সিডনি, ২৭ সেপ্টেম্বর- ঘুম আমার বরাবরই প্রিয়। আর তা যদি ছুটির দিনে হয় তাহলে তো কথাই নেই। তাই শনি বা রোববারে সকাল এগারোটার আগে আমাকে ক্রেন দিয়েও ওঠানো সম্ভব ছিল না। এভাবেই দিন চলতে লাগল। এক সময় কন্যার লেখাপড়ায় সহায়তার জন্য কোচিংয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। আমি তখন আমার অতি প্রিয় ঘুম বিসর্জন দিয়ে প্রতি শনিবার সকালে কন্যাকে কোচিংয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলাম। তখনো আমার কাছে হারাধনের শেষ ছেলেটির মতো রোববার সকালের অতি প্রিয় ঘুমের প্রতীক্ষা বেঁচে রইল। এর মধ্যে পরিচয় হলো আমার পুত্রের সঙ্গে ডে কেয়ারে যাওয়া নোয়ার বাবা ও দক্ষ সংগঠক শুদ্ধ সংগীতশিল্পী বাপ্পী ভাইয়ের (সাজ্জাদ চৌধুরী) সঙ্গে। তিনি আমাকে রোববার সকালে আমার দুই সন্তানকে নিয়ে বাংলা স্কুলে যেতে অনুরোধ করলেন। এখনো মনে আছে তিনি বলেছিলেন, আমাদের বাচ্চারা যদি বাংলা বলতে না পারে, বাংলা কবিতা বা গান পড়তে আর গাইতে না পারে, সর্বোপরি আমাদের প্রিয় ভাষাকে ভালোবাসতে না পারে, তবে আমরা সবাই আমাদের শেকড়ের কাছে দায়ী থেকে যাব। সেই অনুরোধ রক্ষা করতে রোববারের ঘুম থেকেও নিজেকে নিবৃত্ত রেখে এক সকালে দুই সন্তানসহ ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলে হাজির হলাম। প্রথম দিনই স্কুলের সূচনা পর্ব সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন এই শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অগ্রজ আবদুল জলিল ভাই, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী আলোকিত মানুষ নাজমুল ভাই (নাজমুল আহসান খান) ও শাহ আলম ভাই প্রমুখ। জানলাম শুরুতে একটি মহলের অপপ্রচার আর বাধার মুখে পড়ে এই উদ্যোগ। কিন্তু প্রাণের মাতৃভাষা প্রসারের অদম্য ইচ্ছার কাছে এই অপচেষ্টা ভেসে যায়। সেই থেকে নিরবচ্ছিন্ন এই পথ চলা কখনো থেমে যায়নি। সিডনির বুকে এটিই একমাত্র বাংলা স্কুল যা এত দীর্ঘ সময় ধরে টিকে আছে। প্রথম দিকে আমি বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। একপর্যায়ে আমি স্কুলের পুরোটা সময়ই সেখানে থাকা শুরু করলাম। আমি লক্ষ্য করলাম সেখানকার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা এবং সর্বোপরি সেখানে আসা মানুষদের সঙ্গ আমি ভীষণভাবে উপভোগ করছি। রোববারের সকালের জন্য আমি সারা সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করে থাকতাম। বাসায় চা খেয়ে গেলেও বাংলা স্কুলে চা পান না করলে আমার তৃষ্ণা অতৃপ্ত থেকে যেত। ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল বছরব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। সে সমস্ত অনুষ্ঠানগুলোতে আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে যোগ দিতে থাকি। এক সময় নাজমুল ভাই, জলিল ভাই, শাহ আলম ভাই, মাসুদ মিথুন ভাই, স্বপন ভাই, সাগর ভাই, শুভ ভাই, বিজয় দা, রুমানা ভাবি, মুনা ভাবি ও বাপ্পী ভাইসহ অন্যরা আমাকে স্কুলের হয়ে কাজ করতে বলেন। ততক্ষণে আমি গভীর আবেগ, মমতা আর ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছি বাংলা স্কুলের সঙ্গে। এই ডাক উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার নেওয়া সব সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা আমি হলফ করে বলতে পারব না। তবে বাংলা স্কুলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত যে পুরোপুরি সঠিক সে ব্যাপারে আমি শতভাগ আশ্বস্ত। কেউ কোনো সংগঠনে যোগ দিলে সাধারণত পরিবারের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় না বিশেষত স্ত্রীদের অভিযোগ থাকে। কারণ এর ফলে সংসারে আগের মতো সময় দেওয়া হয় না। এই অভিযোগ বা অনুযোগের সত্যতাও হয়তো আছে। কিন্তু আমি ভাগ্যবান আমার ক্ষেত্রে এর উল্টোটা ঘটেছে। বাংলা স্কুলে আমার অনুভূতি আর আকর্ষণের পূর্ণ অনুরণন আমি দেখতে পেয়েছি দিশার মধ্যেও। যখন আমার কন্যাকে বলতে দেখি বাবা আমি ভেবে দেখলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সব গানই আসলে ভালো তখন আমি নিশ্চিত হই এখানে আসা আমার ভুল হয়নি। একই সূরে গান গাওয়া মানুষের সঙ্গ আমার সব সময়ের স্বাচ্ছন্দ্য, এখন অভিন্ন সূরের একঝাঁক মানুষের সাহচর্য আমার প্রতিদিনের আনন্দ। এই সংযুক্তি আমাকে ঘনিষ্ঠ করেছে প্রিয় মানুষ নাজমুল ভাই আর সন্ধ্যা ভাবির সঙ্গে। যাদের আমি মনে করি আমার অন্যতম অভিভাবক আর তাদের স্নেহ ভালোবাসায় আজ আমি সিক্ত। একজন ভাষা সংগ্রামীর সন্তান হয়ে মাতৃভাষা প্রসারে এই সামান্য প্রয়াসটুকু না নিলে হয়তো আমি আমার নিজের বিবেকের কাছে দায়ী থেকে যেতাম। আমার মতো আরও অনেকের আবেগ, মায়া আর মমতায় গড়া এই বাংলা স্কুল একদিন আরও বড় হবে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ভেসে আসা বাংলা মায়ের ডাক আমাদের সবার হৃদয়ে ঝংকার তুলে ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল চির জাগরুক থাকুক অনন্তকাল। আর/১৭:১৪/২৮ সেপ্টেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2xMK0tB
September 28, 2017 at 09:04PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন