কলকাতা, ২৮ সেপ্টেম্বর- তৃণমূলের ডজনখানেক নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে কেন্দ্রীয় সংস্থা৷ দল ছেড়েছেন মুকুল রায়৷ বিজেপি-র রাজ্য দখলের ইচ্ছে থাকলেও সংগঠন নেই৷ কংগ্রেসে গুটি কতক নেতা৷ সিপিএমে রক্তক্ষরণ অব্যাহত৷ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তবে কোন দিকে? প্রশ্ন উঠছে, গত ছয় বছর ধরে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে বিচলিত করে মাঝপথে কেউ সরিয়ে দিতে পারে? জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে বলছে, ইদানিং পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে ও বাইরে বেশ গুঞ্জন শুরু হয়েছে৷ পাড়ায় চায়ের দোকান থেকে মোড়ের ক্লাবের আড্ডায় আলোচনার বিষয় রাজ্য রাজনীতি৷ রাজনীতি-প্রিয় বাঙালির কাছে অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়৷ প্রশ্ন উঠছে, গত ছয় বছর ধরে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে বিচলিত করে মাঝপথে কেউ সরিয়ে দিতে পারে? স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন মত উঠে আসছে৷ এ ব্যাপারে ভারতীয় জনতা পার্টি বেশ কিছুদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে৷ কিন্তু, দলের শুভাকাঙ্খী থেকে সাধারণ পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে কেন বদ্ধমূল ধারণা যে, বিজেপি বিরোধী দল হয়ে উঠতে পারেনি৷ বিশেষত এই দলের রাজ্য নেতাদের তেমন একটা ফেস-ভ্যালু নেই৷ এই খামতি নিয়ে তৃণমূলের মতো শক্তিকে উৎখাত করা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক বাংলার আকাশে-বাতাসে ঘোরাফেরা করছে৷ বিজেপি চাইছে, কয়েকজন পরীক্ষিত-নেতা৷ সেই নেতারা যে কুমোরটুলি থেকে আসবেন না, তা বিলক্ষণ জানেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতারা৷ এমন নেতাকে তুলে আনতে হবে প্রকৃত তৃণমূলবিরোধী অথবা সদ্য তৃণমূলবিরোধী শিবির থেকে৷ এক্ষেত্রে চাহিদা-যোগানের তত্ত্ব অনুযায়ী রাজ্যে উপযুক্ত কিছু হেভিওয়েট মুখ ইতিমধ্যেই তৈরি আছেন৷ বঙ্গ-রাজনীতিতে এখনও প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, এমন একাধিক নেতা রয়েছেন, যারা নিজ দলেই এখন একটু বিব্রতকর অবস্থায় আছেন৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্গাপূজায় প্রতিমা বিসর্জনের ইস্যু৷ মমতার সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছে, একাদশীর দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের মহরম৷ তাই ওইদিন বিসর্জন করা চলবে না৷ ধর্মীয় ইস্যু পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি৷ কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যের এই বিজ্ঞপ্তির নিন্দা করে মহরমের দিনেই বিসর্জনের নির্দেশ দিয়েছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় মমতার নিন্দা করছেন অনেকেই৷ বলা হচ্ছে, ভোট বাক্সের স্বার্থে মুসলিম তোষণ করছেন তিনি৷ প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও অনেকেই এর নিন্দা করেছেন৷ এমনিতেই তৃণমূলের হাল খুব একটা ভালো ঠেকছে না৷ একাধিক কাণ্ডে জর্জরিত দলটি৷ তৃণমূল যে স্বস্তিতে নেই তা বোঝা গেছে গত ৪ সেপ্টেম্বরের কোর-কমিটির বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে৷ তিনি সেখানে বলেছিলেন, যারা দল ছেড়ে দিতে চান, যেতে পারেন৷ একসঙ্গে দুদিকে থাকা যাবে না৷অনেকের ব্যাখ্যা, এই কথাগুলো নাকি নেত্রী বলেছেন মুকুল রায়কে৷ আর সহ্য হচ্ছিল না৷ শেষমেশ দল ছাড়লেন একদা তৃণমূলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড রাজ্যসভার সংসদ সদস্য মুকুল রায়৷ দুই বছর আগে সারদা মামলায় ফেঁসে দলের সঙ্গে দূরত্ব প্রকাশ্যে এসেছিল তার৷ এবার নারদমর্তে নেমেছেন৷ নারদ নামের ঘুষ কেলেঙ্কারিতে ফেঁসেছেন তিনিসহ তৃণমূলের ডজন খানেক নেতা, মন্ত্রী৷ মুকুল রায় বিজেপি-র সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন৷ এই বিষয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ তথা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী মনে করছেন, তৃণমূল বেকায়দায় পড়েছে বলেই খুব সহজে বিরোধীরা জায়গা দখল করে নিতে পারবে, বাংলায় এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেও নেই৷ ২০২১ সালে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন৷ তখন কী হবে সেটা পরের কথা৷ আপাতত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি দুম করে অত্যন্ত ভালো ফল করে ফেলতে পারবে না৷ বিষয়টা