মো. আবুল কাশেম, বিশ্বনাথ প্রতিনিধি :: সিলেটের বিশ্বনাথে রাজনীতির মাঠে অনেকটা ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার মতো দাপুটে অবস্থান নিয়েছিল উপজেলা আওয়ামী লীগ। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি রয়েছিল মাঠ ছাড়া। অন্যদিকে, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিতে বিরাজ করছে অনৈক্য। অনৈক্যের কারণে বিচ্ছিন্নভাবে নেতাকর্মীরা আন্দোলন করার চেষ্টা করছেন। এদিকে, উপজেলা জাতীয় পার্টির দীর্ঘদিন ধরে কমিটি বিহীন অবস্থায় রয়েছে। ফলে দলের নেতাকর্মীরা মাঠে নামাতে নারাজ। ‘বিএনপির আন্দোলনে কিছুই হবে না’ এই ধারণা কাজ করছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনে। এ সুযোগে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষ করে গত দুই বছর পূর্বে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে উপজেলায় দুই নেতার দ্বন্ধের হতাশায় পড়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই প্রবাসী নেতা শফিকুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর মধ্যে চলছে দ্বন্ধ। তারা দু’জনই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তার মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি ২০০৮ সালে শুধু যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদ পরিচয়ে সিলেট-২ আসনে নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে শফিক চৌধুরী বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীকে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন। বর্তমানে শফিক চৌধুরী দেশে অবস্থান করে জেলা ও উপজেলায় রাত-দিন দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে,যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়রুজ্জামান চৌধুরী। দেশের রাজনীতিতে জেলা কিংবা উপজেলাতে তার কোনো পদ-পদবি নেই। তিনি শুধু লন্ডনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে দেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছেন। অনেকটা কৌশলে দলের ভেতরে গ্রুপিং সৃষ্টি করে জেলা ও উপজেলার অনেক নেতাকর্মী দিয়ে তার গুণকীর্তন চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এই দ্বন্ধের কারণে দুই বছর ধরে আটকে আছে উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ২০১৫ সালের ৮ জুন উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনের কণ্ঠভোটে পংকি খানকে সভাপতি ও বাবুল আখতারকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। তবে সম্প্রতি ওমরা হজ্ব পালনকালে সৌদিআরবে বাবুল আখতার মৃত্যুবরণ করেন। তারা দু’জনই শফিক চৌধুরী গ্রুপের নেতা। কিন্তু এই কণ্ঠভোটের প্রতিবাদ করেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী গ্রুপের নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, গোপন ভোটের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করতে হবে। আনোয়ারুজ্জামান গ্রুপের নেতাকর্মীদের দাবির মুখে দীর্ঘ দুই বছরেও ওই তালিকার কমিটি প্রকাশ করা হয়নি। এ নিয়ে জেলা কমিটির সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। আর ওই দ্বন্ধের দুই বছর ধরে এভাবেই ঝুলে রয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি। এছাড়া একই দ্বন্ধে আটকে আছে উপজেলা যুবলীগের কমিটিও। ওই দ্বন্ধের কারণে স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব সংকটে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। গত সোমবার উপজেলা ছাত্রলীগের একটি কমিটি ঘোষণা করা হলেও বির্তক চলছে। ওই কমিটির বিরুদ্ধে আরেকটি বিদ্রোহী কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে। তাই নেতাকর্মীদের মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। পাশাপাশি গ্রুপিংয়ের বাইরে থাকা অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে শফিকুর রহমান চৌধুরীকে এমপি হিসেবে দেখতে চাই স্লোগানে তার অনুসারীরা এলাকার বিভিন্ন স্থানে বিলবোর্ড ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ঝড় তুলছেন। অন্যদিকে উপজেলা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একটি অংশ আনোয়ারুজ্জামানের সমর্থনে প্রতিটি ইউনিয়ন মতবিনিময় সভা করে আসছে।
অপরদিকে,চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রথমে উপজেলা বিএনপি মনোবল বেশ চাঙ্গা থাকলেও বর্তমানে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা হলেও হতাশা বিরাজ করছে। বিশেষ করে তৃণমূল নেতাকর্মীরা শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনৈক্য, বিভেদ দেখে ক্ষুব্দ। তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করছেন, শীর্ষ নেতাদের অনৈক্যের কারণেই বিশ্বনাথ বিএনপি আন্দোলনের শুরুর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। চলমান আন্দোলনে তাদের তেমন কোনো তৎপরতা উপজেলায় দেখা যায়নি। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হলে নেতারা ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তাদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দিয়েছে। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিশ্বনাথ বিএনপিতে ছিল না কোনো দ্বন্দ, ক্ষোভ, ছিলনা কোনো বিভেদ। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তখন ঐক্যবদ্ধভাবে সকল কর্মসূচী পালন করতেন। কিন্তু ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর বিশ্বনাথে বিএনপিতে অনৈক্য দেখা দেয়।
এদিকে, বছরের পর বছর নিষ্ক্রিয়, নির্জীব থাকার পর অবশেষে জেগে ওঠার আভাস দিচ্ছিল বিশ্বনাথ উপজেলা জাতীয় পার্টি। সে লক্ষ্যে শুরু হয়েছে তাদের তোড়জোড়। দীর্ঘদিন আড়ালে আবডালে পড়ে থাকার পর তারা মাঠে বেরুতে শুরু করেছিল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট সরকারের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে সিলেট ২ আসন (বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর) জাতীয় পার্টি প্রার্থী মনোয়ন পেয়ে এ আসনে জয়লাভ করেন। দীর্ঘদিন পর দলীয় সংসদ পেয়ে দলের নেতাকর্মীর মধ্যে প্রানঞ্জলতা ফিরে পায়। কিন্তু বর্তমানে জাতীয় পার্টি কমিটি না থাকায় অভিভাবকহীন অবস্থায় রয়েছে জাপা। পদ-পদবি না থাকায় ঝিমিয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা।
এব্যাপারে উপজেলা জাতীয় পার্টির সাবেক যুগ্ম-আহবায়ক জয়নাল আবেদিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির কমিটি না থাকায় কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা। যারা পদ-পদবি পেলে দল চাঙ্গা হবে তাদের দিয়েই শিগগিরই কমিটি গঠনের আহবান জানান তিনি। কমিটি ঘোষনা হলেই ফের জাপা চাঙ্গা হবে বলে তিনি মনে করেন।
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক লিলু মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপিতে অনৈক্য নেই। মামলার কারণে নেতাকর্মীরা রাজপথে নামতে পারছেন না। ইলিয়াস আলীর সন্ধ্যান আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান। ইলিয়াস আলীর অবর্তমানে বিশ্বনাথে ইলিয়াসপত্নী তাহসিনা রুশদি লুনা (ম্যাডাম) এর নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে ও এলাকায় বিএনপি আরও সুসংগঠিত হয়েছে বলে তিনি জানান।
আনোয়ারুজ্জামান অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ফখরুল ইসলাম মতছিন সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান কমিটি গঠনতন্ত্রমূলকভাবে হয়নি। তাই ওই কমিটির কোনো বৈধতা নেই। এ কমিটি ঘোষনার পরই আমরা প্রত্যাখান করেছি। ইতিমধ্যে আমরা দলের সভানেত্রী-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দলের সাধারণ সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দে কাছে বিশ্বনাথ আওয়ামী লীগের অবৈধ কমিটির বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছি। কমিটিতে যাতে অনুপ্রবেশকারীরা স্থান না পায় সেজন্য তিনি দলের হাইকমান্ডের নিদের্শ পালন করার জন্য জেলা নেতৃবৃন্দের প্রতি আহবান জানান।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পংকি খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের দল। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমরা রাজনীতি করি। বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার আন্দোলনে কোনো জনসমর্থন নেই। আমরা রাজপথে, রাজপথে থাকব। তবে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে শফিক চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশ্বনাথ আওয়ামী লীগ অনেক শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। দলে কোনো গ্রুপিং নেই বলে তিনি দাবি করেন।
দন্ধের বিষয়টি অস্বীকার করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী হলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা। দেশে জেলা অথবা উপজেলায় তার কোনো রাজনৈতিক পদ-পদবি নেই। তাই তার সঙ্গে দ্বন্দের প্রশ্নই ওঠে না। আগস্ট মাসের পরে বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান।
from সিলেট – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2ub7us5
August 04, 2017 at 07:13PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন