সুরমা টাইমস ডেস্ক:: সিলেটে প্রশ্নবিদ্ধ গ্লোবাল বিজনেস কনভেনশনের আয়োজন নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্বল ব্যবস্থাপনা আর স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে শুরু হওয়া কনভেনশন নিয়ে তাই ক্ষোভ দেখিয়েছেন খোদ এনআরবিরাও। রয়েছে দুর্নীতি এবং টাকা লোপাটের অভিযোগও। অনুষ্ঠানের ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট এর ব্যায় নির্ধারণ ২ কোটি টাকা হলেও খরচের খাতে রয়েছে যথেষ্ট গড়মিল। স্পন্সর, এনআরবি রেজিস্ট্রেশন, বিসিসিআই, এসসিসিআই-সহ একাধিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত টাকার হিসেবেও নেই স্বচ্ছতা। এছাড়া বিসিসিআই’র উপর মামলা দায়েরের অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত প্রতিষ্টানের উদ্যোগে এমন আয়োজনকে ঘিরে তাই অনেক সন্দেহ দানা বেঁেধে উঠেছে।
শুরু থেকে আয়োজনের ব্যাপ্তিকাল সপ্তাহব্যাপী বলা হলেও বিভিন্ন তোরণে (২১-২৪) ৪ দিনের উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশ থেকে এনআরবিদের অংশ গ্রহণের কথা থাকলেও ১০টির উপরে দেশ তাতে অংশ নেয়নি। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠের ব্যবস্থা না থাকায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এ অনুষ্ঠানকে সাম্প্রদায়ীকরণ করা হয়েছে বলেও মন্তব্য অনেকের। তাছাড়া, সারাদেশের এনআরবিদের অংশগ্রহণের কথা আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হলেও সিলেট ছাড়া অন্য কোনো জেলার এনআরবিদের অংশ ছিলো না তাতে। আয়োজক সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিসিসিআই-এর সভাপতি এনাম আলী নান্টুর প্রতিও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এনাম আলী নান্টুর বিতর্কিত অনেক কর্মকা- উল্লেখ করে অনেক ব্যবসায়ীকে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। কোটি টাকা খরচ করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও শুরুতেই গাওয়া হয়নি দেশের জাতীয় সংগীত। অনুষ্ঠানের স্থান ক্রীড়া কমপ্লেক্স হলেও জেলা ক্রীড়া সংস্থার নেতৃবৃন্দ সেখানে ছিলেন উপেক্ষিত। স্মরণ করা হয়নি সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মোহিতের নাম। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন তাফসিরুল ইসলামকে অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথির আসনে দেখতে পাওয়ায় পুরো অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় চিহ্নিত এই ব্যক্তিকে অতিথির আসনে দেখে অনেকেই অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন বলেন জানা গেছে। খোদ অর্থপ্রতিমন্ত্রীও এ ব্যক্তির অংশগ্রহণ নিয়ে ক্ষোভ দেখিয়েছেন সভাস্থলে। জানা গেছে, ক্যাপ্টেন তাফসিরুল ইসলাম এনাম আলী নান্টুর নিকটাত্মীয়। অনেক ব্যবসায়ীর খেদোক্তি- কোটি কোটি টাকা খরচ ও ঘটা করে এই আয়োজনে সিলেট এবং ব্যবসায়ীদের জন্য আদৌ কি ইতিবাচক বার্তা বহন করে? স্পন্সর সহযোগিতায় দেশের বৃহৎ ১৫ টি প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ থাকলেও তাদের আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টিও সেখানে আড়াল করা হয়েছে অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা এনআরবিদের নিয়ে এই কনভেনশনের যাত্রা শুরু হলেও আয়োজকদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধুম্রজাল। নগরীর আবুল মাল আব্দুল মোহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে গত শনিবার জমকালোভাবে অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করা হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয় যথারীতি। পরে অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অর্থপ্রতিমন্ত্রীকে প্রধান অতিথির আসনে বসিয়ে সূচনা ঘটে অনুষ্ঠানের । শুরু থেকেই অগোছালো অনুষ্ঠান নিয়ে অনেকের মধ্যে নানা ক্ষোভ দেখা দিতে থাকে। অনুষ্ঠানে বিসিসিআই, এসসিসিআই এবং এনআরবিদের নির্ধারিত আসন বণ্ঠন করা থাকলেও সংবাদ কর্মীদের জন্য ছিলো না কোন নির্ধারিত আসন। কনভেনশন আয়োজনে সিলেট সিটি করপোরেশন থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকলেও সিসিক মেয়র অনুষ্ঠানে ছিলেন উপেক্ষিত। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বিষয়টি আঁচ করতে পেরে কনভেনশন স্থল ত্যাগ করলেও এসসিসিআই নের্তৃবৃন্দের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে পরে বিষয়টির সমাধান ঘটে। দেড় মাস পূর্ব থেকেই সপ্তাহব্যাপী এই আয়োজনের ব্যাপ্তিকাল উল্লেখ করা হলেও আয়োজকদের ইনডেস্ক অনুযায়ী তা ৩ দিন বলে লিপিবদ্ধ করা হয়।
কনভেনশন নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা সম্বলিত নেই কোন লিফলেট। বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার প্রদানের ঘোষণা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞাপন ছাড়া অন্য কিছুই চোখে পড়েনি। নেই বিনিয়োগ খাতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা। পর্যটন, শিল্প কল-কারখানাসহ বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্র উল্লেখ করা হলেও বিষয়ভিত্তিক প্রোফাইল তৈরী নেই কোনটিরই। এছাড়া, পরিবেশ বিধ্বংশী কর্মকা- রোধেও নেই তাদের পরিকল্পিত নির্দেশনা।
সিলেটে এই কনভেনশনের ব্যাপক আয়োজন নিয়ে প্রায় দেড় মাস পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি ছিলো আয়োজকদের। বিশেষ করে তৃতীয় প্রজন্মকে দেশের প্রতি বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতেই আয়োজকদের এমন উদ্যোগ ছিলো অনেকটাই প্রশংসার যোগ্য। এরই ধারাবাহিকতায় বিনিয়োগ বান্ধব বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরে একাধিক বৈঠকেরও আয়োজন করেন উদ্যোক্তারা। বৃটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স ও সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের যৌথ আয়োজনে সকল দেশেই এনআরবিদের রেজিস্ট্রেশনের আহবান জানানো হয়। তৃতীয় প্রজন্মের এনআরবি বলা হলেও মূলত আয়োজকদের আত্মীয়-স্বজন ব্যতীত তৃতীয় প্রজন্মের এনআরবিদের ছিলো না কোনো উপস্থিতি।
এই সহযাত্রায় স্পন্সর হয়ে আনন্দযাত্রায় শামিল হয় দেশের বৃহৎ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্টানগুলোর মধ্যে রয়েছে আর এফ এল, এনআরবিসি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ফুরা লিমিটেড, হোটেল টিএসি, বাংলাদেশ বিমান, গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেসন্স কোম্পানী, ব্র্যাক ব্যাংক (সাজান), ঢাকা রিগেন্সি সহ আরো বেশ কয়েকটি বৃহত প্রতিষ্টান। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে এটিএনবাংলা ইউকে’র সিলেট বিভাগীয় ব্যুরো,সাপ্তাহিক হলি সিলেটের সম্পাদক এবং এনআরবি মো.শফিকুল ইসলাম শফি পুরো অনুষ্ঠানটিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক উল্লেখ করে বলেন, গ্লোবাল কনভেনশন নামে সিলেটে একটি তামাশা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তিনি বলেন, যেখানে এনআরবিদের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি সেখানে সফলতার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে? আর সফলতার পেছনে উদ্দেশ্য থাকতে হয়- এখানে উদ্দেশ্য ছিলো পুরোটাই নিজেকে প্রচারের। সিলেট চেম্বার অব কমার্সও একইভাবে সে যাত্রায় শামিল হয়ে নিজেদের তুলে ধরতে প্রয়াস চালিয়েছে মাত্র। তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠান সিলেটের ব্যবসায়ীদের আদৌ কোনো কাজে আসবে না।
জানতে চাইলে গ্লোবাল বিজনেস কনভেনশন এর আহবায়ক ও এসসিসিআই’র পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, এনআবি রেজিস্ট্রেশন প্রায় সাড়ে সাত শত হয়েছে এবং এতে প্রায় ২৬ টি দেশ থেকে এনআরবিরা অংশ নিয়েছেন। অনুষ্ঠানে ১০ দেশ থেকে আসা এনআরবিদের সাথে কথা হয়েছে প্রতিবেদকের- এমন তথ্যে দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেন, “আমার কাছে তালিকা রয়েছে”। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় অথবা সিলেটবাসীর এ আয়োজনে কতোটুকু উপকৃত হবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলে, ‘আজ সমাপনি দিনে আইসিটি এবং পর্যটন বিষয়ে সেমিনার অনুষ্টিত হবে, আসলেই তা দেখতে পাবেন’।
সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন সেলিম বলেন, উদ্ধোধনী অনুষ্টানের পুরোটাই অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটে আন্তর্জাতিক মানের এই অনুষ্ঠান হলেও অনুষ্ঠানে স্মরণ করা হয়নি সিলেটের বরণীয় ব্যক্তিদের। এমনকি অর্থমন্ত্রীর মহানুভবতায় মাঠটির বরাদ্ধ পেলেও আয়োজকেরা ভুলেও সেই অর্থমন্ত্রীকে স্মরণ করেননি একবারও। জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্বে থাকা মাঠটিতে প্রতিদিন প্র্যাকটিসের পরিবর্তে মাঠ বরাদ্দ দিলেও আয়োজকদের পক্ষ থেকে মেলেনি শুভেচ্ছা স্বীকারোক্তি।
প্রাপ্ত অভিযোগ এবং কনভেনশন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিসিসিআই’র প্রেসিডেন্ট এনাম আলির মুঠো ফোনে একধিকবার চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য আদায় করা সম্ভব হয়নি।
গত ১৯শে অক্টোবর সিলেট চেম্বার কনফারেন্স হলে সিলেটে কর্মরত গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়ে আয়োজকদের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন বৃটিশ চেম্বার অব কমার্স এর সভাপতি এনাম আলী নান্টু। যদিও তাঁর কর্মকা- নিয়ে অনেক বিতর্ক আছেÑ সিলেটে এমনটাই জনশ্রুতি রয়েছে। ঐ সভায় অনুষ্ঠানে খরচের যোগান খাত বিষয়ে জানতে চাইলে কৌশলী এনাম আলী’র উত্তর ছিলো রহস্যাবৃত্ত।
এদিকে. কনভেনশন এর আহবায়ক নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আজ সিলেটে শেষ হচ্ছে এ আয়োজন। আগামীকাল মৌলভীবাজারে একই ভাবে এই কনভেনশন অনুষ্টিত হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। এর আগে গতকাল সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সামন থেকে এক বিশাল র্যালী নগরী প্রদক্ষিন শেষে আবুল মাল আব্দুল মোহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে গিয়ে শেষ হয়।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2izkvXu
October 24, 2017 at 08:59PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন