তার আগমন ঘটেছিল এক হঠাৎ আবির্ভূত ধূমকেতুর মত। প্রকৃতি প্রদত্ত দেহসৌষ্ঠব, আবেদনময়ী চেহারা ও ঝর্নার পানিতে ভিজে যাওয়া সাদা শাড়িতে নাচ- মন্দাকিনীর কথা উঠলে আশির দশকের যেকোনো বলিউড ভক্তের এই তিনটি কথা মাথায় আসতে বাধ্য। নিজের প্রথম ছবি দিয়েই অসংখ্য যুবকের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়া মন্দাকিনীর বলিউড ক্যারিয়ার উজ্জ্বলই ঠেকেছিল সবার কাছে। অভিনয় প্রতিভা যেমনই হোক, অন্তত যৌন আবেদনের দিক থেকে মন্দাকিনীকে আটকানো যাবে না, এমনটাই ধারণা ছিল সবার। কিন্তু সেই মন্দাকিনীই পরে হারিয়ে গেলেন রুপালি জগত থেকে। মন্দাকিনীর এমন দ্রুত উত্থানের চেয়েও দ্রুততম পতনের সাথে জড়িয়ে আছে মাফিয়া কিং দাউদ ইব্রাহিমের নাম। কিভাবে মন্দাকিনীর সাথে জড়াল দাউদের নাম, কেনই বা হারিয়ে গেলেন মন্দাকিনী- এসব নিয়েই আজকের আয়োজন। ভারতের উত্তর প্রদেশের মিরুত এ এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে জন্ম ইয়াসমিন জোসেফ এর। তারপর বেড়ে ওঠা দক্ষিণ মুম্বাইয়ের অ্যান্টপ হিলে। পিতা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, মা মুসলিম। এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার থেকে উঠে এসেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে বলিউড কাঁপিয়ে দেন ইয়াসমিন জোসেফ, রুপালি জগতে যার নাম দাঁড়ায় মন্দাকিনী। তারকা নির্মাতা রাজ কাপুর তার ছোট ছেলে নবাগত রাজীব কাপুরের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে মন্দাকিনীকে কাস্ট করেন রাম তেরি গঙ্গা মাইলি ছবিতে। ঝর্নার পানিতে ভিজে সাদা শাড়িতে নাচ আর শিশুকে স্তন্যদানের দৃশ্য- এই দুইটি সীন দিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলেন মন্দাকিনী। রাতারাতি বলিউডের টক অফ দ্য টপিক এ পরিণত হন তিনি। এই এক ছবির সাফল্য দিয়েই অনিল কাপুর, গোবিন্দ, সঞ্জয় দত্ত, মিঠুন চক্রবর্তীদের মত তারকাদের বিপক্ষে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান মন্দাকিনী। চলচ্চিত্র নির্মাতারা তার অভিনয় দক্ষতার জন্য না, বরং তার দেহ সৌন্দর্যের আরও ফায়দা তোলার জন্যই তাকে কাস্ট করতে শুরু করেন। নিজের দেহ দেখিয়ে একের পর এক ছবি সাইন করছিলেন মন্দাকিনী, আর নির্মাতারা ভরাচ্ছিলেন তাদের পকেট। কেবল মন্দাকিনীকে দেখার জন্যই যুবকেরা ভিড় জমাতে লাগল সিনেমা হলে। মন্দাকিনীকেও তরুণদের কাঙ্ক্ষিত রূপে পর্দায় হাজির করতে লাগলেন নির্মাতারা। মিঠুন চক্রবর্তীর সাথে পরম ধর্ম আর অনিল কাপুরের সাথে তেজাব ছবিতে মন্দাকিনীকে উপস্থাপন করা হয় বিকিনিতে। সবকিছু ভালই চলছিল মন্দাকিনীর, কিন্তু তার জীবন ওলট পালট করে দেয় ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত একটি ছবি। ছবিটি যার তার সাথে তোলা কোন ছবি ছিল না, বরং স্বয়ং মাফিয়া সম্রাট দাউদ ইব্রাহিমের সাথে তোলা একটি ছবি, যেটিতে দাউদ ও মন্দাকিনীকে বেশ ঘনিষ্ঠ রূপে আবিষ্কার করে ভক্তরা। অন্য কোন সময় হলে হয়তো ছবিটি এতটা মাথাব্যথার কারণ হত না মন্দাকিনীর জন্য। কারণ নব্বই দশকের শুরুতে খ্যাতনামা বলিউড তারকাদের সাথে দাউদ ইব্রাহিমের ছবি তোলার একটা অলিখিত চল ছিল। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ভয়াবহ মুম্বাই হামলার পর ভারত জুড়ে দাউদের বিপক্ষে তীব্র ঘৃণা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। আর ঠিক সেসময় এমন একটি ঘনিষ্ঠ ছবি ছাপা হওয়ার পর জনমনে দাউদ ও মন্দাকিনীর সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষার জন্ম হয়। এমনকি মন্দাকিনীকে দাউদের রক্ষিতা হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয় কোথাও কোথাও! ঝলমলে জীবনে কলঙ্কের দাগ পরে যায় মদাকিনীর। পুলিশ সাংবাদিক মিলে তার ব্যক্তিগত জীবনকে একপ্রকার নরক বানিয়ে তোলে। এতসব কানাঘুষার মাঝে পুলিশ আবিষ্কার করে আরেক চমকপ্রদ তথ্য, যার ফলে মন্দাকিনীর ক্যারিয়ারে একপ্রকার যতিচিহ্ন পরে যায়। মুম্বাই পুলিশ তখন দাউদকে ধরার জন্য মরিয়া, দেশের ভেতর যেখানে দাউদের যত সম্পত্তি আছে, সবকিছু রেইড করতে শুরু করে তারা। এমন সময় মুম্বাই পুলিশের কাছে খবর আসে ব্যাঙ্গালোরের উপকণ্ঠে দাউদের অর্থায়নে একটি বিশাল বাগানবাড়ি তৈরি হচ্ছে। মুম্বাই পুলিশের অনুরোধে ব্যাঙ্গালোর পুলিশ সেখানে হানা দিয়ে জানতে পারে, নির্মাণাধীন সম্পত্তির মালিকানা লেখা মন্দাকিনীর নামে! এই খবর চাউর হতে মোটেও সময় লাগল না। পত্রিকাগুলোর হট টপিক হয়ে উঠে দাউদ মন্দাকিনীর সম্পর্ক। বিনোদন পাতায় আসতে থাকে একের পর এক প্রশ্ন। কি সম্পর্ক দাউদ ও মন্দাকিনীর মধ্যে? কিভাবে দাউদের সাথে জড়ালেন মন্দাকিনী? অন্য কোন নায়িকাকেও কি এমন ফাঁদে ফেলেছেন দাউদ? এরকম হাজারো প্রশ্ন ছুটে আসতে থাকে। আত্মরক্ষার্থে মন্দাকিনী তখন বোরকা পরে বাইরে বেরোয়। প্রশ্ন উঠে সেটা নিয়েও। মন্দাকিনী কেন ব্যাঙ্গালোরে একাকী নির্বাসনে থাকে, কেন সে বোরকা পরে, এরকম অজস্র প্রশ্নের উৎপত্তি ঘটায় পত্রিকাগুলো। এদিকে মন্দাকিনী পরে যায় ফ্যাসাদে। সে বারবার জানায় দাউদের সাথে তার কোন প্রকার সম্পর্ক নেই। দাউদের সাথে কোন প্রকার প্রেমের সম্পর্ক নেই বলেও জানায় সে। কিন্তু পুলিশের হাতে তথ্য প্রমাণ থাকায় মন্দাকিনীকে পুলিশি হেফাজতে নেয়া হয়। মন্দাকিনীর জীবনে তখন আরও ঝড় আসছিল বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু খুবই আশ্চর্যজনকভাবে মন্দাকিনীকে বেকসুর খালাস দিয়ে দেয় মুম্বাই পুলিশ। কোন প্রকার কারণ দর্শানো হয়নি, তাকে আর কোন জেরাও করা হয়নি। এখানেও পাওয়া যায় আরেক রহস্যের গন্ধ। মন্দাকিনীকে পুলিশ এমনি এমনি ছেড়ে দিল কেন? এখানেও কি ভেতর থেকে কলকাঠি নেড়েছেন দাউদ ইব্রাহিম? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন থাকলেও উত্তর মেলেনি তার কোনটিরই। মন্দাকিনী ছাড়া পায়, কিন্তু তার ক্যারিয়ার আর গতি পায় না। ১৯৯৫ সালে করা জোরদার ছবিটিই তাই হয়ে যায় তার শেষ ছবি। এরপর ঘটে আরেক ঘটনা। ১৯৯৫ সালেই খবর বের হয় মন্দাকিনী গর্ভবতী। মন্দাকিনী যতই বলুক এই সন্তান দাউদের নয়, লোকমুখে এই সন্তান দাউদের বলেই পরিচয় পেয়ে যায়। লজ্জায় অপমানে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পরে মন্দাকিনী। এর কয়েক বছর পর খবর আসে, জীবনে শান্তি খুঁজে পেতে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন মন্দাকিনী। দালাই লামার এক অনুসারীর সাথে বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হন মন্দাকিনী। একসময়কার পর্দা কাঁপানো মন্দাকিনী এখন জীবন কাটাচ্ছেন তিব্বতী যোগব্যয়াম শিখিয়ে।
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2ufeDYc
August 06, 2017 at 09:10PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন