নিউ ইয়র্ক, ২৬ আগষ্ট- নিউইয়র্ক নগরীর এমটিএ বা মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির সাবওয়েতে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে এই সংখ্যা প্রায় ৯০০। তাঁরা স্টেশন এজেন্ট থেকে শুরু করে এমটিএর সুপারভাইজর, এমনকি উচ্চপদস্থ সুপারিনটেনডেন্ট পদেও যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছেন। এমটিএর মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় কাজ করাকে প্রবাসীরা যথেষ্ট সম্মানজনক বলে মনে করেন। এ জন্য দেখা গেছে, কোনো কোনো বাংলাদেশি পরিবারের মা-ছেলে, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, এমনকি একই পরিবারের তিন ভাই এমটিএতে চাকরি করছেন। জ্যাকসন হাইটসের রুজভেল্ট অ্যাভিনিউর সাবওয়ে স্টেশনে এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন বগুড়ার সন্তান কে এ আজগার। টেলিফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ১৯৯৮ সালে আমেরিকায় আসেন। বিভিন্ন পেশায় কাজ করার পর ২০০৮ সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৪ সালে এমটিএতে যোগ দেন। ২০১১ সালে এই চাকরি নেওয়ার জন্য ডাকা হলেও অন্যত্র চুক্তিবদ্ধ থাকায় তিনি এমটিএতে যোগ দিতে পারেননি। এমটিএর বিভিন্ন সুবিধা সম্পর্কে আজগার বলেন, শুরুতেই প্রতি ঘণ্টার বেতন ২১ ডলার। প্রতিবছর বেতন বাড়তে থাকে। বর্তমানে তিনি প্রতি ঘণ্টায় পান ৩১ দশমিক ৫০ ডলার। এমটিএর সব কর্মীই সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে ৪২ দশমিক ১৫ ঘণ্টার বেতন পেয়ে থাকেন। ওভারটাইম (বাড়তি সময়) কাজের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। ওভারটাইম কাজ করলে দেড় গুণ বেতন দেওয়া হয়। আজগার বলেন, প্রত্যেক কর্মী অসুস্থ না হয়েও প্রতি মাসে এক দিন অসুস্থজনিত ছুটি পেয়ে থাকেন। দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকলেও তিনি ওই দিনের বেতন পান। অসুস্থজনিত মাসে এক দিন ছুটি না নিলে বছরের শেষে অথবা অবসর নেওয়ার সময় এসব দিনের বেতন পাবেন। তবে সরকারি ছুটির দিনে কাজ করা বাধ্যতামূলক এবং ওই দিনের বেতন দেড় গুণ দেওয়া হয়। কিন্তু এই সরকারি ছুটি পরে যেকোনো সময় ভোগ করা যায়। আমেরিকার অন্য কোনো সংস্থায় এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেই বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, প্রত্যেক কর্মী তাঁর জন্মদিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেতনসহ ছুটি পান। এমনকি জন্মদিবসে কর্তৃপক্ষকে জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তাদের কাছে তো জন্ম তারিখ লেখাই আছে। তিনি বলেন, কোনো পরিবারের একজন এমটিএতে কাজ করলে পরিবারের সব সদস্যই পুরো স্বাস্থ্যবিমা ভোগ করে। এমনকি কোনো চিকিৎসকের সুপারিশ ছাড়াই তারা যেকোনো হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পেয়ে থাকে। আজগার বলেন, পদোন্নতিমূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পরবর্তী উচ্চতর পদে উত্তীর্ণ হওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এবং ইতিমধ্যে বহু বাংলাদেশি এ ধরনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদের অধিকারী হয়েছেন। তিনি নিজেও পরীক্ষা দিয়ে সুপারভাইজার পদে উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং যেকোনো সময় তিনি সেই পদ পেয়ে যাবেন। কথা হয় বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার বাসিন্দা তারেক আহমেদের সঙ্গে। তিনি স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৯৮ সালে আমেরিকায় আসেন। তিনি ২০০৫ সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৬ সোলে এমটিএর সাবওয়ে এজেন্ট হিসেবে এই চাকরিতে যোগ দেন। এমটিএতে কর্মরত বাংলাদেশিদের সংঘবদ্ধ করার জন্য তারেক আহমেদ বাংলাদেশি আমেরিকান এমটিএ ওয়ার্কার্স নামে একটি অনানুষ্ঠানিক সংগঠন গঠন করেন। সাউথ এশিয়ান নাম থাকলেও এটা পুরোপুরি বাংলাদেশি এমটিএ কর্মীদের সংগঠন। তিনি সরাসরি ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। তিনি এই সংস্থার নীতিনির্ধারক নির্বাহী বোর্ডের নির্বাচিত সদস্য। তিনি বলেন, সাবওয়ের সব শাখার সব কর্মচারী, কর্মকর্তা তথা জেনারেল সুপারিনটেনডেন্ট, সুপারিনটেনডেন্ট, সুপারভাইোর, স্টেশন এজেন্ট, রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী, সাবওয়ে ক্লিনার ও বাসচালকেরা পরিবহন কর্মচারী সমিতির সদস্য। তারেক আহমেদ বলেন, নিউইয়র্ক সিটির সাবওয়েতে ২ হাজার ৮২২ জন স্টেশন এজেন্ট রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৪০০ জন বাংলাদেশি। অন্যদিকে এমটিএর সব শাখার কর্মচারী-কর্মকর্তার সর্বমোট সংখ্যা ৩৮ হাজার। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় ৯০০। তিনি বলেন, এটা আমাদের জন্য গৌরবের ব্যাপার। আমরা অনেক পরে এসেও কেবল যোগ্যতার কারণে আমাদের প্রতিনিধিত্ব অনেক দেশের চেয়ে অনেক বেশি। তারেক আহমেদ বলেন, প্রতি চার বছর পর পর এমটিএতে স্টেশন এজেন্ট পদে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়। প্রায় ২৫ হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে মাত্র ৯০০ জন নিয়োগের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হন। মেধার ক্রমানুসারে যোগদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়। তিনি বলেন, মেধায় বাংলাদেশিরা অন্যদের চেয়ে অগ্রসর বলেই আমাদের প্রতিনিধিত্ব প্রতিবারই বাড়ছে। মেধা ও যোগ্যতার কারণেই বহু স্টেশন এজেন্ট প্রমোশন পেয়ে বহু বাংলাদেশি ট্রেনচালক, কন্ডাক্টর, ৩০ জন সুপারভাইজার, এমনকি একজন নারীসহ তিনজন সুপারিনটেনডেন্ট পদে রয়েছেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশিদের এই জয়যাত্রা আগামী দিনগুলোতে আরও বেগবান হবে। সুযোগ-সুবিধা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিন বছর চাকরি করার পর প্রতিবছর বেতনসহ চার সপ্তাহ এোধারে ছুটি ভোগের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে কোনো ধরনের বোনাসের ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যবিমা ছাড়া সন্তানদের জন্য অন্য কোনো সুবিধা আছে কি না, জানতে চাইল তারেক আহমেদ বলেন, প্রতিবছর উন্মুক্ত লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী সন্তানদের মধ্যে ৫০ জনকে ১ হাজার ডলার করে বৃত্তি দেওয়া হয়। কোনো কোনো শিক্ষার্থী একাধিকবার লটারিতে বিজয়ী হলেও তাকে ওই পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়ে থাকে। একই পরিবারের একাধিক সদস্য এবং আমেরিকায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও কেন অন্য কোনো সংস্থায়, এমনকি ফেডারেল সংস্থায় চাকরি না নিয়ে এমএটিতে আসছেন জানতে চাইলে তারেক আহমেদ বললেন, এই সংস্থায় আমাদের উচ্চহারে বেতন এবং বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, যা অন্য সংস্থায়, এমনকি ফেডারেল সরকারের অধীন সংস্থায়ও নেই। তাই এই সংস্থায় পিএইচডি ডিগ্রি আছে এমন লোকজনও কাজ করেন। তারেক আহমেদ বলেন, একই কারণে কোনো কোনো বাংলাদেশি পরিবারের তিন ভাই, মা-ছেলে, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এমটিএতে চাকরি করছেন। তারেক আহমেদ বলেন, এমটিএর সব বাংলাদেশি কর্মীই আর্থিকভাবে সফল। প্রায় সবাই বাড়ির মালিক। এমটিএর সাবওয়েতে তিনজন বাংলাদেশি সুপারিনটেনডেন্টের একজন হলেন মোহাম্মদ এখলাছুর রহমান। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করে ১৯৮৭ সালে তিনি ভ্রমণকারী হিসেবে আমেরিকায় আসেন। তিনি বলেন, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার থেকে শুরু করে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি বর্তমান অবস্থানে পৌঁছান। ১৯৯৮ সালে তিনি স্টেশন এজেন্ট হিসেবে এমটিএতে যোগ দেন। স্টেশন এজেন্ট হিসেবে সাত বছর কাজ করার পর পদোন্নতিমূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এমটিএর সুপারভাইজার হন। এই পদে ১০ বছর দায়িত্ব পালন করে মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে দুই বছর আগে এমটিএর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ সুপারিনটেনডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। এখলাছুর রহমান বলেন, সুপারভাইোর হওয়ার পরের পদগুলোতে যাওয়া অতীব কঠিন। এসব পদের জন্য কোনো লিখিত পরীক্ষা হয় না। প্রার্থীর অতীত কর্মকাণ্ড, যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, সততা, নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয় যাচাই-বাছাই করেই পদোন্নতি হয়। এখলাছুর রহমান বলেন, পুরো এমটিএতে ৪৫ থেকে ৫০ জন সুপারিনটেনডেন্ট রয়েছেন। এমটিএর স্টেশন শাখা চারটি ডিস্ট্রিক্ট বা বিভাগে বিভক্ত। আবার প্রতিটি বিভাগ ১০ জোনে বিভক্ত। প্রতিটি জোনে একজন করে সুপারিনটেনডেন্ট রয়েছেন। এমটিএ চাকরির প্রশংসা করে এখলাছুর রহমান বলেন, এটা সিভিল সার্ভিস জব। ভালো বেতন, স্বাস্থ্যবিমা, ছুটি, চাকরির নিশ্চয়তাসব মিলিয়ে এমটিএর চাকরি সৌভাগ্যের প্রতীকবিশেষ। তিনি বলেন, এখানে কোনো বর্ণবৈষম্য বা জাতিগত বিদ্বেষ নেই। কোনো বয়সসীমা নেই। যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলে যে কেউ যেকোনো বয়সে এমটিএর চাকরি পেতে পারেন। নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে এখলাছুর রহমান বলেন, এই বিভাগে চাকরি পেয়ে বাংলাদেশি হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। এমটিএতে কেউ আমার জাতীয়তা জানতে চাইলে গর্বের সঙ্গে বলি: আমি বাংলাদেশি। এখলাছুর রহমান বলেন, এমটিএতে বাংলাদেশিদের মর্যাদার চোখে দেখা হয়। আমাদের বেশ সুনাম রয়েছে। আমরা সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করি। ভালো কাজ করি। সবার সঙ্গে আমরা ভালো আচরণ করি। এ কারণে আমরা এমটিএতে তাড়াতাড়ি অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছি। প্রচুর বাংলাদেশি বর্তমানে এমটিএতে রয়েছেন। প্রতিবারই বিভিন্ন পদে বাংলাদেশিরা ঢুকছেন। আমেরিকায় বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের ব্যাপারে মন্তব্য জানতে এখলাছুর রহমান বলেন, আমাদের নতুন প্রজন্ম আমেরিকায় খুবই ভালো করছে। তারা যোগ্যতা প্রদর্শন করে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আমার দুই ছেলেই স্পেশালাইজ্ড স্কুলে লেখাপড়া করেছে। বড় ছেলে মনোবিজ্ঞানে এবং ছোট ছেলে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে অধ্যয়ন করছে। আমার সন্তান ছাড়াও অসংখ্য নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি একই ধরনের পারদর্শিতা দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। তাদের জন্য আমরা গর্বিত। আমার বিশ্বাস তারা আমার চেয়েও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে যাবে আর বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2w7wsYM
August 27, 2017 at 05:20AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন