নিউ ইয়র্ক, ২৩ সেপ্টেম্বর- সিলেটের গৌরব ও অহংকারকে ধারণ করে বিশ্বময় সিলেটি ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে নিউইয়র্কের বিশ্ব সিলেট সম্মেলন। দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলন ১৭ সেপ্টেম্বর রোববার মধ্যরাতে শেষ হয়। জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন নিউইয়র্ক আয়োজিত এ সম্মেলনে সিলেটি বংশোদ্ভূত বিভিন্ন প্রজন্মের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য, জার্মান, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে ছুটে আসেন জ্যামাইকার ইয়র্ক কলেজের খোলা প্রান্তরে। দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল আলোচনা, সেমিনার, বিনোদন ও বাণিজ্যের নানা আয়োজন। সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, উন্নয়ন ভাবনা, স্বদেশ চিন্তা নিয়ে আলোচনা করেছেন বিশিষ্টজনেরা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, প্রবাসজীবন ও নবপ্রজন্মের সিলেটি উদ্যোক্তা নিয়ে সমৃদ্ধ আলোচনায় ভরপুর ছিল সম্মেলনকেন্দ্র। শেষ গ্রীষ্মের চমৎকার আবহাওয়ায় সম্মেলনের শেষ দিনে নিউইয়র্কের প্রবাসী সিলেটিরা সপরিবারে এসেছিলেন শিকড়ের সন্ধানে। অবশ্য প্রত্যাশা অনুযায়ী মানুষের ঢল না নামায় ক্ষোভ দেখিয়েছেন কেউ কেউ। শেষ সন্ধ্যায় আয়োজিত বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের সমাপনী পর্বে বক্তব্য প্রদানকালে সম্মেলনের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, সিলেট অঞ্চলের লোকজন বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকলেও শিকড়ের টান থেকে মুক্ত হতে পারে না। আর এই মুক্ত হতে না পারাটা সিলেটি পরিচয়ের অহংকার। এ চেতনাকে ধারণ করে স্বদেশ ও স্ব-অঞ্চলের অগ্রযাত্রায় বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা সিলেটিদের নবযাত্রা শুরু হলো নিউইয়র্ক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন নিউইয়র্কের সভাপতি বদরুল ইসলাম খান তাঁর বক্তব্যে এ সম্মেলনে অংশ নেওয়া সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। সাধারণ সম্পাদক জেড চৌধুরী জুয়েল বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সম্মেলন সফল হয়েছে। তিনি বলেন, সম্মেলন থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সিলেটিদের কাছে প্রত্যাশার এবং ঐক্যের বার্তাটি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এদিকে সিলেট বিশ্ব সম্মেলনের নাম জালালাবাদ বিশ্ব সম্মেলন হবে কি না, এ নিয়ে ছিল নিউইয়র্কে একদল সিলেটির অপ্রকাশ্য বিরোধিতা। বিরোধিতা ছিল কর্তৃত্ব নিয়েও। ফলে ব্যাপকভাবে সিলেটিদের ঢল নামেনি সম্মেলনকেন্দ্রে। ওজন পার্কের প্রবাসী আবদুল মতিন বলেন, বিশ্ব সম্মেলনের নামে যে লোকসমাগম হয়েছে, যেকোনো পথমেলায় এর চেয়ে বেশি জনসমাগম ঘটে নিউইয়র্কে। নিউ জার্সি থেকে সম্মেলন যোগ দেওয়া এনাম চৌধুরী বলেন, সিলেটের ডাক শুনেই আমাদের আসতে হয়েছে। ভালো প্রচার হয়নি, তারপরও সিলেটের নামে যেকোনো আয়োজনে আমাদের যোগ না দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। দ্বিতীয় দিনে উৎসব মঞ্চে বাংলাদেশ, ভারতসহ ইউরোপ-আমেরিকার নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা সিলেটের বিশিষ্টজনেরা বক্তব্য দেন। বক্তব্য দেন সাবেক সচিব ও রাজনীতিবিদ ইনাম আহমদ চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান, জাতীয় অধ্যাপক ড. শায়লা খাতুন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. অমলেন্দু চক্রবর্তী, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ সভাপতি সি এম তোফায়েল সামি, রানা ফেরদৌস চৌধুরী, জার্মানি থেকে অংশ নেওয়া সাকী চৌধুরী প্রমুখ। সাহিত্যে সিলেটের ঐতিহ্যময় অগ্রযাত্রা নিয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সিলেটের তৃতীয় প্রজন্ম এখন আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে পদার্পণ শুরু করেছে। সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে শুরু করে আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে জিয়া হায়দারের গৌরবময় সাহিত্যচর্চা নিয়ে তিনি কথা বলেন। সিলেটের সাংবাদিকতা দেশে ও প্রবাসে শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় মূলধারার বাংলা সংবাদমাধ্যমে প্রবাসী সিলেটিদের অনন্য অবদান রয়েছে। উৎসবের মূল মঞ্চে দেওয়া সূচনা বক্তব্যে ইব্রাহীম চৌধুরী বলেন, পূর্ব-পশ্চিমের প্রবাসীবহুল নগরীগুলোয় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মহান দায়িত্ব পালন করছেন সিলেট অঞ্চল থেকে আসা সাংবাদিকেরা। প্রবীণ সাংবাদিক মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন এম এম শাহীন, আবু তাহের, নজরুল মিনটু ও মাহফুজুর রহমান। সিলেটের মরমি সাধক ও বর্তমান সাংস্কৃতিক কর্মপ্রবাহ শীর্ষক আলোচনা সভায় মূল বক্তব্য দেন দুলাল ভৌমিক ও আনোয়ার হোসেন। তাঁরা বলেন, সিলেটের মরমি সাধনা ও ভাববাদের চর্চা এ অঞ্চলের অসাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করেছে। এতে আরও বক্তব্য দেন আনোয়ারুল লাভলু ও এজাজ আহমদ। আলোচনা হয় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সিলেট অঞ্চলের লোকজনের ভূমিকা নিয়ে। সুব্রত বিশ্বাসের সঞ্চালনায় এ পর্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়ক জেনারেল ওসমানীসহ মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাদের নিয়ে আলোচনা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সীমানায় চলে যাওয়া সিলেটের লোকজনের সহযোগিতা এবং অবদানের কথা আলোচিত হয় বিশেষভাবে। বারুল হোসেন, তাজুল ইমাম, মারুফ আহমেদ, তাজুল মোহাম্মদসহ অন্যরা আলোচনায় যোগ দেন। বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং সিলেটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পর্বে আলোচনা করেন মোস্তফা সেলিম, ইনাম আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ। নতুন প্রজন্মের আন্তর্জাতিক বক্তা সাবিরুল ইসলাম মূল মঞ্চে দেওয়া তাঁর বক্তব্যে ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন-পারপাস অব একজিস্ট্যান্স শিরোনামে উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, প্রতিটি মানুষ সৃষ্টির এককতায় অনন্য। প্রতিটি মানুষের সম্ভাবনাকে জাগ্রত করতে পারলেই সাফল্য অনিবার্য। সন্ধ্যার পর থেকে খোলা মাঠের উন্মুক্ত মঞ্চে পরিবেশন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, শিলচর, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে আসা সিলেটি শিল্পীরা গানে, অভিনয়ে ও নৃত্যে সিলেটের লোকায়ত সংস্কৃতি তুলে ধরেন। বাংলাদেশ থেকে সুবীর নন্দী, ভারতের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী সোনালী আচার্যি, কলকাতার জীবনমুখী গানের শিল্পী রূপাঙ্গন, যুক্তরাষ্ট্রের তাজুল ইমাম, কাবেরী দাস, যুক্তরাজ্যের হিমাংশু গোস্বামী, কানাডা থেকে আসা সাবু শাহ প্রমুখ শিল্পীর পরিবেশনা ছিল। একই মঞ্চে অকালপ্রয়াত সংগীতশিল্পী সিলেটি বংশোদ্ভূত কালিকাপ্রসাদ স্মরণে বিশেষ সাংস্কৃতিক পর্বটি ছিল আবেগঘন। প্রথম আলোর স্টলের সামনে চলছে ছবি তোলা। ছবি: প্রথম আলোসিলেট বিশ্ব সম্মেলন মাঠে ছিল বাণিজ্য ও বিপণনের ব্যাপক আয়োজন। মণিপুরি শাড়ি, শীতলপাটি, সাতকরার আচার, খোলা চা-পাতার বিপণন ছিল চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার তাঁবু ছিল মাঠের উত্তর প্রান্তে। সম্মেলনে আগত অনেকেই এ তাঁবুতে আড্ডা দিয়েছেন সম্মেলনের উভয় দিনেই। লেখক-সাংবাদিকদের আড্ডা ছিল দিনভর। কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন আড্ডার মধ্যমণি। এর মধ্যে অনেকেই প্রথম আলোর রাখা সেলফি স্ট্যান্ডের সামনে ছবি উঠিয়ে নিয়েছেন নিজেদের মতো করে। সম্মেলনের মূল আকর্ষণ ছিল সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আলী আমজাদের ঘড়িঘরের রেপ্লিকা। এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি উঠিয়েছেন সম্মেলনে আগত প্রায় সবাই। সুরমাতীরের লোকজনের মুখে ছিল বহুল প্রচলিত প্রবাদ চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ি/ আলী আমজাদের ঘড়ি/ বঙ্কু বাবুর দাঁড়ি/ আর জিতু মিয়ার বাড়ি। মধ্যরাত পর্যন্ত চলে আনন্দ অনুষ্ঠান। দল বেঁধে ছবি ওঠানোর পর অনেকেই বলে ওঠেন, হিরিবার দেখা অইবো, বালা থাকিও। আর/০৮:১৪/২৩ সেপ্টেম্বর



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2xuNGQm
September 23, 2017 at 02:23PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top