এহিয়া আহমদ :: ‘শিলং তীর’! ১ টাকায় ৭০ টাকার লোভে আজ দিশেহারা অনেকেই। এমন জুয়ায় কাউকেই সন্দেহ করা যায় না আবার অনেককেই সন্দেহ করা যায়। এমন সন্দেহের তীরের মাঝে মূল এজেন্টরা বাদ পড়ে যান। যারা ধরা পড়েন তারা শুধুমাত্র তীর জুয়ার খেলোয়ার। জেল-জরিমানা দিয়ে বের হয়ে ফের মজে যান জুয়ায়। কেউ কেউ মৌসুমী জুয়াতে ব্যস্ত থাকেন আবার কেউ কেউ স্থায়ীভাবে শিলং তীরের জুয়ায় মগ্ন থাকেন।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, শুরুতে সীমান্তবর্তী এলাকায় শিলং তীরের প্রভাব থাকলেও ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যা ভিত্তিক এই জুয়া ধীরে ধীরে তা সীমান্তবর্তী এলাকা পেরিয়ে নগরী-মহানগরীসহ প্রত্যেকটি উপজেলায় এর বিস্তার লাভ করতে থাকে। প্রথম অবস্থায় নগরীর নির্দিষ্ট দু/একটি জায়গায় এ সর্বনাশা জুয়ার আসর বসলেও এখন তা শত পেরিয়ে। চেষ্টা করেও শিলং তীরের ভয়ঙ্কর ছোবল থেকে তেমন কাউকেই রুখতে পারছে না প্রশাসন। এ খেলার বিস্তার সিলেটে দিন দিন বেড়ে চললেও প্রশাসন ‘শিলং তীর’ চক্রকে ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। খোলাখুলিভাবে তারা টিকিট বেচাকেনা করেন।
ভাগ্যের খেলায় জুয়ার আসরে বিভিন্ন পেশার লোকজন বাজি ধরলেও এতে বেশি আগ্রহী দিনমজুর, স্কুল-কলেজের ছাত্র, রিকশাচালক, যানবাহনের চালক-শ্রমিকসহ বেকার যুবকরা অংশ নিচ্ছেন। অনেক স্কুলগামী ছাত্ররা স্কুল ফাঁকি দিয়ে এ খেলায় অংশ নিচ্ছে। এতে পড়ালেখার পরিবর্তে জুয়ার প্রতি ছাত্রদের মনোযোগ বাড়ছে। এসব জুয়ার আসরে লাভের আশায় টাকা খরচ করা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা বেশিরভাগই সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরেন। বিশেষ করে এই ডিজিটাল জুয়ার প্রভাব পড়েছে তরুণ-যুবকদের মধ্যে। জুয়ায় আসক্ত এইসব তরুণদের ধারা দিন দিন বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ। দিন-দুপুরে যেখানে-সেখানে চুরি, ছিনতাইসহ আরো বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটছে।
‘শিলং তীর’ জুয়ার আসর সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানায়, মূলত এটি একটি কৌশলগত খেলা। খুবই অল্প সময়ে মানুষজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিরাট ফাঁদ এটি। এ জুয়ার আসর থেকে সাধারণ মানুষ যাতে মুখ ফিরিয়ে না নেন, সেজন্য প্রতি ৩-৪ দিনের মাথায় একজনকে জুয়ার বাজিতে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বাজিতে প্রাপ্ত টাকার অংক কম হলে সাথে সাথেই পরিশোধ করা হয়। টাকার অংক বেশি হলে পরদিন তা পরিশোধ করা হয়। একই ব্যক্তি একাধিক সংখ্যা নিয়ে জুয়া খেলতে পারেন।
জানা যায়, ভারতের সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন দুপুর ভাগের সময় থেকে শুরু হয় নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নাম্বার কেনা। কেউ কিনেন সরাসরি। কেউ কেউ আবার ‘বিকাশ’-‘রকেট’ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এ খেলায় অংশ নেন। ভারতীয় এজেন্টের মাধ্যমে দেশীয় এজেন্টরা ভারতের এজেন্টদের সাথে জুয়ার আসরের সমন্বয় করে থাকেন।
শিলং তীরের ওয়েবসাইটের সূত্রমতে, বেশকয়েকটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ‘শিলং তীর’র জুয়ার আসর পরিচালিত হচ্ছে। এই ডিজিটাল জুয়া খেলাটি সপ্তাহের ছয়দিনই বসে। প্রতিদিন দু বার এ খেলার ড্র অনুষ্ঠিত হয়। লটারিতে ০ থেকে ৯৯ পর্যন্ত যে-কোনো সংখ্যা কিনে নেয়া যায়। সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাজি ধরা যায়। লটারিতে একটি নাম্বারকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
পুলিশ সূত্র মতে, গত ৬ মাসে সিলেটে অন্তত শতাধিক জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এই জুয়ার আসর থেকে গ্রেপ্তারকৃত জুয়ারিদের আদালতে পাঠানো হয়। কিন্তু আদালতের নির্দেশানুযায়ী জেল ও জরিমানা প্রদান করে বের হয়ে আবারো জুয়ায় মগ্ন হয়ে উঠে জুয়াড়িরা। বিভিন্ন জুয়ার আসরের অভিযানে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা প্রশংসার দাবিদার। সাময়িক সময়ের জন্য এই জুয়ার আসরগুলো বন্ধ করা হলেও ফাঁড়ি ও গোয়েন্দা পুলিশের মাঠপর্যায়ের কিছু সংখ্যক সদস্যদের কারণে জুয়া খেলা স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে না।
নগরীর এমন কোনো এলাকা নেই যে, যেখানে তীর শিলংয়ের জুয়া খেলা হচ্ছে না। আর এসব আসরে কিছু কিছু পুলিশ সদস্যদের অবাধে যাতায়াত রয়েছে। জানা যায়, বর্তমানে সিলেট নগরীর কাজিরবাজার, সুরমা মার্কেট, করিম উল্লাহ মার্কেট, সোবহানীঘাট কাঁচাবাজার, উপশহর পয়েন্ট, তেররতন, শিবগঞ্জ, বালুচর, বড়বাজার, বন্দরবাজার, রিকাবিবাজার, তালতলা, মদিনা মার্কেট, তেমুখী, টুকেরবাজার, ঘাসিটুলা, কানিশাইল, ওসমানী মেডিকেল, লালবাজার, লালদিঘীরপাড়, হকার্স মার্কেট, সিটি মার্কেট, শাহী ঈদগাহ, আম্বরখানা, খাসদবীর, চৌখিদেখি, মালনীছড়া চা বাগান, লামাবাজার, শেখঘাট, কুয়ারপাড়, চাঁদনিঘাট, দক্ষিণ সুরমার কদমতলিস্থ বালুর মাঠ, ঝালোপাড়া, খেয়াঘাট, আলমপুর পুরাতন রেলস্টেশন এলাকা, লাউয়াই, কামালবাজার, তেতলীসহ শতাধিক স্পটে প্রতিদিন বসে ‘শিলং তীরের জুয়ার আসর। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রকাশ্যে নগরীর বিভিন্ন রাস্তাঘাট, বিভিন্ন সরকারি অফিসের পেছনের সাইট, বিভিন্ন কলোনি, রেস্টুরেন্ট, চা-দোকানসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান অবস্থায় এই খেলার নম্বর টোকেন বিক্রি হয়।
এ ব্যাপারে সিলেট কোতোয়ালী থানার ওসি গৌছুল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, গত তিন মাসের মধ্যে ৫৫-৬০ জনের মতো শিলং তীরের জুয়াড়িদের আটক করে আদালতের মাধ্যমে তাদের সাজা প্রদান করা হয়।
সিলেট শাহপরাণ থানার ওসি আখতার হোসেন জানান, গত তিন মাসের মধ্যে ১০-১২ মতো শিলং তীরের জুয়াড়িকে আটক করা হয়। আটককৃত জুয়াড়িদের আদালতের মাধ্যমে ২০০ টাকা জরিমানা ও ১ দিনের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। শাহপরাণ থানার পক্ষ থেকে বেশিরভাগই আটককৃত জুয়ারিদের জুয়া খেলা থেকে বিরত থাকার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। শাহপরাণ থানাধীন এলাকায় শিলং তীরের বোর্ডের খবর পাওয়া মাত্রই পুলিশি অভিযান দেওয়া হয়। শিলং তীরের জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল বলেন, শিলং তীরের জুয়া বন্ধের অভিযান অব্যাহত আছে। দক্ষিণ সুরমা থানাধীন যে-কোনো এলাকায় খবর পাওয়া মাত্র পুলিশ সদস্যরা অভিযান দেন এবং জুয়াড়িদের আটক করেন।
সিলেট মোগলাবাজার থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম জানান, গত তিন মাসের মধ্যে ২০-২২ জনের মতো আটক করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। মোগলাবাজার থানার বিভিন্নস্থানে জুয়ারবোর্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এ খেলা অনলাইন ভিত্তিক হওয়ায় জুয়াড়িরা অনেক তৎপর। শুধু মোগলাবাজার না শিলং তীরের জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে সবসময় পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, খবর পাওয়া মাত্র জালালাবাদ থানাধীন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। গত তিন মাসের মধ্যে ১০০ জনের উপরে শিলং তীরের জুয়াড়িদের আটক করা হয়। জালালাবাদ থানাধীন এলাকায় শিলং তীর সহ সবধরণের অপরাধের বিষয়ে সবসময় পুলিশের তদারকি রয়েছে।
সিলেট বিমানবন্দর থানার ওসি মোশাররফ হোসেন জানান, জুয়া খেলায় বেশিরভাগই তরুণরা জড়িত রয়েছে। গত তিন মাসে বিমানবন্দর থানাধীন ৩৫-৪০ জনের উপরে শিলং তীরের জুয়াড়ি আটক হয়েছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ ও স্কুল পড়–য়া। অনলাইন ভিত্তিক এই শিলং তীরের জুয়ার বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) আব্দুল ওয়াহাব বলেন, তীর শিলং খেলার বিরুদ্ধে প্রশাসন সবসময় কঠোর। তীর শিলংয়ে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে। যারা এই জুয়ার সাথে জড়িত এবং যারা এর নেতৃত্ব দেন তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে খেলে। এই ডিজিটাল জুয়াখেলা সিলেটে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ‘শিলং তীর নামক জুয়া মূলত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চলে। এই খেলায় মানুষ এতোই আসক্ত হয়েছে যে, একই পরিবারের বাবা-মা ও ছেলে মিলে জুয়ায় বাজি ধরছে। মানুষ সচেতন হলেই এই খেলা বন্ধ হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে (বিটিআরসি)-তে দুইবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে ওয়েবসাইটগুলো এখনও বন্ধ হয়নি।’ এই ওয়েবসাইটগুলো আদৌও বন্ধ হবে কি না তা বলা যাচ্ছে না। এই ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ হলে এই তীর শিলংয়ের জুয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, এ জুয়া অনলাইন ভিত্তিক হওয়ায় এবং জুয়াড়িরা মোবাইলের মাধ্যমে পরস্পর যোগাযোগ রাখায় পুলিশ এদের রুখতে পারছে না। ফলে মাঝে মধ্যে চিহ্নিত জুয়ার স্পটে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন জুয়াড়িকে আটক করার মধ্যে সীমাবদ্ধ পুলিশের তৎপরতা।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2D7xJ7f
January 13, 2018 at 08:29AM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.