সুরমা টাইমস ডেস্কঃঃ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রতিক্রিয়ায় প্রায় সারা বিশ্ব যখন সোচ্চার তখন চুপ থাকতে পারেনি সৌদি আরবও। উপসাগরীয় ও আরব দেশগুলোর প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় রিয়াদও ওই ঘোষণাকে অন্যায্য ও দায়িত্বহীন আখ্যা দিয়েছে। তবে এরইমধ্যে জেরুজালেম সংক্রান্ত খবর প্রকাশে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে দেশটিতে। জর্ডানে থাকা সৌদি নাগরিকদের বলা হয়েছে প্রতিবাদ না করতে। এমন প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, রিয়াদ আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে অংশীদার হিসেবেই কাজ করছে। এছাড়া সৌদি যুবরাজের কথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে মার্কিন মদদ, মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে ট্রাম্পের অবস্থান মানতে মাহমুদ আব্বাসকে চাপ দেওয়া এবং ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে বসে মার্কিন স্টাইলের শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর আলোচনার মতো বিষয়গুলোও সামনে এসেছে পূর্ববর্তী কিছু প্রতিবেদনে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করায় মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভে ফুঁসলেও এ ইস্যুতে দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের পাশেই থাকছে সৌদি আরব। ট্রাম্পের ওই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদ জানিয়েই ‘দায়িত্ব’ শেষ করেছে দেশটি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, রিয়াদ এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে অংশীদার হিসেবে কাজ করছে।
গত ৬ই ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করেন ট্রাম্প। প্রতিক্রিয়ায় ওই ঘোষণাকে ‘অন্যায্য ও দায়িত্বহীন’ সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করে সৌদি রয়েল কোর্ট। এই একই রয়েল কোর্ট একইসঙ্গে নিজ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর ট্রাম্পের এ স্বীকৃতি সংক্রান্ত খবর প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের সম্পাদকদের কাছে এ বিষয়ে নোটিস পাঠানো হয়েছে। এতে জেরুজালেম নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের খবর বেশি সময় ধরে প্রচার না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আল আকসা মসজিদের জিম্মাদার জর্ডানে ব্যাপক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ওই ঘোষণার পরদিনই জর্ডানের সৌদি দূতাবাস থেকে দেশটিতে অবস্থানরত সৌদি নাগরিকদের ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ না নিতে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
জর্ডানের সৌদি দূতাবাসের অফিসিয়াল টুইটারে দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়েছে, নিরাপত্তাজনিত কারণে জর্ডানে অবস্থানরত সৌদি নাগরিক এবং দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সৌদি শিক্ষার্থীদের জনসমাগম ও বিক্ষোভ থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
সৌদি আরব এখন যুক্তরাষ্ট্রের যে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে এগুচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে সেটি নতুন কিছু নয়। গত নভেম্বরে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের রিয়াদ সফরকালে তাকে এ পরিকল্পনার ব্যাপারে অবহিত করেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ইহুদি ধর্মাবলম্বী জামাতা জ্যারেড কুশনার ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে একটি শান্তি পরিকল্পনা প্রত্যাশা করছেন। এ বিষয়ে অবস্থান জানাতে ফিলিস্তিনি নেতাকে দুই মাসের সময় বেঁধে দেন সৌদি যুবরাজ।
সৌদি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা না রেখে এবং জেরুজালেমকে রাজধানীর স্বীকৃতি না দিয়ে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা হবে। পূর্ব জেরুজালেমের বদলে এ রাষ্ট্রের রাজধানী হবে আবু দিস নামের একটি ফিলিস্তিনি এলাকা।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, এ প্রস্তাব মূলত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনার অংশবিশেষ। মাহমুদ আব্বাস ও সৌদি যুবরাজের কথোপকথন শুনেছেন এমন এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমমটি বলছে, সৌদি আরব আব্বাসকে এমন একটি পরিকল্পনা দিয়েছে যা কোনও ফিলিস্তিনি নেতা গ্রহণ করতে পারেন না।
সৌদি আরবের প্রস্তাবে গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরের কিছু অংশে সীমিত ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্ব, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য ফেরার অধিকার না রাখা, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা না করা এবং পশ্চিম তীরের বেশিরভাগ ইহুদি বসতি অক্ষুণ্ন রাখার কথা বলা হয়েছে।
এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ফলে যেসব মানুষ শরণার্থী হয়েছেন তাদের আর নিজ ভূমিতে ফেরার কোনও সুযোগ থাকবে না।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ওই প্রস্তাব নিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন ফিলিস্তিনের চার কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তারা জানান, ওই প্রস্তাব নিয়ে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মধ্যে ব্যাপক দর কষাকষি হয়েছে। তবে সৌদি যুবরাজ মাহমুদ আব্বাসকে আশ্বস্ত করে বলেন, ধৈর্য ধরুন। আপনি ভালো খবরই পাবেন। শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সম্পর্কে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। তবে দুই দেশের অভিন্ন শত্রু ইরানকে মোকাবিলায়ই এর একমাত্র কারণ নয়। বরং ট্রাম্পের ইসরায়েলবান্ধব জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে সৌদি যুবরাজের সম্পর্ক বেশ গভীর। মূলত কুশনারের সঙ্গে সম্পর্কের জেরেই নিজ দেশে রাজপরিবারের সদস্যদের ওপর গণগ্রেফতার চালানোর মতো ঝুঁকি নেওয়ার সাহস করেছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রয়টার্সের পক্ষ থেকে সৌদি রয়েল কোর্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তারা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
বিষয়টি নিয়ে হোয়াইট হাউসেরও বক্তব্য জানার চেষ্টা করে রয়টার্স। তারা এর জবাব দেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে বলা হয়, সৌদি যুবরাজকে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে ফিলিস্তিনি নেতার সঙ্গে আলোচনা করতে বলেননি জ্যারেড কুশনার। তবে ফিলিস্তিনি নেতাদের আশঙ্কা, সৌদি যুবরাজ মূলত ইহুদি ধর্মাবলম্বী জ্যারেড কুশনারের অবস্থানই মাহমুদ আব্বাসের কাছে পুনরাবৃত্তি করেছেন। তারা বলছেন, সৌদি যুবরাজ যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে আর রাষ্ট্র গঠনের মতো উপাদান বিদ্যমান থাকে না।
ওয়াশিংটনের ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের সিনিয়র ফেলো শাদি হামিদ। রয়টার্স’কে তিনি বলেন, অধিকাংশ আরব রাষ্ট্রই ট্রাম্পের এ ঘোষণা নিয়ে আপত্তি তুলবে না। কারণ আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় তারা এখন ইসরায়েলের সঙ্গে অধিক সংযুক্ত। এর মধ্যে বিশেষ করে ইরানকে জবাব দেওয়ার বিষয়টিও রয়েছে।
সৌদি আরবের সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলের গোপন সম্পর্কের বিষয়টিও এখন নতুন কিছু নয়। এ বছরের নভেম্বরে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন, ইসরায়েলের জ্বালানিমন্ত্রী ইউভাল স্টেইনিৎজ। দেশটির ‘আর্মি রেডিও’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘অনেক মুসলিম ও আরব দেশের সঙ্গে আমাদের সত্যিকার গোপন সম্পর্ক রয়েছে। এ নিয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। সৌদি আরবই চেয়েছে ইসরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্ক গোপন রাখতে। এতে আমাদের কোনও সমস্যা ছিল না।’ ইসরায়েলি মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর সৌদি আরবও বিষয়টি অস্বীকার করেনি।
ইসরায়েলি জ্বালানিমন্ত্রী বলেন, ‘সৌদি আরবসহ কোনও আরব দেশ বা কোনও মুসলিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী হলে আমরা তাদের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানাই। আমরা সে সম্পর্ক গোপন রাখি।’
সৌদি-ইসরায়েলের সম্পর্কের সুবিধার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইরানকে প্রতিহত করতে সৌদিসহ আধুনিক আরব বিশ্বের যোগাযোগ আমাদেরকে সাহায্য করেছে। তেহরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর পরমাণু চুক্তির বিরুদ্ধেও আমাদের চেষ্টায় এই আরব দেশগুলো সহযোগিতা করেছে। এমনকি বর্তমানে সিরিয়ায় ইরানের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজেও সুন্নি আরব বিশ্ব আমাদের পাশে রয়েছে।’
উল্লেখ্য, পূর্ব জেরুজালেমকে নিজেদের ভবিষ্যত রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দেখতে চায় ফিলিস্তিন। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও শহরটিকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে মেনে নেয়নি। এখন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, ইসরায়েলবান্ধব ট্রাম্প প্রশাসন আর সৌদি আরব যদি একই এজেন্ডা বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করে সেটা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটা বড় দুঃসংবাদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। সূত্র:- রয়টার্স, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, মিডল ইস্ট মনিটর।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2iIlktF
December 09, 2017 at 10:20PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন