ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর- যত দূর মনে পড়ে তোমার প্রথম গানটি শুনেছিলাম ১৯৭৭ বা ৭৮ সালে বড় আপুর মুখে (খালাতো বোন)। আমার মুসলমানিতে দাওয়াত পেয়ে তিনি এসেছিলেন কুষ্টিয়া থেকে আমাদের বাড়ি পাংশায়। তাঁকে গুনগুনিয়ে গাইতে শুনেছিলামশত্রু তুমি বন্ধু তুমি; তুমি আমার সাধনা। শুধু ওটাই নয়; তিনি সেদিন তোমার শ্রেষ্ঠ গানের ক্যাসেটটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সেদিন যদিও বুঝিনি গানগুলো তোমারই অমর সৃষ্টি; কিন্তু গানগুলো এতবার শুনেছিলাম যে ক্যাসেটের সবগুলো গানই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। পরে রেডিওতে শুনে জেনেছিলাম যে, ওগুলো তোমারই গাওয়া গান। তারপর স্কুল পেরিয়ে গেলাম পাংশা জর্জ হাইস্কুলে। পাংশা কলেজের পাশেই স্কুল হওয়াতে মাঝে মধ্যেই কলেজের বড় আঙিনায় পা রাখার সুযোগ হতো। একদিন শুনলাম কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠান হবে। আর শুধু কি তাই? ওখানে গান গেতে সুদূর ঢাকা থেকে আসছেন এমন একজন, যার আওয়াজ আমাকে রীতিমতো জাদু মুগ্ধ করেছে। তুমি আসবে; তোমার গান কি না শুনে যেতে পারি? হোক না বাড়ি ছয় কিলোমিটার হাঁটার দূরে; পেটে সেই সকাল নয়টার খেয়ে আসা ক্ষুধা, তাতেই বা কি? তোমার গানতো শুনতেই হবে। কিন্তু ট্রেন আর আসে না; তোমারও দেখা পাই না। সন্ধ্যার পর যখন মাইকে ঘোষণা এল এসে গেছেন সেই কিংবদন্তি; ততক্ষণে আমি ক্ষুধায় আর স্থানীয় শিল্পীদের গান শুনতে শুনতে ক্লান্ত। তোমাকে স্টেজে দেখতেই যেন সারা দিনের ক্লান্তি কেটে গেল। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না; যার আওয়াজ সারাক্ষণ আমাকে জাদু মুগ্ধ করে; তারই গান শুনছি এত কাছ থেকে। মনে হয় তোমার প্রথম গানটি ছিলআমি বসন্ত হয়ে এসেছি। অন্ধকার রাতে একা মেঠো পথ পাড়ি দিতে হবে সেই ভয়ে সেদিন তোমার সব গান শুনতে পারিনি। আগেই চলে এসেছিলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটিশত্রু তুমি; বন্ধু তুমি শুনে। কলেজ পেরিয়ে চলে এলাম বুয়েটের হলে। এমন একটি দিনও যায়নি যেদিন গোসল করছি অথচ বাথরুমে তোমার গান গাইনি। তোমার মতো এত বড় মাপের শিল্পী; চাইলেই কি আর সহজেই তোমাকে দেখতে পারি? এরই মাঝে আমরা পাংশা থেকে কুষ্টিয়াতে বসবাস গড়েছি। তখন থেকে তো ভাবতেই শুরু করি; এই আওয়াজ শুধু বাংলাদেশেরই নয়; যেমন কবিগুরুর প্রতি; এই আওয়াজের প্রতিও যেন আমার একটু বেশিই অধিকার। কতবার ভেবেছি, তোমাকে যদি আর একটি বার কাছ থেকে দেখতে পারতাম! সেই সুযোগটি একদিন এসেছিল। একদিন ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে একই বাসে তোমার সহযাত্রী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সারা পথ সেদিন তুমি তোমার পাশের যাত্রীদের সঙ্গে যত কথা বলেছিলে; আমি পেছনে বসে সব কথাগুলো সারা জীবনের ক্ষুধা নিয়ে গিলেছিলাম। সেদিন তোমাকে একটি সালাম দিয়েছিলাম মাত্র। কতবার ভেবেছিলাম, তোমায় গিয়ে বলি; আমি যে তোমার কত বড় ভক্ত। আমি জানি তোমার হয়তো কোটি ভক্ত আছে। কিন্তু সেদিনের না বলাটাই যেন ঠিক ছিল। আমি ওই কোটিদের একজন নয়। আমার কাছে তোমার স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। তোমার গান নিয়ে আমার অনেক স্মৃতির দু-একটি এখানে উল্লেখ করলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় এসে জোছনা রাত পেলে উঠানে পাটি বিছিয়ে গান গেতে বসতাম ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে। তারা ভরা রাতে; তোমার কথা যে গানটি ধরলে নিজেকে যেন অনেক বড় এক কাল্পনিক ব্যর্থ প্রেমিক হিসেবে আবিষ্কার করতাম। আর একটা স্মৃতির কথা যেন না বললেই নয়! বিয়ে করে বউ দেশে রেখে সাত দিনের মাথায় আমেরিকা পাড়ি দিয়েছি। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ; তারপর দুরে থাকা। সহজে কি আর তার মন পাওয়া যায়। পাতার পর পাতা চিঠি; ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন; কোনোটাতেই যেন তেমন ফল হচ্ছিল না। একদিন বউয়ের ছবি একটি পাতায় ছেপে নিচে লিখলাম তোমার গানের কথাগুলিও মুখ তোমার যেন ফোঁটা এক পদ্ম; অঙ্গে সোনা রং মেখেছে সদ্য। জবাব পেয়েছিলাম এই বলেতোমার এবারের চিঠিটা অসাধারণ। কিছুদিন থেকেই পত্রিকায় তোমার অসুস্থার খবর আসছিল। অনেকই বলছিলেন, তোমার নাকি সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এবার বুঝি তুমি সত্যিই গাইছবিদায় দাওগো বন্ধু তোমরা। তারপরও মন মানে না। মন চাইল তোমার সঠিক অবস্থা জানতে। ফেসবুকে খবর চাইলাম পিজির এক বড় ভাইয়ের কাছে। ভাইয়া ব্যস্ত মানুষ। তিনি হয়তো আমার মেসেজটি দেখেনই নাই। এরই মাঝে শুনলাম তোমার বিদায় মঞ্জুর হয়েছে। তুমি চলে গেছ ওপারে, না ফেরার দেশে। আজ তোমার একটি গানের কথা মনে পড়ছেএ মালিকে জাহান। দোয়া করি তিনি যেন তোমার বাসাকে ফুলসজ্জা করে দেন। তুমি যেমন হাজারো কোটি মানুষের মনে শান্তির বার্তা এনে দিয়েছ; খোদা যেন তোমার আত্মার এমনই শান্তি দেন। আর/১৭:১৪/১২ সেপ্টেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2feWcJR
September 13, 2017 at 12:38AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন