কুমিল্লার বার্তা ডেস্ক ● সিঙ্গাপুর চাংগি এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই মনো রেলযোগে ফেরারপার্ক স্টেশন পৌচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে কয়েক তলা উপরে ওঠা মাত্র দেখা মেলে পৃথিবীর আলো-বাতাসের। মাটির নিচে চলাচলকারী এ সব রেলপথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা চলাচল করেন। ট্রেনগুলো ১৮০ কিলোমিটার দ্রুতগামী, যা বাস্তবে না দেখলে বোঝা যাবে না। দেশটির রাস্তাঘাট, মার্কেট, দোকানপাট এতটাই উন্নত- রাস্তায় কোনো ময়লা-আবর্জনা নেই। নেই সিগারেটের খোসাও। চিকচাক শহর। লাল-নীল বাতি জ্বলছে। যেন আলোকিত চারপাশ।
ফেরারপার্ক স্টেশন থেকে নেমেই ৫ মিনিটের পথ মুস্তাফা প্লাজা। মুস্তাফা প্লাজাসংলগ্নই বিখ্যাত মিনি মাঠ। এটিই হলো বাংলাদেশিদের মিলনমেলা। প্রাণকেন্দ্র। যেন সিঙ্গাপুরে একটি মিনি বাংলাদেশ। একটি ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুর। যার পুরোটাই শহর। এ শহরে প্রিয়জনকে ছেড়ে যে সব বাংলাদেশি ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে অবস্থান করেন তারা প্রতি রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করতে আসেন মিনি মাঠে। যেমন- ভারতীয়রা আসেন লিটল ইন্ডিয়ায়। চীনারা আসেন চায়না টাউনে। কেননা, এখানে এলে বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হবেই।
এ মাঠে এক ঘণ্টা পরপরই চলে পুলিশি টহল। সন্দেহ হলেই জিজ্ঞাসা করে কোম্পানির কার্ড কিংবা ভিসা দেখাতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিরা ভিসা প্রদর্শন করে থাকেন। প্রতি রোববার দেশের খবরাখবর, প্রিয়জনের সঙ্গে আলাপ, দেশে টাকা পাঠানো, শপিং করা, সবার সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, কাঁচা বাজার করা আর দেশি খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা যায় এখানে। এককথায় এখানে দেখা যায় পুরো বাংলাদেশকে।
এ মিনি মাঠকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাঙালিদের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। যেমন- খানা বাসমতি রেস্টুরেন্ট, বৈশাখী রেস্টুরেন্ট, ঢাকা রেস্টুরেন্ট, মোহাম্মদিয়া রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। এ গুলো সব খাবারের হোটেল। এখানে অবিকল বাংলা খাবারের ভর্তা, ভাজি, খিচুড়ি, খাসি ও মুরগির মাংসসহ বিভিন্ন ধরনের মাছও পাওয়া যায়।
পাশাপাশি রয়েছে পান-সিগারেটের দোকান, ফলের দোকান, তরিতরকারির দোকান, মোবাইল সিম এবং ইন্টারনেটের দোকানও। এখানে যে কোনো দিন গেলেই বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হবে। তবে সিঙ্গাপুরে সাপ্তাহিক ছুটি রোববার। এ দিন মিনি মাঠে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় বাঙালিদের নতুন কেউ এখানে এলেই অনেকেই সহযোগিতা করতে ব্যাকুল হয়ে যান। দেশের টানেই যেন এমনটা।
রায়হানুল, বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায়। থাকেন সিঙ্গাপুরের মিনি মাঠ এলাকায়। তিনি জানালেন, ২ থেকে ৩ লাখ বাংলাদেশি থাকেন সিঙ্গাপুরে। এদের বেশিরভাগই নির্মাণশ্রমিক। অন্য পেশায়ও আছেন। যেসব বাঙালি সিঙ্গাপুরে নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তারাই মূলত দোকান বা ব্যবসা করেন।
তবে এখানে ব্যক্তি মালিকানায় কোনো সম্পত্তি নেই। সব রাষ্ট্রের। এখানে সিঙ্গাপুরি কিংবা বাঙালি অথবা ভারতীয়- সবাই সরকারের কাছ থেকে জায়গা বা সম্পত্তি লিজ নিয়ে থাকেন। তারপর বিভিন্ন ব্যবসা করেন।
রায়হানুল জানান, সিঙ্গাপুরে বাঙালি, ইন্ডিয়া, চায়না, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারের বেশিরভাগ লোকজনই কাজ করেন। এ সব শ্রমিককে বেশিরভাগই কোম্পানি থাকার জায়গা ঠিক করে দেন এবং তারা সেখানেই থাকেন। আর মুস্তাফা প্লাজা সিঙ্গাপুরের দ্বিতীয় বৃহত্তম মার্কেট। এ প্লাজার মালিক হলেন একজন মুসলিম ইন্ডিয়ান তামিল। রায়হানুল জানান, সিঙ্গাপুরে বাঙালি শ্রমিকরা গড়ে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা উপার্জন করেন। পরিশ্রমও অনেক। কিন্তু এত পরিশ্রমের পর বেতনটা পেলে ভালো লাগে। কাজ শেষে রান্না করতে আর ইচ্ছা করে না। এটা অনেক কষ্টের কাজ। অবশ্য যাদের কপালে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব মিলেছে, তারা পরিবার নিয়ে থাকতে পারেন। তাদের এ সমস্যা নেই।
চাংগি এয়ারপোর্ট থেকে যখন মুস্তাফা প্লাজায় পৌঁছাই তখন সকাল ৭টা। প্লাজার এক ক্যাফেতে বসে আমার পরিচিতজনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
এক চটপটে কিশোর বাঙালির সঙ্গে দেখা। নাম রিপন। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আধুনিক হেয়ার কাট। পরনে গেঞ্জি ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। পায়ে কেডস। সবেমাত্র জগিং করে ক্যাফেতে বসেছে। আমাদের দেখেই ওর আর বুঝতে বাকি রইলো না। বললো, কাউকে খুঁজছেন? বললাম, হ্যাঁ। কোন হোটেলে উঠবেন? বললাম, এখনও ঠিক করিনি। সমস্যা হলে আমাকে বলবেন। আমার সব জানাশোনা। এখানে কম দামের ও বেশি দামের দুই ধরনের হোটেল আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী? বললো, রিপন। বাড়ি কোথায় বলতেই মুচকি হাসি। রহস্য বাড়লো।
আবার জানতে চাইলাম। এবার বললো নোয়াখালী। আমি একটু হাসতেই সেও বললো অনেকেই বলতে চায় না। কিন্তু আমি বলি। বললাম, অবশ্যই বলতে হবে। এতে কোনো সমস্যা নেই। এটাই তোমার পরিচিতি। এরপর আমাদের পরিচিতজন এলে আমরা রয়্যাল রয়েল ইন্ডিয়া হোটেলে উঠলাম। রিপনও আমাদের সঙ্গে এলো। এখানেও এক অবাক কাণ্ড। হোটেলের মালিক, ম্যানেজার থেকে প্রতিটি কক্ষ ওর পরিচিত। সবাইকে সে চেনে। সবার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক।
এরপর আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে এসে সবকিছু বুঝিয়ে বলল, আমি এখন আসি। সমস্যায় পড়লে ডাকবেন। আমি এ এলাকায় থাকি। আমার সঙ্গে আপনাদের দেখা হবে। খোঁজা লাগবে না। না পেলে মোহাম্মদীয়া হোটেলে জিজ্ঞেস করবেন। এরপর অন্ততপক্ষে ১০ বার রিপনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এমনকি বিদায় বেলায়ও আমাদের মালয়েশিয়াগামী বাসের টিকিট কেটে দিয়েছে, বাসে খাবার জন্য পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এত ভালোবাসা ও সৌজন্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কিছু ডলার দিতে চাইলে রিপন গ্রহণ করেনি। বললো- আমি সবার জন্যই এ কাজ করি।
দুপুরে মিনি মাঠসংলগ্ন বাঙালি হোটেলে খাবার সেরে মাঠের বেঞ্চে বসেছিলাম। বেশ কয়েকজন বাঙালি মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। এ সময় কথা হয় সিঙ্গাপুর প্রবাসী কুমিল্লার কাজলের সঙ্গে। তিনি একটি স্পোর্টস কারখানায় কাজ করেন। জানালেন, এখানে এলে বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হবেই। দেশের খবরাখবর, প্রিয়জনের সঙ্গে আলাপ, দেশে টাকা পাঠানো, শপিং করা, সবার সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, কাঁচাবাজার করা আর দেশি খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা যায়।
এমনকি অলস সময় কাটাতেও আসেন অনেকে। সর্বোপরি এটা আরেক বাংলাদেশ। সুযোগ পেলেই এখানে বাংলাদেশিরা আসেন।
তিনি বলেন, এখানে কষ্ট করলে টাকা পওয়া যায়। এখানে লাইফ আছে। লাইফের সিকিউরিটি অর্থাৎ প্রতিটি শ্রমিকের ইনস্যুরেন্স আছে। তবে অনেক শ্রমিক বেকার আছে। তাদের কষ্ট হয়। বিশেষ করে যারা নতুন আসেন চাকরি না নিয়ে, তাদেরও সমস্যা হয়। বর্তমানে সিঙ্গাপুরে আসতে ৯ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগে। যা ওঠাতেই ২ থেকে ৩ বছর লেগে যায়। তবে যারা পুরনো বিশেষ করে আগে এসেছেন, তারা ভালো আছেন।
উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুর দৃষ্টিনন্দন জায়গা মেরিনা বে, চায়না টাউন, পার্কভিউ, ইকোপার্ক, সন্তোসার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সন্তোসা দিয়ে স্টিমার যোগে ৪৫ মিনিটে ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়া যায়।
The post সিঙ্গাপুরে মিনি বাংলাদেশ appeared first on Comillar Barta | দেশ সেরা আঞ্চলিক অনলাইন পত্রিকা.
from Comillar Barta | দেশ সেরা আঞ্চলিক অনলাইন পত্রিকা http://ift.tt/2gTQHEr
October 29, 2017 at 07:33PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন