লিপি রানী সাহা ● কুমিল্লা থেকে ঢাকায় ফিরব। বিকেল পাঁচটার দিকে বিআরটিসি কাউন্টারে যাই। গিয়ে দেখি, আমিই একমাত্র যাত্রী। কয়েকটি গাড়ি ডিপোতে। একটি গাড়ির মেরামত চলছে। জানতে চাইলাম, গাড়ি কি যাবে?
জবাব বলল, ‘আপা অপেক্ষা করেন। ম্যানেজার আলাপ করছেন। জানাবেন।’
জানতে পারলাম, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট। ঢাকা থেকে প্রথম ট্রিপে সকাল সাতটায় যে গাড়িটি ছেড়েছে, তা বিকেল চারটায় পৌঁছেছে। শুনে তো হা। বলে কী! ২০০০ সাল থেকে পড়াশোনার খাতিরে ঢাকায় আসা। এরপর চাকরি। তাই বাড়ির টানে প্রায়ই কুমিল্লায় যাওয়া-আসা। কিন্তু এই রুটে এত দীর্ঘ যানজটের খবর কখনো পাইনি।
অপেক্ষা কক্ষে বসে ভাবছি—কী করব। এর মধ্যে এলেন আরও তিন যাত্রী। ফোন দিলাম আমাদের দাউদকান্দি প্রতিনিধিকে। জানালেন, প্রায় ২০ কিলোমিটার যানজট। কতক্ষণে স্বাভাবিক হবে, ঠিক নেই। ফোন রেখে কাউন্টারে জানতে চাইলাম, ‘ভাই, আপনাদের শেষ গাড়ি কখন?’
কাউন্টারের লোকটি হেসে বলল, ‘আপা, বসেন। আধা ঘণ্টা পর গাড়ি ছাড়বে। এটাই শেষ গাড়ি। কারণ, গতকাল বিকেলের গাড়ি গিয়ে রাত দুইটার দিকে ঢাকায় পৌঁছেছে।’
এ কথা শুনে আর বসিনি। রিকশা নিয়ে বাসা ফেরত। বাসায় ফেরার পর বাবা-মা বললেন, ‘কী রে, ফিরলি যে! মজা করে বললাম, তোমরা যে বললে আবার আসতে, তাই আবার এলাম।’
পরের দিন সকাল নয়টায় অফিস। ভোর পাঁচটায় বাবা ডেকে দিলেন। এরপর তৈরি হয়ে পৌনে ছয়টায় বাসা থেকে বের হলাম। মা-বাবা বলছিল কিছু খেয়ে যা। কিন্তু এত সকালে কিছু খেতে পারি না। তবে ব্যাগে একটি আপেল ও বিস্কুটের ছোট্ট প্যাকেট নিয়ে এলাম। তবে এবার আর বিআরটিসিতে নয়, গেলাম তিশা বাস কাউন্টারে। রিকশা থেকে নামার আগেই—‘আপা ঢাকা যাবেন, আমাদের গাড়িতে আসেন। এইডা আগে যাবে।’ বলেই আমার ব্যাগ ছোঁ। আমারও তাড়া। উঠে গেলাম বাসে। বাস ছাড়তে ছাড়তে সাড়ে ছয়টা। এরই মধ্যে বাসের ঝাঁকুনিতে ঘুম এসে গেল। সাড়ে সাতটায় চোখ খুলে দেখি লম্বা যানজট। দুই ধারে পানি আর পানি। সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস। খারাপ লাগছিল না। কারণ, তখনো তো জানি না ঢাকা কত দূর!
ঠান্ডা বাতাসে আবার কখন যেন চোখ বন্ধ হয়ে গেল। আচমকা পাশের যাত্রীর ডাকে ধড়ফড় করে উঠলাম। কারণ, সামনের আসেন জানালার পাশের যাত্রী বমি করেছে। তার কিছুটা বাতাসে এসে আমার জামার হাতায় আর কোলের ওপর থাকা ব্যাগের ওপর পড়েছে। কী করব, বুঝতে পারছি না। অনেক ডাকাডাকি করার পর গাড়ির সুপারভাইজর এলেন। এসে একটি টিস্যু দিলেন। ঘেন্নায় গা ঘিন ঘিন করছে। কখন যে স্নান করব?
এরপর শুরু হলো নতুন উৎপাত। পাশের এই সদয় প্রতিবেশী একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছেন। আপা ঢাকা কী করেন, আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছেন, কুমিল্লায় কোথায় থাকেন? নানা প্রশ্ন। একবার শুনেও না শোনার ভান করে বসে থাকলাম। বলেন, আপা আপনি মনে হয় কানে কম শোনেন। এদিকে আমি গাড়িতে গল্প বলতে, ফোনে কথা বলতে বা বই পড়তে পারি না। আমার শরীর খারাপ লাগে। একপর্যায়ে তাঁকে বললামও বিষয়টা। কিন্তু তাঁর বোধোদয় বলে হয়তো কিছু নেই। প্রচণ্ড যানজট, সঙ্গে রোদের দাপট, এর ওপর এই বিড়ম্বনা।
এদিকে বাস পাঁচ মিনিট চলে তো আধা ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা বসে থাকে। দাউদকান্দি যখন পার হলাম, ঘড়ির কাঁটায় তখন ১১টার বেশি। পেট আর কত সয়? কিন্তু খাব কী? পরে খেলাম দুটি বিস্কুট। কিন্তু ভুলেও পানি খাচ্ছি না। এভাবে কেটে গেল আরও দেড় ঘণ্টা। বাস ঠায় দাঁড়িয়ে। কোথাও কিছু বোঝার উপায় নেই। আর বুঝেই বা কী করব? রাস্তাতেই থাকতে হবে নিয়তি মেনে নিয়েছি। শুধু মনে হচ্ছিল, একটু টয়লেটে যেতে পারলে ভালো হতো। আমি একা। কাকে সঙ্গে নিয়ে যাব? কার কাছে ব্যাগটা দিয়ে যাব? কে আমার জন্য দাঁড়াবে? আমি বাস থেকে নামলে যদি বাস ছেড়ে দেয়? কত শঙ্কা! পরেরবার বাস যেখানে থামল, সেখানে পাশেই একটি বাড়ি দেখতে পেয়ে নেমে পড়লাম। আমাকে দেখে আরেকটি মেয়েও এল। দুজন মিলে ওই বাড়িতে গেলাম। রান্নাঘর থেকে এক নারী আমাদের শৌচাগার দেখিয়ে দিলেন। তার আর বর্ণনা নাইবা দিলাম। গ্রামের টিউবওয়েল থেকে ঠান্ডা পানি পেয়ে ভাবলাম হাত-মুখটা ধুয়ে নিই। কিন্তু এরই মধ্যে বাড়ির এক বৃদ্ধা ডেকে বললেন, বাস ছেড়ে দিল। আর হাত-মুখ ধোয়া! দে দৌড়।
বাস ছাড়ার পাঁচ মিনিট পর আবার থামতে হলো। এবার অসহায়ের সহায় হয়ে আসতে শুরু করল হকাররা। এখন যেন তাঁদের ঈদ। যাত্রীদের করুণ চেহারা আর তাদের চোখে মুখে আনন্দ। কেননা বেশ ভালোই টাকা কামিয়ে নিচ্ছে তারা। ঠান্ডা পানি, বিস্কুট, আলুর চপ, আলুর চিপস, চানাচুর, পাউরুটি, কলা—কত কিছুই না নিয়ে আসছেন তাঁরা। আলুর চিপস বিক্রেতা গলা হাঁকিয়ে বললেন, ‘আর মাত্র তিন প্যাকেট। কে সেই ভাগ্যবান কিনতে চান? কারণ এরপর আর পাবেন না।’ এরপরই জানায়, দুই ঘণ্টায় সে ১০০ প্যাকেট বিক্রি করেছে। তার মানে ১০০০ টাকা বিক্রি হয়ে গেছে। ঘামে গায়ের গেঞ্জিটা ভিজে একাকার হয়ে গেলে তার মুখে ছিল প্রশান্তি।
আবার ফিরে আসি আমার সহযাত্রীর কথায়। এই আলুর চিপস বিক্রেতার কাছ থেকে দুজনেই কিনেছি দুই প্যাকেট। আমারটা আমি রেখে দিয়েছি। ভাবছি, একবারে সব খাব না। কারণ, কতক্ষণ রাস্তায় থাকতে হয়, আর খাবার পাব কি না—কত কিছু। আমার সহযাত্রী তাঁর প্যাকেট থেকে আমাকে বারবার খেতে বললেন, আমি যতই না করি, তাঁর অনুরোধ বাড়তে থাকে। আমি বললাম, আমার তো আছে। আপনি খান। তাঁর জবাব কী—শোনেন। বলে, ‘আপনার প্যাকেট থেকে আমাকে দিতে হবে না। এ কথা শোনার পর কি যে বিরক্ত লাগছিল! ভাবছিলাম, একটি মানুষ এতটা গায়েপড়া কীভাবে হয়! এরপর বলেন, আপনারা চাকরি করেন, ‘আপনারাই টাকা (টাকা বাঁচানোর জন্য না খাওয়া) জমাইতে পারবেন।’
এভাবে চলা আর থামার মধ্য দিয়ে যখন মেঘনা সেতুতে, তখন সাড়ে তিনটা। এপারে এসে দেখি, ঢাকা থেকে বের হওয়া গাড়িগুলো আটকে দেওয়া হয়েছে। সেতু দিয়ে ওয়ানওয়ে সিস্টেমে গাড়ি ছাড়া হচ্ছে। আমাদের গাড়ি যেন মুক্তির আনন্দে ছুটছে। এরপর আর থামা লাগেনি। ৪৫ মিনিটে আমরা সায়েদাবাদ। আমার সহযাত্রী নেমে গেছেন। বাস ডিপোর দিকে আরও একটু এগিয়ে গেলেন। যেখানে নামলাম, সামনে একটা কুকুর মরে পড়ে আছে। মাছি ভোঁ ভোঁ করে উড়ছে। বমি আসছিল। কিন্তু পেটে তো তেমন কিছু নেই। এরপর বাসার উদ্দেশে নিলাম সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা। কমলাপুর, রাজারবাগ, মালিবাগ, মৌচাক হয়ে যখন আসছিলাম, ভাঙা রাস্তার ঝাঁকুনি খেতে মনে হচ্ছিল শরীরটা একটা জীবন্ত লাশ। বারবার সড়কমন্ত্রীর চেহারা চোখের সামনে ভাসছিল। টিভি ক্যামেরার সামনে কত কথা বলেন, একে শাস্তি দেন ওকে শাস্তি দেন। এর মধ্যে মনে হলো, বাবা অসুস্থ তাই বাসায় ছুটে গেলাম। মা-ও অসুস্থ। কেউ যদি এখন ভয়ানক অসুস্থ হয়, তাহলে আমরা কীভাবে যাব। তাঁরা যে বাসায় একা! তাঁদের কিছু হলে আমি শাস্তি দেব কাকে?
The post আ জার্নি বাই বাস appeared first on Comillar Barta.
from Comillar Barta http://ift.tt/2wMD27J
August 25, 2017 at 07:36PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন