নিজস্ব প্রতিবেদক ● বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর অন্তত অর্ধশত প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দেশটির কারাগারেও আটক করে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। সবশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর দৌলত ও সোহেল নামে দুই জনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। দেশে ফিরে পুনরায় জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে গত ১৫ অক্টোবর রাতে সবুজবাগ এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রশ্ন হলো, সিঙ্গাপুরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকরা কেন ও কিভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন? আর জঙ্গি সন্দেহে আটক হওয়া ও দেশে ফেরত পাঠানোর পরই বা তারা কি বলছেন?
জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন কর্মকর্তারা মনে করেন, বিষয়টি বাংলাদেশে জনশক্তি রফতানির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এজন্য তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করছেন বলে জানান। এমনকি অনুসন্ধানের প্রয়োজনে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) তিন সদস্যের একটি দল সিঙ্গাপুর যাওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আব্দুল মান্নান বলছেন, ‘সিঙ্গাপুরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক বেশি তৎপর। প্রবাসী শ্রমিকদের জঙ্গিবাদে উস্কানিমূলক বা সামান্যতম সম্পৃক্ততার অভিযোগ পেলেও তাদের আটক করে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কারণ তারা এই বিষয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। সিঙ্গাপুরের প্রবাসী শ্রমিকরা কেন জঙ্গিবাদের দিকে যাচ্ছে আমরা এর কারণ উদ্ধারের চেষ্টা করছি।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ‘জঙ্গি সন্দেহে ফেরত পাঠানো শ্রমিকদের বেশিরভাগই স্বল্প শিক্ষিত। দেশের বাইরে গিয়ে কাজের পাশাপাশি তারা ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতেন বেশি। এই সুযোগে বাংলাদেশে সক্রিয় আনসার আল ইসলাম ও নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা তাদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকে।’
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রথমে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদেরকে। ধর্মভীরু মুসলিম হওয়ায় দাওয়াতকে সহজভাবেই নিচ্ছেন তারা।
পরবর্তীতে তাদেরকে জসিমউদ্দিন রাহমানীর কিছু অডিও লেকচার শোনানো হয়। যেখানে সারা দুনিয়ায় মুসলিমদের ওপর অত্যাচার-জুলুমের বিষয়গুলো আলোচনা করে নিজ দেশেও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ওপর আলোচনা চলতে থাকে। ছোট ছোট গ্রুপ করে স্থানীয় মসজিদগুলোতে কোরআন-হাদীসের আলোচনার নামে চলতে থাকে জঙ্গিবাদি কার্যক্রম। এমনকি সদস্যদের চাঁদা দিয়ে তারা তহবিল তৈরির প্রক্রিয়াও শুরু করে। এরপর সংগঠিত করতে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রচারণা চালানো শুরু করে।’
সিঙ্গপুর থেকে জঙ্গি সন্দেহে আটক হওয়ার পর ফিরে আসা অন্তত ২৭ জনকে পৃথক পাঁচটি মামলায় গ্রেফতার করেছিল সিটিটিসি। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের হওয়া এসব মামলা এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন— উপ-কমিশনার ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার পর্যায়ের দু’জন কর্মকর্তাসহ তিন জনের একটি দল প্রবাসী শ্রমিকদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণ খুঁজতে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুরে গিয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার এই প্রবণতা শুরু হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের প্রভাবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার পাশাপাশি সিঙ্গাপুরে থাকা প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যেও এই প্রবণতা শুরু হয়। তবে গত বছরের শেষের দিকে দেশটির পুলিশ একসঙ্গে ২৭ জনকে আটকের পর একজন বাদে ২৬ জনকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এই ২৬ জনকেই আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ১২ জনকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয় পুলিশ। বাকি ১৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠায় সিটিটিসি ইউনিট। এছাড়া চলতি বছরের শুরু থেকে আরও অন্তত ১৫ জনকে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর পুলিশ।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা স্বল্পশিক্ষিত হওয়ায় তাদের মধ্যে সচেতনতা বোধ কম। অনেকে সত্যিকার অর্থে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়লেও কেউ কেউ নিছক কৌত‚হল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জিহাদি উপকরণ শেয়ার দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। সিঙ্গাপুর পুলিশ প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনেক বেশি এগিয়ে থাকায় সহজেই এদেরকে শনাক্ত করে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। প্রবাসী শ্রমিকদের কেউ যেন কৌত‚হলী হয়ে জঙ্গিবাদে না জড়ায় সেজন্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যকর আলোচনা চলছে বলে জানান সিটিটিসির ওই কর্মকর্তা।
এদিকে সবশেষ জঙ্গি সন্দেহে সিঙ্গাপুরে আটক হওয়ার পর যে দুই শ্রমিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলছেন— মিজানুর রহমান নামে এক প্রবাসী ব্যবসায়ীর মাধ্যমে তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন। মিজানুর অনেক বছর ধরে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন জানালেও বাংলাদেশে তার বিস্তারিত পরিচয় জানাতে পারেননি তারা।
এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান বলেছেন, ‘সিঙ্গাপুরে জঙ্গিদের একটি গ্রুপ বিশেষ সক্রিয়। যারা শ্রমিকদের ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল বুঝিয়ে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন একটি গ্রুপের শীর্ষনেতাদের সন্ধান পেয়েছেন তারা। মিজানুর রহমান নামে ওই ব্যক্তি বর্তমানে সিঙ্গাপুরের কারাগারে আটক আছেন।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, তারা শ্রমিকদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণ জানার জন্য বিস্তারিত অনুসন্ধান করতে চান। এজন্য তাদের হাতে গ্রেফতার হওয়া দৌলত ও সোহেলের মামলাটি নিজেরা তদন্ত করতে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠিয়েছেন। দৌলত ও সোহেলের সূত্র ধরে সিঙ্গাপুরের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকারী গ্রুপটিকে শনাক্ত করতে চান তারা।
The post সিঙ্গাপুরে প্রবাসী শ্রমিকরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে যেভাবে appeared first on Comillar Barta | দেশ সেরা আঞ্চলিক অনলাইন পত্রিকা.
from Comillar Barta | দেশ সেরা আঞ্চলিক অনলাইন পত্রিকা http://ift.tt/2yEd2wd
October 20, 2017 at 09:35PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন