সুরমা টাইমস ডেস্ক:: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের এক সভায় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক ছাত্রলীগ নেতার বাবাও কাঁদলেন ছেলের জন্য।
২০১৪ সালের মার্চে নিখোঁজ হওয়া কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী রাকিবুল হাসান শাওনের বাবা কাজী আবদুল মতিন বীরবিক্রম খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ওই অনুষ্ঠানে মতিন জানান, আড়াই বছর ধরে ছেলের সন্ধানে নানা জায়গায় ধর্না দিয়েও কোনো ফল হয়নি।
টানা ছয় মাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক পিএস আব্দুল মালেকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্তও গিয়েছেন তিনি।
র্যাবের বিরুদ্ধে ছেলেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, “সম্ভাব্য সব জায়গায় যোগাযোগ করে পাওয়া গেছে শুধু আশ্বাস আর সান্ত্বনা।”
৩০ অগাস্ট ‘আন্তর্জাতিক গুম দিবস’ সামনে রেখে ‘মায়ের ডাক: ঈদুল আযহার পূর্বে গুম হওয়া সন্তানদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিন’ শিরোনামে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানায় নিখোঁজ ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের পাঁচ বছরের মেয়ে আদিবা ইসলাম হৃদি।
২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ। ঠিকমতো বাবাকে চেনার আগেই তাকে হারায় হৃদী।
মাতুয়াইলের একটি কিন্ডারগার্টেনের নার্সারির এই ছাত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দেয় মা ফারজানা আক্তারের সঙ্গে; হাতে ধরে রাখা বাবার ছবি দেখিয়ে সে বলে, “এটা আমার বাবার ছবি। আমি তার সাথে ঘুরতে চাই, অনেক কিছু কিনতে চাই।”
ছবির বাবাকে কাছে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে এই শিশু বলে, “হাসিনা আন্টি, হাসিনা আন্টি… আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবার সাথে ঈদ করতে চাই, ঘুরতে যেতে চাই। চাচ্চুরা আমাকে বলে, বাবা দ্রুত আসবে, আসে না।”
স্বামীকে হারানোর পর দুই সন্তান নিয়ে এখন বাপের বাড়ি থাকেন বলে জানান পারভেজ নিখোঁজের সময় সন্তান-সম্ভবা ফারজানা। পারভেজ নিখোঁজ হওয়ার পর বাবা ও শ্বশুর গত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
গুম হওয়া ২৯ জনের স্বজনদের মধ্যে ছিল ছাত্রদলের সূত্রাপুর থানার একটি ওয়ার্ডের সভাপতি খালেদ হাসান সোহেলের শিশু সন্তানও। ২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ খালেদ।
“আপনারা আমার আব্বুকে ফিরিয়ে দিন। আমি আব্বুকে অনেক মিস করি। তার সাথে ঈদ করব, ঘুরতে যাব,” বলে তার সাত বছরের ছেলে আরিয়ান।
বাবাকে ফিরে পেতে এই শিশুদের আকুতি শুনে ছাত্রলীগ নেতা শাওনের বাবা মতিন বলেন, “এখানে সবাই ছোট ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবাকে ফিরে পাওয়ার কথা বলছে। আর আমি শেখ হাসিনার পিতার বডিগার্ড হয়ে, সেনাবাহিনীর চৌকস সদস্য হয়ে, বীরবিক্রম হয়েও আমার ছেলের সন্ধান পাইনি। তাহলে এরা কীভাবে পাবে?
