শাহাজাদা এমরান ● ৭ আগষ্ট ২০১৭ , বিকাল প্রায় ৩টা ১৫ থেকে ২০ মিনিট হবে। আবিরকে নগরীর রানীর দিঘির পূর্ব পাড়ের সরোজ স্যারের কাছে দিয়ে সবে মাত্র কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে এলাম। উদ্দেশ্য আমাদের কুমিল্লা অফিসে যাওয়া। এমন সময় সেল ফোনটি বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়েই দেখলাম সাংবাদিক ওমর ফারুকী তাপস ভাইয়ের ফোন। হ্যালো বলতেই কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তাপস ভাই জানালেন এমরান, তোমার সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আমিন ভাই আর নেই। কিছুক্ষণ আগে তিনি কুমিল্লা মেডিকেল সেন্টারে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহে রাজেউন। তাপস ভাইয়ের কন্ঠটি আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত মনে হল। আমার পুরো শরীর যেন হীম শীতল হয়ে গেল। শিরা-উপশিরা বন্ধ হবার উপক্রম হলো। মনের অজান্তেই আঁখি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। নিজকে সামলিয়ে তাপস ভাইকে বললাম, আমি কুমিল্লা টাওয়ারে আসছি। তিনি জানালেন, তুমি কান্দিরপাড় থাক,আমি আসছি।
মিনিট দশের মধ্যে কুমিল্লা টাউন হল গেটের সামনে এলেন তাপস ভাই, এর কিছুক্ষণ পর এল সময় টিভির বাহার রায়হান ও ফটো সাংবাদিক এন কে রিপন। তাপস ভাই ও বাহার জানাল, সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক আমিন ভাইকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। এ বিষয়ে একুশে টিভির হুমায়ুন কবীর রনী ভাইয়ের সাথেও কথা হয়েছে বলে জানাল। আমি বললাম,শুধু শ্রদ্ধা কেন, প্রেস ক্লাবের মাঠে জানাজা হবে না কেন, প্রেস ক্লাব থেকে মাইকিং করা হবে কিনা। একই সাথে জানতে চাইলাম, আমি প্রেসক্লাবের যে কমিটির অর্থ সম্পাদক ছিলাম সেই কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল, প্রেস ক্লাবের কোন সাংবাদিক মারা গেল তার পরিবারকে সাথে সাথে ২০ হাজার টাকা দাফন কাফনের জন্য দেওয়া হবে। আজ আমিন ভাইকে দেওয়া হবে কিনা। বর্তমানে প্রেস ক্লাবের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এই দুই সাংবাদিক বন্ধু প্রায় অভিন্ন কন্ঠে জানাল, শ্রদ্ধা জানানোর সিদ্ধান্ত নিতেই কষ্ট হয়েছে, সময় বুঝতে হবে , এত কিছু করা যাবে না। আমি তাদের কথা মেনে নিয়ে সহকর্মীদের আমন্ত্রণ দিতে শুরু করলাম যে, আজ (সোমবার) সন্ধ্যা ৭টায় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক আমিন ভাইকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। কিন্ত মাত্র ৩০ মিনিটের মাথায় সাংবাদিক তাপস ভাই আমাকে ফোন করে জানাল , আমিন ভাইয়ের মরদেহ প্রেসক্লাবে নেওয়া যাবে না। শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হলো। জানতে চাইলাম, তাপস ভাই, একজন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সহকর্মীকে, যিনি কি না এই প্রেস ক্লাবেরই সহ সভাপতি এমনকি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন , প্রেস ক্লাবের যে মাঠটিতে তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের কথা, সেই মাঠটি উদ্ধারে যেই সাংবাদিকের ছিল অপরিসীম ভূমিকা আমরা কি সেই সাংবাদিককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারি না? আমার দীর্ঘ দিনের চলার সার্থী সাংবাদিক ওমর ফারুকী তাপস ভাই জানালেন, আমিন ভাইকে প্রেস ক্লাবে যাতে না নেওয়া হয় সেই জন্য বিশেষ মহলের নির্দেশ আছে। তোমাকে এর বেশি বলতে পারব না। আমি অবাক হয়ে গেলাম। যে সাংবাদিক আমৃত্য প্রেস ক্লাবের সাথে জড়িত ছিলেন, কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের প্রতিটি ধুলিকনার সাথে যার রয়েছে পেশাগত সম্পর্ক , সেই সাংবাদিককে শেষ বারের মত প্রিয় আঙিনায় নিয়ে যেতে পারব না। এই ব্যর্থতা কার ? এটা কি রাজনৈতিক কারণে হয়েছে , না, প্রশাসনিক কারণে না কি আমরা যারা নিজেদের সাংবাদিক নেতা বলে দাবি করি , সেই আমাদের পদলেহন মনোভাবের কারণে। তা আমি জানি না , জানতেও চাইনি সাংবাদিক বন্ধু ওমর ফারুকী তাপসের কাছে। আমিন ভাইয়ের প্রথম নামাজে জানায়ায় গর্জনখোলায় এসে আমিন ভাইকে প্রেস ক্লাবে না নিতে পারার দু:খ প্রকাশ করেছেন বর্তমান আহবায়ক কমিটির সদস্য হুমায়ুন কবীর রনীও।
সাংবাদিক আমিনুল হককে চিনি সেই ১৯৯৪ সাল থেকেই। এক সাথে অসংখ্য জায়গায় গিয়েছি। সংবাদ কভার করেছি। তার সাথে আমার সাংগঠনিক সম্পর্ক হয় ২০০৬ সালে। মোগলটুলির মানিক মিয়া কমিউিনিটি সেন্টারে কুমিল্লার প্রায় সকল সিনিয়র সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কুমিল্লা জেলা শাখার আমিন ভাই সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। আমাদের অভিষেক অনুষ্ঠান হয় কুমিল্লা টাউন হল মিলনায়তনে। সেই অনুষ্ঠানে আমার সঞ্চালনায় ও আমিন ভাইয়ের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান। আর বিশেষ অতিথি ছিলেন বর্তমান কুমিল্লার সদর আসনের মাননীয় এমপি ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মক্তিযোদ্ধা হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাহার ভাই বলেছিলেন, দীর্ঘ দিন পর কুমিল্লা শহরের কোন সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানে এত বেশি সংখ্যক সাংবাদিক উপস্থিত হয়েছে, যা দেখতে খুব ভাল লাগছে। এই জন্য সভাপতি আমিন ভাই ও সেক্রেটারি এমরানকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। এ কথা আজ উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, ওই সময়েও কুমিল্লায় আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে গ্রুপিং ছিল। কিন্তু সাংবাদিক আমিনুল হক সকল গ্রুপিংকে এক জায়গায় এনে সাংবাদিক সমিতির যে অভিষেক করতে সক্ষম হয়েছিল আজ পর্যন্ত সেই রেকর্ড কুমিল্লায় ভেঙেছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে না।
আমিনুল হক ছিলেন দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার কুমিল্লার ব্যুরো প্রধান। ছিলেন সাপ্তাহিক মেগোতির সম্পাদক ও প্রকাশক। রাজনীতির বাইরে সাংগঠনিকভাবে কাজ করেছেন সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। ছিলেন কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতিও। সাংবাদিক সমিতির সেক্রেটারি হিসেবে আমিন ভাইয়ের সাথে কাজ করেছি একাধারে ১১ বছর। কুমিল্লার অধিকাংশের বেশি সাংবাদিক ও তাদের পরিবার নিয়ে সোনারগাঁও, সফিপুর আনসার একাডেমী, ফেনী মুহুরী প্রজেক্ট ও সালবন বিহারে চারটি বার্ষিক বনভোজন করেছি। বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক এড.আহমেদ আলী, আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক নজরুল ইসলাম দুলাল, জাতীয় ভাবে পুরস্কার প্রাপ্ত হওয়ায় সাংবাদিক আবুল হাসানাত বাবুল ও ইয়াসমিন রীমাকে সংবর্ধনা দিয়েছি। অসংখ্যবার ইফতার পার্টি, ঈদ কার্ড করেছি। এই ১১ বছরে সাংবাদিক সমিতির ব্যানারে অনেক সামাজিক কাজ করেছি আমিনুল হকের নেতৃত্বে। কিন্তু কোন দিন আমার কাছে কোন হিসাব চায়নি। হিসাব দিতে গেলে বিরক্ত হয়ে বলেছে, শাহাজাদা এমরানের মত সাধারণ সম্পাদক সব সভাপতির ভাগ্যে জোটে না। সুতরাং অনুষ্ঠান করে তুমি যদি ঋণী হও আমাকে জানাবা। অবিশিষ্ট থাকলে বলার দরকার নেই। সর্বশেষ চলতি ্বছরের অর্থাৎ ২০১৭ সালের ঈদ উল ফিতরের ঈদ কার্ড করতে গিয়ে বললাম , আমিন ভাই ঈদ কার্ড করব, টাকা দেন। তিনি বললেন, আমি তো অসুস্থ। প্রচুর টাকা খরচ হচেছ। তবুও মান্নাকে দিয়ে কিছু পাঠাব। তিনি পাঠিয়েছিলেনও। সম্ভবত সেদিন রোজার ২৫কি ২৬ হবে। টাকা পেয়ে ফোন করে বললাম, আমিন ভাই, ঈদের পর সাংবাদিক সমিতির নতুন কমিটি করব। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি বললেন, এমরান, ঈদের পর তুমি আমার বাসায় আসবা। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য , ঈদ শেষ হয়েছে ঠিকই কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় আমার আর যাওয়া হয়নি। আমিন ভাইয়ের সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছে রোজার ২ দিন আগে, তার বাসায়।সেদিন প্রায় ২ ঘন্টা কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেদিন আমি বুঝতে পারিনি এটাই হবে আমিন ভাইয়ের সাথে আমার সর্বশেষ সাক্ষাত।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, পরোপকারী, বিনয়ী ব্যক্তি ছিলেন সাংবাদিক আমিনুল হক। সত্য কথা যত কঠিনই হোক না কেন তা তিনি মুখের উপর বলে দিতে পারতেন। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন, সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছেন। নি:সন্দেহে কুমিল্লার সাংবাদিক সমাজ তাদের এক ভাল বন্ধুকে হারিয়েছে । যার শূন্যস্থান সহজে পূরণ হবার নয়।
আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই সাংবাদিক আমিনুল হকের কাছে ক্ষমা চেয়ে। ক্ষমা করবেন আমিন ভাই। আমরা আপনার শেষ বিদায়টা প্রেস ক্লাবে নিয়ে সম্মানের সাথে দিতে পারলাম না। যেই প্রেস ক্লাবের একদিন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আপনি। আমরা এমনই তথাকথিত পদলেহনকারী সাংবাদিক নেতা হয়েছি যে, নিজের মেরুদ- সোজা করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের ভাগ্যেই বা আপনার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না তা হয়তো আপনি দেখবেন না, কিন্তু আপনার বিদেহী আত্মা নিশ্চয়ই তখন বসে থাকবে না। ভাল থাকেন আমিন ভাই। ওপারে মহান আল্লাহ আপনাকে ভাল রাখবেনই এই কামনায় আবারো যোগ্য ও প্রাপ্য সম্মান দিতে না পারার ব্যর্থতা স্বীকার করে শেষ করছি।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কুমিল্লা জেলা শাখা, কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি, দৈনিক মানবকন্ঠ ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের কুমিল্লা।
sahajadaamran@yahoo.com
০১৭১১-৩৮৮৩০৮
The post ‘ক্ষমা করবেন আমিন ভাই’ appeared first on Comillar Barta.
from Comillar Barta http://ift.tt/2vOxvO3
August 09, 2017 at 05:18PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন