বিশেষ প্রতিবেদন:: নানা দুর্যোগ-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ২০১৭ সাল পার করেছে সিলেট। তবুও সফলতার পাল্লাই ভারি। বছর শেষে সিলেটের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব কষলে দেখা যায়, প্রাপ্তিই বেশি। বছরের শুরুতে সিলেটের ‘আতিয়া মহল’ দেশ কাঁপালেও শেষ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির বিশ্ব স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। সমাদৃত হয়েছে গোটা বিশ্বে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই নানান প্রাপ্তি যোগ হতে থাকে। বছরের শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। এ বছরে সিলেটে বড় অর্জনের মধ্যে ছিল তামাবিল স্থলবন্দর উদ্বোধন, সিলেট বিভাগকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা, ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সিসিকের নতুন ভবন নির্মাণ, সিলেট সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ শতভাগ বিদ্যুতায়ন, এইচএসসিতে পাসের হারে দেশসেরার স্থান, বছরের শেষে সিলেটের শীতলপাটির বিশ্ব স্বীকৃতিসহ অনেক কিছু।
বছরের শুরুতেই দেশ কাঁপায় আতিয়া মহল:- চলতি বছরের প্রথমদিকে দেশ কাঁপিয়েছে সিলেটের আতিয়া মহল। গত ২৪শে মার্চ আতিয়া মহলে অভিযান শুরু করে পুলিশ। পাঁচ দিনের ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’-এ সফল সমাপ্তি হয়েছিল জঙ্গিবিরোধী অভিযানের। প্রশংসা কুড়িয়েছিল সেনাবাহিনীর কমান্ডো ইউনিট। কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই তারা আতিয়া মহলে আটকে পড়া ৭৮ বাসিন্দাকে নিরাপদে উদ্ধার করেছিল। তবে বাইরে পুঁতে রাখা বোমায় র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান ও দুই ইন্সপেক্টরের নিহত হওয়ার ঘটনায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে সবার। আতিয়া মহলের মামলা এখন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) তদন্তাধীন।
শীতলপাটির বিশ্ব স্বীকৃতি:- বছরের শেষদিকে আসে সিলেটের শীতলপাটির বিশ্ব স্বীকৃতি। গত ৬ই ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ইউনেস্কোর ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ (আইসিএইচ) কমিটির ১২তম অধিবেশনে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটিকে বিশ্বের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-২০১৭ (দি ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
সিলেট বিভাগকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা:- এদিকে চলতি বছরের গত ২৪শে মে সিলেট বিভাগকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। রিকাবীবাজারের কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শত শত শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে শপথগ্রহণ করে। একই সময়ে বিভাগের অন্য তিন জেলায়ও এ ঘোষণা দেয়া হয়।
তামাবিল স্থলবন্দর উদ্বোধন:- প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট তামাবিল স্থলবন্দরের উদ্বোধন হয় চলতি বছরের গত ২৭শে অক্টোবর। ২৩ দশমিক ৭২ একর ভূমির মধ্যে ৬৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিলেট তামাবিল স্থলবন্দরের উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এটি চালু হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশ উপকৃত হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
সিসিকের নতুন ভবন:- বিগত পাঁচ বছর ধরে অস্থায়ী ভবনে চলছিল সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) কার্যক্রম। প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক ঝকঝকে নতুন ভবনের কাজ ২০১৭ সালে শেষ হয়।
সিলেট সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ শতভাগ বিদ্যুতায়ন:- গত ১০ই সেপ্টেম্বর সিলেটের সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই উপজেলাগুলোয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
বছরজুড়ে আলোচনায় রাগীব আলী:- সিলেট অঞ্চলে বিত্তবান বোঝাতে রাগীব আলীর নাম ব্যবহৃত হয় উপমা হিসেবে। নিজস্ব অনুসারী ও শুভাকাক্সক্ষীদের কাছে তার বিশেষণের শেষ নেই। জালিয়াতির কারনে কথিত দানবীর রাগীব আলীকে পুত্রসহ কারাগারে যেতে হয় ২০১৭ সালে। এরপর গত ২৯শে অক্টোবর ছেলেসহ জামিনে কারামুক্ত হন তিনি। সিলেটের তারাপুর চা-বাগানের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর সিলেট সদরের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসএম আবদুল কাদের আদালতে রাগীব আলী, তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও জামাতার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন।
পরবর্তীকালে রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই উচ্চ আদালতে রিট করলে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হাইকোর্টের আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ তারাপুর চা-বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ৬ মাসের মধ্যে অপসারণ করে চা-বাগান সৃজন এবং প্রকৃত সেবায়েতের কাছে বাগানটি হস্তান্তরের আদেশ দেন। একই সঙ্গে স্থগিত হওয়া মামলাগুলো পুনরায় সক্রিয় করারও নির্দেশনা দেন আদালত।
আপিল বিভাগের ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের (২০১৬) ১৫ই মে সিলেট জেলা প্রশাসন রাগীব আলীর কাছ থেকে তারাপুর চা-বাগানটি উদ্ধার করে দেবোত্তর সম্পত্তির প্রকৃত সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয়। এ ছাড়া দেবোত্তর সম্পত্তিতে নির্মিত মেডিকেল কলেজ, হাসপাতালসহ সব স্থাপনা সরিয়ে নেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়। যদিও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন অদৃশ্য কারণে এখনও হয়নি।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে তারাপুর চা-বাগানের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল ও আত্মসাতের অভিযোগে দায়েরকৃত দুটি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় ২০১৬ সালের ১০ই জুলাই। এ মামলার চার্জশিটের শুনানির পর আদালত রাগীব আলীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
পরোয়ানাভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন:- তারাপুর চা-বাগানের সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত, রাগীব আলীর আত্মীয় মৌলভীবাজারের রাজনগরের বাসিন্দা দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই, মেয়ে রুজিনা কাদির ও জামাতা আবদুল কাদির। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির দিনই ছেলেসহ ভারতে পালিয়ে যান রাগীব আলী। গত ২৪শে নভেম্বর ভারতের ইমিগ্রেশন পুলিশ রাগীব আলীকে আটক করে। পরে তাকে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সিলেটের ডাক পত্রিকার অনুমোদন বাতিল ও স্থগিত:- কথিত দানবীর রাগীব আলীর মালিকানাধীন ‘দৈনিক সিলেটের ডাক’-এর অনুমোদন বাতিল করেন জেলা প্রশাসন। চলতি বছরের ১৮ই জুন আদালতে মামলার রায়ে সিলেটের ডাকের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি রাগীব আলী ও তার ছেলে পত্রিকার সম্পাদক আবদুল হাই দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়। পরে গত ২৯শে নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর এবং আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সিলেটের জেলা প্রশাসক কর্তৃক পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিলের আদেশ তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন।
এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগকারীরা শনাক্ত:- সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনায় ৩২ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের বিরোধের কারণেই মূলত এ নাশকতা চালানো হয়েছে বলে তদন্তে জানা গেছে।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2zTw8LK
December 31, 2017 at 11:23PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন