বাঙালি পরিচালকদের মধ্যে ঋত্বিক ঘটকই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন দেশভাগ দ্বারা। তার চলচ্চিত্রে দেশভাগ এবং এ বিভাজন থেকে উদ্ভূত বেদনা আর উদ্বাস্তু হওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনী যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, দুই বাংলায় আর কোনো পরিচালকের কাজেই তার প্রতিফলন ততটা নেই। ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভ একই সঙ্গে ছিল সম্পর্ক ছাড়ান-কাটন হয়ে যাওয়ার ইতিহাসও: স্বাধীনতার কারণে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে গেল ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে, কিন্তু এ বিভাজন ভারতবর্ষের অন্য অংশে যেভাবে অনুভূত হয়েছে পাঞ্জাব আর বাংলার জন্য তা কখনই একই রকম ছিল না। এই দুই প্রদেশ ভারতের উত্তর আর পশ্চিম সীমান্তে বিভক্তির কবলে পড়ে। এই দুই অংশের সাধারণ মানুষ ভারত ভাগকে কখনই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি, ভারত ভাগের কারণে এ দুই অংশের অগুনতি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়। তবে ভারত ভাগের এ মর্মন্তুদ প্রভাব তখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান হয়নি, দেশ ভাগ নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে নারায়ণ স্যান্নালের বকুলতলা পি.এল, ক্যাম্প। তবে বাংলা চলচ্চিত্র সাড়া দেয় আরেকটু আগে, ১৯৫০ সালে, নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল ছবি দিয়ে। চলচ্চিত্রের বাস্তবমুখী বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত এ চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায় দেশভাগের কারণে পূর্ববঙ্গ থেকে উত্খাত হওয়া একদল কৃষক উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় এসেছে আশ্রয়ের সন্ধানে। নিমাই ঘোষ তার ছবিতে মঞ্চের ঝানু কিছু অভিনেতাদের পাশাপাশি সত্যিকারের উদ্বাস্তুদেরকেও ছবির শরণার্থী হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ছবির অতিরিক্তদেরকেও নেয়া হয়েছিল পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকেই। আর মঞ্চাভিজ্ঞতা থাকলেও উদ্বাস্তু অভিনেতাদের একজন ছিলেন ঋত্বিক ঘটক, পরে যিনি দ্রুতই পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং দেশভাগের বিষয়টিকে তার চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য করে নেন। দেশ ভাগের যন্ত্রণা উদ্বাস্তু জীবন ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রেই সবচেয়ে জোরালোভাবে হাজির হয়েছে। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্যে বরাবর আস্থা রেখে গেছেন ঋত্বিক। দেশভাগ কখনই তিনি মেনে নিতে পারেননি। ফলে এ বিষয়ে তিনি প্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন সারা জীবন। ২৫ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে, ১৯৭৬ সালে ৫০ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে ঋত্বিক মোট চলচ্চিত্র রেখে গেছেন আটটি, বাকি ১০টি প্রামাণ্য ছবি আর গোটাকয় অসমাপ্ত কাজ। কিন্তু তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্যই। তবে আজকের চিরস্মরণীয় কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া ঋত্বিকের স্বীকৃতি মিলেছিল কিন্তু অনেক পরে; সূচনায়, তার জীবদ্দশায় বাঙালি চলচ্চিত্র দর্শক, বোদ্ধা তাকে শুধু উপেক্ষাই করে গেছেন। ঋত্বিকের মতো একজন সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্র পরিচালকের জন্য এটা সত্যিকার অর্থেই ছিল দুর্ভাগ্যজনক; ঋত্বিক তার চলচ্চিত্রে যেভাবে নতুন ঘরানা, বাস্তবতা, পুরান আর নাটকীয়তার সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন, তা গোটা ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের জন্যই ছিল অভূতপূর্ব। চলচ্চিত্রে নাম লেখানোর আগে ঋত্বিক জড়িত ছিলেন ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে, যা ছিল মূলত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিরই একটি সাংস্কৃতিক শাখা, ১৯৪৩ সাল থেকেই শিল্প-সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এসেছে এ সংগঠন। তখনকার নাম করা সব শিল্পী-সাহিত্যিকই জড়িত ছিলেন এ সংগঠনের সঙ্গে। ঋত্বিকের ওপর ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটারের প্রভাব ছিল গভীর। একজন সাংস্কৃতিক কর্মীর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন ঋত্বিক, চলচ্চিত্রের জন্য মঞ্চকে ছেড়ে এলেও তিনি প্রতিটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন কোনো না কোনো সামাজিক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। চলচ্চিত্র তার কাছে ছিল এক ধরনের সংগ্রামের হাতিয়ার। তার সময়ের অন্য যেকোনো শিল্পীর চেয়ে তার মধ্যে এ বিশ্বাস ছিল সবচেয়ে প্রবল। ভারতবর্ষের সমসাময়িক যেকোনো বিষয়কে তুলে ধরার জন্য তিনি চলচ্চিত্র মাধ্যমকে সবচেয়ে সফলভাবে ব্যবহার করেছেন দেশ ভাগ ও এর পরিণাম। একবার তিনি বলেছিলেন: সিনেমা, আমার কাছে, আমার মানুষের দুঃখ-কষ্ট আর বেদনার বিরুদ্ধে রাগ প্রকাশের হাতিয়ার। পূর্ব বাংলা থেকে আসা একজন বাঙালি হওয়ায় স্বাধীনতার নামে আমার মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট আমি দেখেছি ওই স্বাধীনতা প্রবঞ্চনা, ভাঁওতা। আমি চরমভাবে এর বিরুদ্ধাচরণ করেছি এবং আমার চলচ্চিত্রে একে আমি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ঘটক উদ্বাস্তু সমস্যা কখনই মানতে চাননি। তিনি তার এক সাক্ষাত্কারে একবার বলেন: আমি উদ্বাস্তু সমস্যাকে মোকাবেলা করেছি, তোমরা যাকে রিফিউজি বলো, আমার কাছে তা একটা সাংস্কৃতিক বিভাজন, আমি তীব্রভাবে আঘাত পেয়েছি এতে। এই আঘাত থেকেই জন্ম নিয়েছে তার দেশভাগের ত্রয়ী উপাখ্যান: মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২)। বাংলাদেশের ভিটেমাটিহারা শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের উত্কণ্ঠা, নিরাপত্তাহীনতা ঘটকের এ ত্রয়ীর মূল বিষয়, ঋত্বিক দেখাতে চেয়েছেন কীভাবে দেশভাগ বাঙালির সংস্কৃতির মর্মমূলে আঘাত হেনেছে; যার উপজাত হিসেবে তার ছবির চরিত্ররা আক্রান্ত সীমাহীন বিষাদ আর স্মৃতিবিধুরতায়। পেছনে ফেলে আসা জন্মভূমিকে তারা কোনোদিনই ভুলতে পারেননি। মেঘে ঢাকা তারা, শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাস থেকে করা, মূল উপন্যাসের নামটিই চলচ্চিত্রে হুবুহু ব্যবহার করা হয়েছে। সমালোচকদের মতে দেশভাগ নিয়ে এটা ঘটকের সেরা কাজ। আর এটাই ঋত্বিকের একমাত্র ছবি, যা মুক্তির পর পরই বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। নীতা (সুপ্রিয়া চৌধুরী) নামের এক মেয়েকে ঘিরে ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে, কলকাতার বস্তির এক উদ্বাস্তু, যে সংগ্রাম করছে পূর্ব বাংলা থেকে আসা তার নিঃস্ব পরিবারটির ভরণ-পোষণে। প্রথম দিকে, নীতা স্কুলের শিশুদের প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালায়; তার পর বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থার আরো অবনতি হলে এক অফিসে পূর্ণকালীন এক চাকরিতে যোগ দেয়; যার কারণে তার স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনায় ইতি পড়ে যায়। নীতা এক উদ্বাস্তু পরিবারের শোষিত মেয়ের নাম, এক নিশ্চিত ত্রাণকারী আর বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকা শেষ পর্যন্ত তার পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় শুধু পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। সে শুধু দেশভাগের বলিই না, পরিবার নামের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জগদ্দল নিষ্পেষণেরও শিকার, যার জীবন শেষ হয় যক্ষ্মার মতো অনিরাময়যোগ্য রোগের বিরুদ্ধে অসম এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তবে এই লড়াইয়ের কথাও ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত অনুচ্চারিতই থেকে যায়: তখন নীতা বাঁচতে চায়, তখন নীতা স্বীকারোক্তি দেয় অন্যায়কে মেনে নিয়ে সে ভুল করেছে, তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। কোমল গান্ধার, এই ছবির গল্প ১৯৫০ সময়কালের বাংলা মঞ্চনাটক ঘিরে চলা আন্দোলন কেন্দ্র করে, যার পটভূমি দেশভাগের স্মৃতি, বিভক্ত নাট্যকর্মী, সংগঠন, নেতৃত্ব। কিন্তু ঋত্বিকের দর্শক এ জটিল মনস্তাত্ত্বিক ছবির জন্য তখনো তৈরি ছিল না। ফলে দর্শক কর্তৃক পুরোই প্রত্যাখ্যাত হয় ছবিটি। সুবর্ণরেখা, আবারো এ ছবির কেন্দ্রমূলে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শরণার্থী আর দুই ভাইবোন। সচ্ছল উন্নত জীবনের আশায় তারা কলকাতার উদ্বাস্তু শিবির ছেড়ে ছাতিমপুর নামের এক পাহাড়ি অঞ্চলে লোহা কারখানায় চাকরি নিয়ে চলে এসেছে। কিন্তু কোনো স্বপ্নই সহজে ধরা দেয় না। ঋত্বিকের ছবির নায়িকারা বরাবরই বঞ্চিত-লাঞ্ছিত। এ ছবির বোন অনুসূয়াও মেঘে ঢাকা তারার নীতার প্রতিভূ, দুর্ভাগা আর দুঃখী। নীতা, সীতা আর অনুসূয়া, ঘটকের দেশভাগের ছবির তিন নায়িকা। তার সময়ের রক্ত-মাংসের নারী, কিন্তু ঋত্বিক তাদের দুঃখ-কষ্ট আর সংগ্রামকে সর্বকালীন এক গল্পে রূপান্তরিত করেছেন। তারা একই সঙ্গে মহাভারতের দুর্গা, সীতা আর শকুন্তলা। ঋত্বিকের মৃত্যুর চার দশকের বেশি সময় পার হয়ে গেছে, কিন্তু দেশভাগ নিয়ে দুই বঙ্গের কোনো পরিচালকই ততটা মনোযোগী হননি। তাদের বেশির ভাগ কাজেই দেশভাগ অনুপস্থিত। তবে কয়েক বছর ধরে সামান্য কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে কলকাতায়: ২০১৩ সালে ঋত্বিকের জীবনভিত্তিক ছবি বানিয়েছেন কমলেশ্বর মুখার্জি। ঋত্বিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শাশ্বত চ্যাটার্জি। ২০১৫ সালে সৃজিত মুখার্জি বানিয়েছেন রাজকাহিনী। ঋত্বিকের জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায়, ৪ নভেম্বর ১৯২৫ সালে। আর/১২:১৪/২৩ আগষ্ট
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2xpCy4q
August 23, 2017 at 07:15AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন