃতি ও যাপিত জীবনের নানা প্রসঙ্গ একাকার হয়ে আছে কলকাতায়। রবীন্দ্র সরোবর, নন্দন, পাবলিক হল, সাহিত্য একাডেমি ইত্যাদিতে উপচে পড়ছে নানা আয়োজন। তারপরও বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তার রেখা দেখেছি অনেকের কপালে। হিন্দি ও ইংরেজির দাপটে বাংলা ম্রিয়মান হচ্ছে বলে আশংকাও করছেন অনেকে। তারপরও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি এবং বাঙালির আত্মার পাটাতন হয়ে কলকাতা বহমান গঙ্গা তীরে সতত স্থির আর চৈতন্যের আশা জাগানিয়া জনপদ।



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2u68Gf0
July 11, 2017 at 07:58AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top