অত্যন্ত কঠিন৷ এর অন্যতম কারণ হলো, মমতা বন্দ্যোপাদ্যায় সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে গ্রামাঞ্চলের উপকৃত বহু মানুষ মমতার সঙ্গেই রয়েছেন৷ এদিকে, প্রদেশ কংগ্রেসের অবস্থা মোটেই ভালো নয়৷ জাহাজ ডুবছে বুঝতে পেরে অনেকেই প্রলোভনে কংগ্রেস ছাড়ছেন৷ এরমধ্যে জাতীয় বাধ্যবাধকতার কারণে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিপ্রতিদিনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সখ্য বাড়াচ্ছে৷ সেইসঙ্গে মমতাও প্রদেশ কংগ্রেসকে তোয়াক্কা না করে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন সোনিয়া-রাহুল গান্ধীদের সঙ্গে৷ স্বভাবতই প্রদেশ কংগ্রেস হতাশ৷ তবে, তৃণমূল, কংগ্রেস, বিজেপির চেয়েও অবস্থা খারাপ সিপিএমের৷ ক্ষয়িষ্ণু সংগঠন৷ নিচের তলা থেকে দলে দলে কর্মীরা যোগ দিচ্ছে তৃণমূলে৷ একটা অংশ আবার নীতি, আদর্শকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সোজা গেরুয়া শিবিরে নাম লেখাচ্ছে৷ তার মধ্যে এখন গোদের উপর বিষফোঁড়া, যার নাম ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দলেরই রাজ্য কমিটির একটি অংশ খুঁচিয়ে ঘা করেছে৷ রাজ্যসভার এই সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে সিপিএম৷ সব মিলিয়ে সিপিএমের অবস্থা ভালো নয়৷ মুকুল রায় এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সবচেয়ে মার্জিনালাইজড৷ কিন্তু, সব থেকে প্রতিভাধরও বটে৷ অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে চাণক্যের অভাব অনেকটাই মিটিয়ে এসেছেন তিনি৷ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তৃণমূল দলটিকে তিনি চেনেন নিজের হাতের তালুর মতো৷ এই দল মুকুল রায়ের হাতে তৈরি৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তাকে ভোটবাক্স অবধি টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজটা মুকুল করেছিলেন৷ তার সমর্থকদের বক্তব্য, দলের কঠিন সময় থেকে মুকুল সংগঠন সামলেছেন৷ এখন যারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন, তারা কর্মীদের মন বুঝছেন না৷ পরে আসা কিছু নেতা আর নেত্রীকে ঘিরে থাকা কিছু আমলা সব নিয়ন্ত্রণ করছেন৷ তাই এই ডামাডোল৷ বিজেপিও ঠিক এমনই চাইছে৷ মুকুল রায়দের মতো হাই-প্রোফাইল নেতাদের দলে না এনে, মুকুলের দলকে সমর্থন করা ও আসন সমঝোতা করাই বিজেপির এ মুহূর্তের কৌশল৷ এতে নিজেদের দলীয় প্রার্থীদের ভোট বাড়িয়ে নিতেও সক্ষম হবে বিজেপি৷ বিজয়বর্গীও এই ফরমূলায় রাজি৷ দিল্লিতে বিজেপির হেভিওয়েট নেতাদের মুকুলের এই অবস্থানের কথা জানিয়েও দিয়েছেন বিজয়বর্গীয়৷ দিল্লি থেকে বিজেপির সবুজ সংকেত মেলার কথা মুকুলকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তাই মুকুল রায়ের তৃণমূল-ত্যাগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষাতেই রয়েছেন এ রাজ্যের আদি তৃণমূলীরা৷ তৃণমূলের উল্টোরথ এখন সময়ের অপেক্ষা৷ তৃণমূলের একাংশের মতে, সংগঠনে টান এবং প্রাণ, দুটোই চলে গেছে৷ এখন বিভিন্ন ভাতার টাকা আর পুলিশ, এই দিয়ে দল চলছে৷ এর একটা বন্ধ হলেই তৃণমূলের ভিত নড়ে যাবে৷ জেলায় জেলায় বসে যাওয়া বা বিক্ষুব্ধ কর্মীরা মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন৷ বহু নেতা, জনপ্রতিনিধিও আছেন৷ মুকুল জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ে মাঠে নামবেন৷ জোট হবে বিজেপির সঙ্গে৷ এতে সংখ্যালঘু, বাম, কংগ্রেস এবং তৃণমূলের বহু ভোট মুকুল টানবেন৷ এটা সরাসরি বিজেপি পেত না৷ সঙ্গে যোগ হবে বিজেপির ভোট৷ এর সম্ভাবনা বেশি৷ অথবা সরাসরি বিজেপিতে যোগ৷ তবে, কোন পথে এগোবে বাংলার রাজনীতি? নতুন দল গড়ে উঠবে? ১৯৯৮ সালের পর বাংলায় তৃণমূল ছাড়া আর নতুন কোনো দল সেভাবে তৈরি হয়নি৷ সাম্প্রতিক কালে তপন ঘোষের হিন্দু সংহতিঅরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবেই পশ্চিমবঙ্গে বেশ বিস্তার লাভ করেছে এবং এই সংগঠনের সঙ্গে তৃণমূলের প্রকাশ্য ও গোপন আঁতাতের নানা ইঙ্গিত মিলেছে৷ বলা হচ্ছে, রাজ্যে ক্রমশই বাড়তে থাকা বিজেপির ভোটবাক্সে ভাঙন ধরানোর জন্যই এই স্ট্র্যাটেজিনিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাই ধরে নেয়া যায়, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আকাশে আপাতত আরও কয়েক বছর জ্বলজ্বল করবেন মমতা৷ আর/১৭:১৪/২৮ সেপ্টেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2xNKlwn
September 28, 2017 at 09:08PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন