বিয়ানীবাজারে ঐতিহাসিক নানকার দিবস পালিত

সুরমা টাইমস ডেস্ক:: সিলেটের বিয়ানীবাজারে যথাযথ মর্যাদায় ঐতিহাসিক নানকার দিবস পালিত হয়েছে।

শুক্রবার (১৮ আগস্ট) সকাল ১০টায় নানকার স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে ছয় শহীদ কৃষককে শ্রদ্ধা জানান সকল শ্রেণি পেশার মানুষ। পুষ্পার্ঘ অর্পণ শেষে বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ডের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এক আলোচনা সভা।

নানকার স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ অর্পণের পূর্বে শহিদ ছয় কৃষককে শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। স্মৃতি সৌধে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেন বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের পক্ষে চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান খান, বিয়ানীবাজার পৌরসভার পক্ষে মেয়র আব্দুস শুক্কুর, কাউন্সিলর আকছার আহমদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির বিয়ানীবাজার উপজেলা শাখার পক্ষে সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান, জেলা শাখার সদস্য সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার, উপজেলা শাখার সদস্য কাউন্সিলর আকছার আহমদ, বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ডের পক্ষ থেকে সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদের নেতৃত্বে সংগঠনের সদস্যবৃন্দ। এরপর একে এক উলুউরি নানকার সমাজকল্যাণ সংঘ, সানেশ্বর গ্রামবাসীসহ বিভিন্ন সংগঠনের ও সকল শ্রেণি পেশার মানুষ শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন।

পরে স্থানীয় সানেশ্বর বাজারে বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ড আয়োজিত আলোচনা সভায় কমান্ডের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আবিদ হোসেন জাবেদ’র পরিচালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান খান, প্রধান বক্তা ছিলেন পৌর মেয়র আব্দুস শুকুর, বিশেষ অতিথি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির বিয়ানীবাজার উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান, বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মুখলেছ উদ্দিন, তিলপারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এমাদ উদ্দিন, তিলপারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসলাম উদ্দিন।

আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বরদা প্রসাদ দাস, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি জেলা শাখার সদস্য সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার, পৌর কাউন্সিলর আকছার আহমদ, বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ডের সহ-সভাপতি শাহীন আহমদসহ অনেকই। এসময় বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট মানব সভ্যতার ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল এক নির্মম ইতিহাস। ১৯৩৭ সালের ঘৃণ্য নানকার প্রথা রদ ও জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে ওইদিন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার সানেশ্বর উলুউরি গ্রামের সুনাই নদীর তীরে পাকিস্তান ইপিআরের ছোড়া গুলিতে প্রাণ দেন ব্রজনাথ দাস (৫০), কুটুমনি দাস (৪৭), প্রসন্ন কুমার দাস (৫০), পবিত্র কুমার দাস (৪৫) ও অমূল্য কুমার দাস (১৭) নামের পাঁচজন কৃষক।

উর্দু-ফার্সি শব্দ নান-এর বাংলা প্রতি শব্দ রুটি। আর রুটি বা ভাতের বিনিময়ে যারা কাজ করতেন তাদেরকে বলা হতো নানকার প্রজা। তাই নানকার আন্দোলন নামেই এটি দেশবাসীর কাছে পরিচিত।

১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্টের প্রায় ১৫ দিন আগে সানেশ্বরে সুনাই নদীর বুকে জমিদারের লাঠিয়ালদের হাতে শহিদ হন রজনী দাস। এ নিয়ে নানকার আন্দোলনে মোট শহিদের সংখ্যা হয় ছয়জন। তাদের এই আত্মত্যাগের ফলেই ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি ব্যবস্থা বাতিল ও নানকার প্রথা রদ করে কৃষকদের জমির মালিকানার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তাই বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে, বিশেষ করে অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল গৌরবান্বিত আন্দোলন বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষক বিদ্রোহ বা নানকার আন্দোলন।

ব্রিটিশ আমলে সামন্তবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে নিকৃষ্ট শোষণ পদ্ধতি ছিল এই নানকার প্রথা। নানকার প্রজারা জমিদারের দেয়া বাড়ি ও সামান্য কৃষি জমি ভোগ করতেন, কিন্তু ওই জমি বা বাড়ির উপর তাদের মালিকানা ছিল না। তারা বিনা মজুরিতে জমিদার বাড়িতে বেগার খাটতো। পান থেকে চুন খসলেই তাদের উপর চলতো অমানুষিক নির্যাতন।

নানকার আন্দোলনের সংগঠক কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের দেয়া তথ্যমতে, সে সময় বৃহত্তর সিলেটের ৩০ লাখ জনসংখ্যার ১০ ভাগ ছিল নানকার এবং নানকার প্রথা মূলত বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বৃহত্তর সিলেট জেলায় চালু ছিল। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির সহযোগিতায় বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বড়লেখা, কুলাউড়া, বালাগঞ্জ, ধর্মপাশা থানায় নানকার আন্দোলন গড়ে ওঠে।

ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহের সূতিকাগার ছিল বিয়ানীবাজার উপজেলা। সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিয়ানীবাজার অঞ্চলের নানকার কৃষকরা সর্বপ্রথম বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

১৯৯০ সালে নানকার আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে সুনাই নদীর তীরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য স্থানীয় জনগণের দেয়া জমিতে স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন নানকার স্মৃতি রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সে সময় স্মৃতিসৌধ পূর্ণতা না পেলেও দীর্ঘ ৬০ বছর পর ২১ আগস্ট ২০০৯ সালে বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ডের উদ্যোগে স্থানীয় ও প্রবাসীদের সহযোগিতায় নির্মিত স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।



from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2xbyLY6

August 18, 2017 at 11:05PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top