বিশেষ প্রতিবেদক:: অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক ছাত্রলীগ কর্মী খুন হচ্ছেন। কোন্দলের কারণে খুনোখুনি হয়, কিন্তু বিচার হয় না একটিরও! ‘ছাত্রলীগ’ দেশের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের অধিকারী ছাত্র সংগঠন। বাংলাদেশ হওয়ার প্রায় দুই যুগ আগে জন্ম নিয়েছিল সংগঠনটি। অর্থাৎ সংগঠনটি গড়ে ওঠে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার কয়েক মাসের মাথায়। ছাত্র সংগঠনটি আওয়ামী লীগ গঠন হওয়ার আগ পর্যন্ত মুসলিম লীগের সঙ্গে প্রায় বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রতিটা সংগ্রামে-আন্দোলনে তাদের ভূমিকা অতি-উজ্জ্বল, তাদের সেই অবদান বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ সেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এখন প্রায় নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন। এই ছাত্রলীগ কি সেই ছাত্রলীগ ?
সিলেট নগরীতে গত সাত বছরে ছাত্রলীগের হাতে ১০ জন খুন হয়েছেন। ২০১০ সালের ১২ই জুলাই নগরীর টিলাগড়ে অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে নিজ সংগঠনের ক্যাডারদের ছুরিকাঘাতে খুন হন উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এমসি কলেজের গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী ছিলেন উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটাই ছিল ছাত্রলীগের হাতে প্রথম প্রাণহানীর ঘটনা।
সর্বশেষ নগরীর টিলাগড়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ওমর আহমদ মিয়াদ নামের এক ছাত্রলীগকে ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয়। এর আগে ১৩ই সেপ্টেম্বর শিবগঞ্জে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছুরিকাঘাতে নিহত হন সংগঠনের আরেক কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম। এ নিয়ে গত সাত বছরে সিলেটে ছাত্রলীগের আটজন খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো অনেকে।
এভাবে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটলেও আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় তারা গ্রেপ্তার এড়িয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান। দুএকজন গ্রেপ্তার হলেও খুব দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসেন। এভাবেই বছরের পর বছর ঝুলে থাকে হত্যা মামলার বিচার।
সর্বশেষ গত সোমবার নগরীর টিলাগড়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হন ওমর আহমদ মিয়াদ। তিনি লিডিং ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ের ছাত্র। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার বাসিন্দা মিয়াদ বাবা আকুল মিয়াসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শহরতলির বালুচর এলাকা একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। গত ১৩ই সেপ্টেম্বর জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম হত্যার ঘটনায় পরের দিন এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা টিটু চৌধুরীসহ ২২ জনকে আসামি করে মামলা করেন তাঁর মা আতিয়া বেগম। মাসুম সিলেট ছাত্রলীগের সুরমা গ্রুপের অনুসারী আর আসামিরা সবাই টিলাগড় গ্রুপের অনুসারী। সূত্র জানায়, নগরীর টিলাগড়ে ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। টিলাগড় এলাকায় নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে একটি গ্রুপ আরেকটি গ্রুপের কর্মীদের প্রায়ই হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। টিলাগড়ে বেশ কয়েকবার ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি, মারামারি ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগের কোন্দলে খুনের পর খুন এইসব ঘটনায় স্থানীয় জনগন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাঝে সবসময় আতঙ্ক কাজ করে।
এর আগে ২০১০ সালের ১২ জুলাই নগরীর টিলাগড়ে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রলীগ কর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। ছাত্রলীগের আটজনসহ অজ্ঞাত আরো ১০-১৫ জন আসামির সবাই এখন জামিনে রয়েছেন। ২০১৪ সালের ১৪ই জুলাই নগরীর মদিনা মার্কেটে ইজিবাইকের (টমটম) স্ট্যান্ডের দখল নিয়ে ছাত্ররীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে আব্দুল্লাহ কচি নামের এক কর্মী খুন হন। এ মামলাটি এখন সিআইডিতে তদন্তাধীন।
২০১৪ সালের ২০শে নভেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রলীগ কর্মী সুমন চন্দ্র দাস। এ মামলাটিও এখন সিআইডি তদন্তাধীন। ২০১৫ সালের ১২ই আগস্ট সিলেট মদনমোহন কলেজ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজ দলের ক্যাডারদের ছুরিকাঘাতে খুন হন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ও মোগলাবাজার থানার সিলাম তেলিপাড়া গ্রামের আকলিস মিয়ার ছেলে আব্দুল আলী (১৯)। তিনি ছাত্রলীগের বিধান সাহা গ্রুপের কর্মী ছিলেন।
২০১৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি ছাত্রলীগের গ্রুপিংয়ে খুন হন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রলীগ কর্মী কাজী হাবিবুর রহমান। এ মামলার ১১জন আসামির সবাই জামিনে রয়েছে। চলতি বছরের ১৭ই জুলাই দুপুরে সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ছাত্রলীগ কর্মী খালেদ আহমদ লিটুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও বাকি তিনজন পলাতক বলে পুলিশ সূত্র জানায়। এ ব্যাপারে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ সুরমা টাইমসকে বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল মীমাংসা করে ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবুও নিজেদের অজান্তেই এই ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। তাই আমরা এখন থেকে কঠোর অবস্থানে থাকবো। তাছাড়া এই ধরণের ঘটনা যারা ঘটায় তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদানের ব্যাপারে আমরা প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুসা সুরমা টাইমসকে জানান, পুলিশের কাছে অপরাধী, অপরাধী বলেই বিবেচ্য হয়। অপরাধীর কোন দল নেই। তবে অনেক খুনের আসামি পলাতক থাকায় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করনে তিনি। খুনিরা গাঁ ঢাকা দেয়ার কারণে অভিযান দিয়েও গ্রেফতার করা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকটি মামলার অভিযোগপত্রও আদালতে দাখিল করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও অপরাধীদের ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকা সক্রিয়ই থাকবে। এব্যাপারে আওয়ামীলীগের শীর্ষ স্হানীয় কয়েকজন নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন,ছাত্র জীবনে আমরাও ছাত্রলীগ করে বর্তমান অবস্হানে এসেছি,আমরা সব সময় সিনিয়রদের কথা শুনেছি,তাদের নির্দেশনা মেনে চলেছি,তাদের সম্মান করেছি,কই তখনতো আমাদের মধ্যে এত বিশৃঙ্খলা ছিলো না। বর্তমান অবস্হা থেকে অতি সত্তর ছাত্রলীগকে বের হয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মীমাংসা করে তাদেরকে সুসংগঠিত হতে হবে। এখন হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় যে প্রানের ছাত্রলীগ করেছি -এই ছাত্রলীগ কি সেই ছাত্রলীগ?
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2gsP3t6
October 19, 2017 at 09:05PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন