লন্ডন, ০১ জানুয়ারি- সারা বিশ্বে বাঙালি সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন যে সব খ্যাতিমান মানুষ তাদের মধ্যে সমকালীন সময়ের একটি আলোচিত নাম সিলেটের এনাম আলী এমবিই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ব্রিটেনের কারি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যোক্তা ব্যক্তিত্ব নিজের কর্মদক্ষতায় অর্জন করেছেন সে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি এমবিই। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। পাশাপাশি ব্রিটেনের রাজনীতিতে সক্রিয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ বিভিন্ন সমাজ সেবায় নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। এনাম আলী এমবিই ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্যে লন্ডনে যান। ছোটবেলা থেকেই হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এর প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক ছিল। ১৯৮০ সালে লন্ডনের বর্নিমাউথ কলেজ থেকে হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। পাশাপাশি ১৯৯০ সালে লন্ডনের রয়েল সোসাইটি অব আর্টস থেকে ফেলোশিপ অর্জন করেন। তার আগে ১৯৮২ সালে ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হন। ব্রিটেনের এপসোম সুরিতে লি রাজ নামের রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন এনাম আলী। এই রেস্টুরেন্টটি আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত এতোটাই সুসজ্জিত- যেকোনো বিদেশি এলে এই রেস্টুরেন্টের আতিথেয়তা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। লন্ডন অলিম্পিকের একমাত্র অফিসিয়াল খাদ্য সরবরাহকারী লি রাজ রেস্টুরেন্ট দায়িত্ব পালন করে ২০১২ সালে। লন্ডন অলিম্পিকের মাধ্যমে এই রেস্টুরেন্টের সেবায় মুগ্ধ হন বিদেশি খেলোয়াড় এবং অতিথিরা। এরপর থেকে লি রাজ এর নাম ছড়িয়ে পড়ে পুরো লন্ডনজুড়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিনের অন্যতম কারি রেস্টুরেন্টের সুনাম অর্জন করে- মিসিলিং রেটিং এ গত ১৯ বছর ধরে শীর্ষে অবস্থান করছে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় সফলতার পরে এনাম আলী পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন। ট্রেড জার্নাল স্পাইস বিজনেস নামের ম্যাগাজিন প্রকাশ করছেন ১৯৯৮ সাল থেকে। তিনি সারা বিশ্বে কারি শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। সারা বিশ্বের নামি দামি খেলোয়াড, তারকা, রাজনীতিবিদরা নিয়মিত আতিথেয়তা গ্রহণ করেন লি রাজ রেস্টুরেন্টের। আর এর জন্যে তিনি লাভ করেন জাতীয় এবং আন্তজার্তিক নানা সম্মাননা। ব্রিটেনে প্রেস্টিজিয়াস রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার জন্যে কনফেরিয়ার ডি লা চেইনি দোস রোটিসুরস এর স্বীকৃতি এনে দেয় আরও খ্যাতি আর তিনি হয়ে ওঠেন এই শিল্পের তারকা ব্যবসায়ী। এশিয়ান রেস্টুরেন্টের মধ্যে এই স্বীকৃতি তিনিই প্রথম অর্জন করেন। বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাকে নিয়মিত অংশ নিতে দেখা যায়। তার রেস্টুরেন্টকে ঘিরে ব্রিটেনের শীর্ষ স্থানীয় টেলিভিশন এবং পত্রপত্রিকায় নিয়মিত ফিচার এবং রিপোর্ট প্রচার হয়ে আসছে। তাকে ঘিরে এই প্রচারণার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও অনেক উজ্জ্বল হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। এই কারণে স্পাইস রেস্টুরেন্ট হিসেবে ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা ভারতীয়দের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকে। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ শুধুমাত্র ক্ষুধার জন্যে খায় না। তা যদি সুস্বাদু হয়, পরিবেশন যদি মান সম্পন্ন হয়, তবে খাবারও একটি শিল্প। এই কারণে এনাম আলী আর তার লি রাজ এবং স্পাইস বিজনেস এর ক্ষেত্রে ব্রিটেনে বড় জায়গা দখল করতে পেরেছে। জনাব এনাম আলী ব্যবসায়ী হিসেবে যেমন সফলতা লাভ করেছেন তেমনি সামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্যেও ভূমিকা রাখছেন। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন দুর্যোগময় মুহূর্তে যেমন বন্যার্তদের সহায়তায় গত ২৫ বছরে ১.৩ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১৬ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করে তা গরীব মানুষের মাঝে বিতরণ করেন। ব্রিটেনেও এনথ্রনী নোলান ট্রাষ্ট, দ্যা ভিকটিমস অব তাইফুন হায়েন, বিবিসি চিলড্রেন ইন নিড অ্যান্ড দ্যা ওয়্যার আর্চার একাডেমি, সাভারে রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা এবং বাংলাদেশ ফ্লাড আপিলসহ স্থানীয় ও আন্তজার্তিক বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনকে সহায়তা প্রদান করে থাকেন। রাজনীতিতে তিনি ব্রিটেনে কনজারভেটিভ পার্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিট ক্যামেরনের একজন ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এনাম আলী। ২০০৮ সালে ব্রিটেনের রানি কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার এমবিই পদক লাভ করেন তিনি। ২০১১ সালে সিটি অব লন্ডন থেকে ফ্রিম্যান স্বীকৃতি লাভ করেন। একজন মুসলমান হিসেবে এই ঐতিহাসিক স্বীকৃতি তিনিই প্রথম লাভ করেন যা ১২৩৭ সাল থেকে ব্রিটেনে সূচনা হয়েছে। মানসিকভাবে উন্নত এবং উদার চেতনার অধিকারী এই ব্যক্তিত্ব মনে করেন, বিশ্বের উন্নত দেশ ব্রিটেনে বাংলাদেশের কারি এবং স্পাইস বিজনেস যত বাড়বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ততো উজ্জ্বল হবে। তিনি আরও বলেন, ব্রিটিশসহ সারাবিশ্বের মানুষ এখন বাঙালিদের খাদ্য পছন্দ করছে। রাষ্ট্রীয় অনেক অনুষ্ঠানেও তারা বাংলাদেশি খাবার নিয়ে যান এবং অতিথি আপ্যায়ন করেন। নানা উন্নয়নমুখি কর্মকাণ্ডের জন্যে এনাম আলী ২০১১ সালে সুরি কান্ট্রি কাউন্সিল থেকে পার্সোনালিটি অব দ্যা ইয়ার পুরস্কার লাভ করেন। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট মেম্বার এবং লর্ড চ্যান্সেলর ও সেক্রেটারি অব স্টেট ফর জাস্টিস চ্যারিস গ্যাইলিং এনাম আলীর হাতে এ পদক তুলে দেন। ২০১৫ সালে তিনি এনআরবি পার্সন অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন। তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে অধিক যোগ্য করে গড়ে তুলছেন এবং ধীরে ধীরে নিজেকে চূড়ান্ত বিকাশের পথে পরিচালিত করছেন। তার আরেকটি বড় পরিচিত তিনি কারি শিল্পের অস্কার খ্যাত ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড এর প্রবর্তক। ২০০৫ সালে তিনি এই অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করেন। কারি অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন জানান, দক্ষিণ এশিয়ায় এই শিল্পের অভ্যুদয় ঘটলেও বিকাশের গুণে এই মুহূর্তে তাদেরকে ছাড়িয়ে অনেক দূর পৌঁছতে সম্ভব হয়েছেন ব্রিটেনের কারি শিল্পীরা। এটি এখন ব্রিটেনের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। ডেভিড ক্যামেরুন এই অ্যাওয়ার্ডকে কারি শিল্পের অস্কার হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি আরও বলেন, ব্রিটেনে বর্তমানে বহু জাতির লোকের বাস। বাঙালি বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা প্রায় এক মিলিয়ন। আরও পড়ুন: যুক্তরাজ্যে বাঙালি স্কুলছাত্রকে পেটাল পাকিস্তানি পরিবার এক সময় ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বলা হতো বাংলাদেশি ব্রিটিশ। কারণ তাদের জন্মস্থান ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। এখন অসংখ্যা বাঙালি ব্রিটিশ রয়েছেন যাদের জন্ম ব্রিটেনেই। এই ক্ষেত্রে তাদের বলা হয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ। এরা ব্রিটেনের রাজনীতি, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এটি একটি ব্যবসা যে একটি কমিউনিটিকে স্বতন্ত্র্য পরিচয় এনে দেয় সেটি প্রমাণ করেছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা। নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে তারা বদলে দিয়েছেন ব্রিটিশ খাদ্যাভাসকে। কারি শিল্প ব্রিটেনের এক বিশাল স্থান দখল করে নিয়েছে। আগে যেমন সামর্থ্যবান বাঙালিরা খুঁজে ফিরতেন অনেক বড় বড় রেস্টুরেন্ট আর এখন ব্রিটেনের রাজ পরিবার থেকে শুরু করে পার্লামেন্টিরিয়ান এবং ব্রিটেনে অবস্থানকারী বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা খুঁজে নেন কারি রেস্টুরেন্ট। ব্রিটেনের আনাচে কানাচে এখন চিকেন টিক্কা মাসালার জয়জয়কার। ব্রিটেনের বিভিন্ন জায়গায় বর্তমানে ১২ হাজার ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে যার অধিকাংশেরই মালিক ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা। বাঙালির তৈরি চিকেন কারি এখন ব্রিটেনের জাতীয় একটি আইটেম। ব্রিটেনের জাতীয় অর্থনীতিতে বছরে ৫.২ বিলিয়ন পাউন্ড বিজনেস এখন কারি শিল্প ঘিরে। আর ব্রিটিশ কারি শিল্পের কথা উচ্চারিত হলেই চলে আসে এনাম আলীর কথা। অনেকে তাকে কারি শিল্পের যুবরাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাই নেতৃত্বেই বাংলাদেশি মালিকেরা ব্রিটেনে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট না লিখে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট হিসেবে নিজেদের পরিচিতিকে স্বীকৃত করেন। তিনি গিল্ড অব বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই শিল্পকে আরও এগিয়ে নিয়েছেন। ১৯৯২ সালে এনাম আলী এমবিই ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন লি রাজ রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার জন্যে। বর্তমানে টেরাকিউ লিমিটেডের প্রধান উপদেষ্টাদের একজন তিনি। প্রতিষ্ঠানটি জাতীসংঘের সাথে কাজ করছে। তিনি তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীর সাথে ২০০৬ সালে সিলেটে গড়ে তুলেছেন সিলেট মহিলা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল। ১৯৯১ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স বিবিসিসি এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের একজন তিনি। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের সম্মান আরও বাড়িয়ে তুলতে নিরলস কাজ করে চলেছেন দেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু এনাম আলী। সূত্র: ঢাকাটাইমস২৪ আর/১২:১৪/০২ জানুয়ারি
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2DH7wYI
January 02, 2018 at 06:10AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন