বঙ্গবন্ধুকে তার হত্যা ষড়যন্ত্রের বিষয়ে অনেক আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী ও ফিদেল ক্যাস্ত্রো

বিশেষ প্রতিবেদন::বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে হত্যা ষড়যন্ত্রের বিষয়ে অনেক আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো। বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেয়ার চক্রান্ত চলছে বলে তারা দুজনেই একাধিকবার বার্তা দিয়েছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সেই সতর্কবার্তাকে কখনোই গুরুত্ব দেননি। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হন তিনি। বিভিন্ন নথিতে এ তথ্য উল্লেখ রয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধন গড়ে উঠে। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যেও গভীর বন্ধুত্ব হয়। বঙ্গবন্ধু নিহতের অনেক আগেই ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের খবর জানিয়ে তাকে সতর্ক করেছিলেন। বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের মে মাসে ৫ দিন ভারত সফরে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ে ভারত সফরের মধ্য দিয়ে তখন উভয় দেশের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক আরও জোরালো হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড নিয়ে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক এ এল খতিবের ‘হু কিলড মুজিব’ বইয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবার্তার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ইন্দিরা গান্ধী খুব স্পষ্ট ভাষায় শেখ মুজিবকে একাধিকবার জানিয়েছিলেন, তার (শেখ মুজিব) বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত চলছে। কিন্তু শেখ মুজিব এই সতর্কবার্তা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেননি।

এ এল খতিব তৎকালীন সিনিয়র রাজনীতিবিদদের খুব কাছের লোক ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি আরও লিখেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব প্রায়ই বলতেন, ‘একটি বুলেট আমাকে তাড়া করে ফিরছে’। কিন্তু তিনি মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন না। একজন মানুষ যদি মৃত্যুভয়ে ভীত থাকে তাহলে তার মর্যাদা থাকে কোথায়। মুজিবকে তার দেশের মানুষের কাছে খোলামেলাভাবেই মিশতে হতো। ‘আমার জনগণ আমাকে ভালোবাসে’। এ কথাটি মুজিব বহুবার এমনভাবে বলতেন যেন এটি একটি মন্ত্র, যা তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিকিৎসার কারণে মস্কো গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১০ এপ্রিল মস্কো থেকে ফেরার পথে দিল্লীতে ১৬ ঘণ্টা যাত্রাবিরতি করেন। তার একদিন আগেই ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী বিচারে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছিল। এক মাস পরই মে মাসে ৫ দিন ভারত সফরে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময়ে বাংলাদেশে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে বলে সতর্কবার্তা দেয়া হয়। শেখ মুজিবকে সতর্ক করে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী জানিয়েছিলেন যে, তার জীবন হুমকির মুখে রয়েছে। তবে ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবার্তা আমলে না নিয়ে শেখ মুজিব সেই আশঙ্কা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওরা আমার সন্তানের মতো’। এরপরও একাধিকবার সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তবে তিনি কোনভাবেই গুরুত্ব দেননি।

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার এক সাবেক কর্মকর্তা বলেছেন, ইন্দিরা গান্ধী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ছিল। সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা ব্রুস রিডেলের লেখা এক বইয়ে তিনি এ তথ্য উল্লেখ করেছেন। ‘এ্যাভয়েডিং আর্মাগেডন : আমেরিকা, ইন্ডিয়া এ্যান্ড পাকিস্তান টু দি ব্রিংক এ্যান্ড ব্যাক’ নামের এই বইটিতে ব্রুস বলেছেন, ‘ইন্দিরা এক রকম নিশ্চিত ছিলেন, মুজিব হত্যার পেছনে তারাই (যুক্তরাষ্ট্র) ছিল। আর ১৯৭১ এর প্রতিশোধ নিতে এরপর তাকে (ইন্দিরা) হত্যা করতেও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল সিআইএ।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় দিল্লীর লাল কেল্লায় ভারতের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দিতে যাওয়ার আগেই ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার খবর পান। বঙ্গবন্ধু নিহতের খবর পেয়ে ইন্দিরা হতবাক হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু নিহতের ঘটনায় ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অন্যন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’

এদিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আলজেরিয়ায় জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার সময় কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে এক বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধুকে চিলির প্রেসিডেন্ট সালভেদর আলেন্দের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফিদেল ক্যাস্ত্রো জানিয়েছিলেন, ‘সিআইএ সম্পর্কে সাবধান। সুযোগ পেলেই তারা আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর আপনি যদি আপনার শত্রুদের দমন করতে না পারেন, তাহলে ওরাই আপনাকে সরিয়ে দেবে।’ তবে ক্যাস্ত্রোর কথার প্রতি উত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘পরিণতি যাই হোক, আমি আপস করবো না।’

এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহতের ঘটনা জানতে পেরে শোকাহত হয়েছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবরের পর প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে সারা বিশ্বের শোষিত মানুষ হারালো তাদের এমন একজন মহান নেতাকে, আর আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
সূত্র : জনকণ্ঠ



from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2wbf9q0

August 16, 2017 at 12:51AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top