“আমার তাই মনে হচ্ছে, কেউ আপনাদের ছেলে-মেয়েদের ফিরিয়ে দিতে পারবে বলে মনে হয় না। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিন।”
তিনি বলেন, “আমি বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ছেলে গুম হওয়ার পর আমার স্ত্রী তিনবার স্ট্রোক করেছে। আমার ছেলে অপরাধ করলে গুম না করে আইনের আওতায় আনা যেত। অপরাধের কারণে তার একশ বছরের সাজা হলেও আমার কোনো দুঃখ থাকত না।”
আলোচনা সভায় (ডান থেকে) বিএনপিকর্মী আবদুল কাদির ভূঁইয়া মাসুমের মা আয়েশা আলী, কুমিল্লার ছাত্রলীগ নেতা কাজী রাকিবুল হাসান শাওনের বাবা কাজী আবদুল মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা বেগম ও মানবাধিকারকর্মী শিরীন হক।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হওয়া ২৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা বেগম; তার ছেলের সঙ্গে একই স্থান থেকে আরও সাতজন নিখোঁজ হওয়ার কথা তুলে ধরতে গিয়ে গলা ধরে আসে ষাটোর্ধ্ব এই নারীর।
তিনি বলেন, “র্যাব-১ লেখা তিনটি গাড়ি এসে ওদের নিয়ে গেছে। ছাউনিওয়ালা পিক-আপের মতো গাড়িও ছিল, অস্ত্রশস্ত্র ছিল। কিন্তু অনেক খুঁজেও ছেলেকে আর পেলাম না। আমার সুমন যেন ফিরে আসে।”
পরে মায়ের কাছ থেকে মাইক নিয়ে সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম কেঁদে কেঁদে বলেন, “আমরা চাই, মৃত্যুর আগে যেন আমার ভাই ফিরে আসে। জানি না কোন টর্চার সেলে আমার ভাই আছে। দুঃসহ আরেকটা দিনও আমরা পার করতে চাই না।”
সভার বেশিরভাগ সময় কাঁদতে দেখা যায় নিখোঁজ ঢাকার পূর্ব নাখালপাড়ার বিএনপিকর্মী আবদুল কাদির ভূঁইয়া মাসুমের মা আয়েশা আলীকে; বক্তব্য দিতে এসেও কাঁদতে থাকেন তিনি।
বলেন, “ঘুণেধরা কাঠের মতো বেঁচে আছি আমরা। কেবল উপরের অংশটি আছে। তিন বছর আট মাস হল ছেলেকে হারালাম। তার দাদা-দাদি, খালাও মারা গেছে ইতোমধ্যে। অনেক জায়গায় ধর্ণা দিয়েছি। এখন কোথায় কী বলতে হবে, বুঝতে পারি না।”
আয়েশা বলেন, “আমার সন্তান অপরাধ করলে পুলিশে দেন, শাস্তি দেন। কিন্তু এভাবে আমাদের সন্তানহারা করে রাখবেন না।”
সভায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “দুই বছর জেল খেটে এসে দেখি, ভয়ের চাদরে সারা দেশ ঢেকে গিয়েছে। যেমন রেখে গিয়েছিলাম তেমন পাইনি।”
সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “হত্যার দায়মুক্তি এরা দিয়ে দিয়েছে। এদের কাছে বিচার চাইলেও বিচার পাবেন না। যারা জেনেশুনেও আমার স্বজনদের দূরে রেখেছে- তাদের বিষয়ে প্রতিশোধ নিতে হবে।”
গুম ও নিখোঁজের ঘটনা তদন্তে বিশেষ কমিশন গঠনে সরকারের প্রতি দাবি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান।
ভিন্নমত জানিয়ে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো মিলে একটি বিশেষ তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন মাহমুদুর রহমান মান্না।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “গুম হওয়া পরিবারের এই মানুষদের হাহাকার কি শোনেন আপনি? নিজের এত স্বজন হারিয়ে তাদের এত দুঃখ, এত কান্না কী করে সহ্য করেন! এই হাহাকার বুঝে থাকলে তাদের ফেরানোর উদ্যোগ নিন।
“যারা স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলেন, উন্নয়নের কথা বলেন… এই যে উন্নয়ন হচ্ছে তার বিপরীতে আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ গুম হবেন, তাতে রাজি আছেন?”
সভায় অন্যদের মধ্যে মানবাধিকারকর্মী শিরীন হক, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটন, অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান, নিখোঁজ কে এম শামীমের স্ত্রী ঝর্ণা খানম, নিখোঁজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুহুল আমিনের ভাই আল-আমিন, মোহাম্মদ চঞ্চলের ছেলে একরাম হোসেন আহাদ বক্তব্য দেন।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2wiHj1X
August 30, 2017 at 11:48PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন