নিজস্ব প্রতিনিধি:: আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। আমাদের জাতীয় সংগীতের প্রথম চরণ। এই সংগীত দেশের প্রতি ভালবাসা আর জাতিসত্তা প্রকাশের মাধ্যমও বটে। সংবিধান অনুযায়ী এর পরিবেশনায় আছে কিছু আনুষ্ঠানিকতা, আছে নিয়মকানুন। কিন্তু মাঝে মধ্যে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই অনেক স্থানে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করতে দেখা যায়। এমনই একটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছেন স্কলার্সহোম পাঠানটুলা ক্যাম্পাসের কয়েকজন সচেতন অভিভাবক।
সিলেট নগরীর অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কলার্সহোম-এর পাঠানটুলা ক্যাম্পাসে (প্রাথমিক শাখায়) নিয়ম না মেনে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়, যে কারণে সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে এমন অভিযোগ করেছেন কয়েকজন অভিভাবক। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা কয়েকবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপও করেছেন কিন্তু ফল হয়নি বরং উল্টো তাদেরকেই হেনস্তা হতে হয়েছে।
অবশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে সচেতন অভিভাবকবৃন্দের পক্ষে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফুজায়েল আহমদ এবং ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করলেন।
অভিযোগে তাঁরা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সংবিধানে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সোজা হয়ে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া আছে, কিন্তু সিলেটের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কলার্সহোম কর্তৃপক্ষ জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় ডান হাত বাম বুকের উপর রেখে পরিবেশন করার জন্য শিক্ষক, শিক্ষিকা ও ছাত্র/ছাত্রীদেরকে বাধ্য করছেন। যা বাংলাদেশ সংবিধান বিরোধী এবং এই শিক্ষার ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভুল শিক্ষার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে স্কলার্সহোম কর্তৃপক্ষ যেন তাদের ভুল চিন্তা ভাবনা থেকে সরে এসে বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন এটাই প্রত্যাশা করছেন অভিভাকেরা।
সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জগদীষ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গেয়ে এসেছি। ডান হাত বাম বুকের উপরে রেখে শিক্ষার্থীরা তাতে অংশ নেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না না সিলেট সরকারী পাইলট স্কুলেও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সবাই সোজা হয়ে দাঁড়াই।
বড়লেখা নারীশিক্ষা একাডেমি ডিগ্রি কলেজের ইংরেজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মোশাররফ হোসেন সবুজ সুরমা টাইমস কে বলেন, বিশ্বের কোথাও কোথাও ডান হাত বাম বুকের উপর রেখে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করতে দেখা যায়। আমাদের দেশে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুকে হাত দিয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করতে আমি দেখিনি। সংগীত পরিবেশনের সময় সবাইকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাম্ভীর্য প্রকাশ করতে দেখেছি। জাতীয় সংগীত যেহেতু আমাদের সংবিধান নির্দেশিত একটি বিষয়, সেহেতু রাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী যথাযথ নিয়ম মেনে তা পরিবেশন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে স্কলার্সহোমের এক অভিভাবক বললেন, ছোটবেলায় স্কুলে পিটি করার সময় জাতীয় সংগীত গাইতাম। পিটিতে আমরা দুইহাত (মুষ্টিবদ্ধ অথবা খোলা) রানের কাছে চেপে ধরে দুপায়ের মাঝে চার আঙ্গুল ফাঁক রেখে সটান সামনের দিকে তাকিয়ে হেড়ে গলায় গাইতাম। জানতাম সেটাই হলো নিয়ম। এভাবে দাঁড়িয়েই জাতীয় সংগীত গাইতে হয় অথবা জাতীয় সংগীত গাইবার সময় এ ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে গাওয়াটাই নিয়ম।
কিন্তু আজকাল টেলিভিশনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে দেখা যায় বুকে হাত রেখে জাতীয় সংগীত গাইতে। খটকা লাগে। জাতীয় সংগীত দাঁড়িয়ে গাইবার এই ভঙ্গি তো আমারদের নয়। নিয়ম কি বদলে গেল? কেউ সোজা দাঁড়িয়ে গাইবে আর কেউ বুকে হাত দিয়ে গাইবে কেন? যেটা সংবিধানে আছে সেটাই সকলের করা উচিত।
বাংলাদেশ স্কাউট সিলেট আঞ্চলের কমিশনার মুবিন আহমদ জায়গীরদার বলেন, সারাজীবন স্কাউটের সাথে কাটালাম। বুকে হাত রেখে জাতীয় সংগীত কখনো গাইনি। তবে সিলেটের একটি স্কুলে আমি এমন নিয়ম দেখে প্রতিবাদ করেছিলাম। এতোদিন যেভাবে সবাই এটেনশন মুডে গেয়েছেন এখনো তেমন গাইবেন।
স্কলার্সহোমের এমডি প্রফেসর কবীর চৌধুরীর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তিনি বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশকে গভীর ভাবে ভালবাসি। দেশের প্রতি গভীর ভালবাসা থেকেই আমরা জাতীয় সংগীত গাইবার সময় ডান হাতটি বাম বুকের উপরে রাখি। তিনি আরো বলেন, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাওয়াটা সঠিক আর বুকে হাত দিয়ে গাওয়াটা ভুল এই বিষয়টির দালিলিক প্রমাণ পেলে আমি সংশোধন করে নিবো।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) আবু সাফায়াৎ মুহম্মদ শাহেদুল ইসলাম সুরমা টাইমস কে বলেন, স্কলার্সহোম-এ বুকে হাত দিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার বিষয়টি আমাদের লিখিত ভাবে অভিহিত করা হয়েছে। আমরা সরেজমিন তদন্ত করে বিষয়টি দেখবো। জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় বুকে হাত দিয়ে গাইতে হবে বিষয়টি আমাদের সংবিধানে নেই। উনারা কোথায় পেলেন সেটাই খতিয়ে দেখা হবে।
১৯৭৮ সালেই জাতীয় সংগীত বিধিমালা-১৯৭৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী জাতীয় সংগীত উপস্থাপনের কিছু নিয়ম রয়েছে। ২৫ লাইনের এই গানটির ১০ লাইনকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত।
‘জাতীয় সংগীতের’ অবমাননা ঠেকাতেই কয়েকবছর আগে হাইকোর্টের একটি রিট হয়েছিল। তাতে বলা হয় মোবাইল ফোনের রিংটোন হিসেবে জাতীয় সংগীত ব্যাবহার করা যাবে না কারণ এটি অর্ধেক হবার পরেই কেটে যায় এবং এতে করে জাতীয় সংগীতের অবমাননা হয়।
উল্লেখ্য, আমার সোনার বাংলা গানটি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। এ গানের রচয়িতা ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি রচিত হয়েছিল। ১২ই জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ লাইন সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2hMf7jD
November 20, 2017 at 09:27PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন