সিপাহী বিপ্লব থেকে ভাষা আন্দোলন: হাসান মার্কেটের যত ঐতিহ্য


সুরমা টাইমস ডেস্কঃঃ :: বৃটিশ বিরোধী সিপাহী বিপ্লব থেকে ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের আন্দোলন, সভা-সমাবেশ। মাঝে বাঙ্গালীর গৌরব আর অহংকারের নজিরবিহীন ভাষা আন্দোলন! এমনসব ঐহিহাসিক ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত স্থান সিলেটের গোবিন্দচরণ পার্ক। সেই পার্কটিই ১৯৫৯ সালের দিকে এসে এক পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তার অমরত্বের স্বাধ মেটাতে হয়ে গেল হাসান মার্কেট!

সিলেটের সমৃদ্ধ সোনালী ঐতিহ্যের হৃদয় চৌচির করে গড়ে উঠা হাসান মার্কেট যা এক সময় ছিল গোবিন্দচরণ পার্ক। সিলেট নগরীর বন্দরবাজার ও কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় এর অবস্থান।

এ মার্কেটের সোনালী ঐতিহ্যের কথা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন বই-পুস্তকে। তার কিছু কিছু দেখেছেন সিলেটের কিংবদিন্তর দুই ভাষা সৈনিক। তাদের একজন প্রফেসর আব্দুল আজিজ। অপরজন অধ্যক্ষ মাসউদ খান।

হাসান মার্কেট সম্পর্কে আরও জানা গেছে, ১৮৫৭ সালের বৃটিশ-বিরোধী সিপাহী বিপ্লবের সময় এখানে গাছ-গাছালি সমৃদ্ধ একটি মাঠ ছিল। ইংরেজরা সিলেট অঞ্চল থেকে কয়েকজন বিপ্লবী সিপাহীকে ধরে এনে এখানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল। ১৮৭৫ সালে এখানে বিপিনচন্দ্র পাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যাশনাল স্কুল, যে প্রতিষ্ঠান সিলেটে শিক্ষার আলো বিস্তারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

আজকের বিখ্যাত বিশাল এমসি কলেজের যাত্রাও এই হাসান মার্কেট থেকে। ভাষা সৈনিক প্রফেসর আব্দুল আজিজ বললেন, ‘ছোট ছোট মাচার মতো ঘরে এখানেই শুরু হয়েছিল এমসি কলেজের কার্যক্রম। পরে কলেজটির পরিধি বিস্তৃত হলে চৌহাট্টায় বর্তমান সদর হাসপাতালে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও অল্প জায়গা হওয়ায় ১৯২৫ সালে নিয়ে যাওয়া হয় টিলাগড়ের বর্তমান স্থানে। এরপরই ইনিঞ্জিনিয়ার গিরিস চন্দ্র দাস এখানে তার পিতার নামানুসারে গড়ে তুলেন গোবিন্দচরণ পার্ক।’

সেই পার্কের পরিবেশ এবং সিলেটবাসীর জন্য তার অপরিহার্যতা প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক বলেন, ‘সেকালে সিলেটবাসীর ঘুরে বেড়ানোর জায়গা বলতে ছিল এই পার্ক এবং এর পূর্বদিকের বর্তমান মিউনিসিপল মার্কেট। অপেক্ষাকৃত তরুন স্কুল-কলেজের ছাত্রদের প্রধান আড্ডাস্থল ছিল মিউনিসিপল মার্কেট, আর যারা একটু নিরিবিলি প্রকৃতির সান্নিধ্য চাইতেন তাদের জন্য ছিল গোবিন্দচরণ পার্ক। পার্কে কিছু বেঞ্চ ছিল, গাছগাছালিও ছিল। মানুষ এখানে বসতেন বা পরিবারের লোকজন নিয়ে হাটাচলা করতেন।’

ভাষা আন্দোলনেও আছে এই গোবিন্দ পার্কের ঐতিহাসকি ভূমিকা। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রথম জনসভাটি কিন্তু অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই পার্কেই। সেটি ১৯৪৮ সালের ৮ মার্চ। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন রাজীতিবিদ ও সপ্তাহিক নওবেলাল’ সম্পাদক মাহমুদ আলী। সেদিন উপস্থিত যারা ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, পীর হবিব, মকসুদ আহমদসহ আরও অনেকে।

বিশাল সেই জনসভায় উর্দুপক্ষের গুন্ডারা হমলা চালিয়েছিল। তারা ইট-পাটকেল ছুঁড়েই ক্ষান্ত হয়নি, তমদ্দুন মজলিস কর্মী, ভাষা সৈনিক মকসুদ আহমদকে মারধোর করে রক্তাক্ত করেছিল। তাকে সারা মাঠ ঘুরিয়ে টানা হেঁচড়াও করা হয়েছিল।

উর্দুওয়ালাদের ইটপাটকেলে আহত হয়েছিলেন আরও অনেক ভাষা সৈনিক। এরপর ৫২ সালের ৫ মার্চ পর্যন্ত এখানে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে অনেক সভা-সমাবেশ হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়ে আছে এই গোবিন্দচরণ পার্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রফেসার আব্দুল আজিজ বললেন, সিলেটে যুক্তফ্রন্ট আয়োজিত সব সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো এখানে। এই সময়ে গোবিন্দচরণ পার্কে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মানুষের পদধুলি পড়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম দেশ বিখ্যাত কবিয়াল চট্টগ্রামের রমেশ শীল ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।’

এরপর হাসান মার্কেট হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৫৯ সালের দিকে সিলেটের জেলা প্রশাসক ছিলেন পাকিস্তানি টি এম হাসান নামক এক সরকারি কর্মকর্তা। স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীদের লোভের সুযোগে নিজের নামকে অমর করে রাখতে বদ্ধ পরিকর হাসান সোনালী ঐতিহ্যের বুক খুদাই করে তারই নামে গড়ে তুললেন হাসান মার্কেট। আজও আমরা ঐতিহ্যবিস্মৃত হয়ে একজন পাকিস্তানির স্মৃতিকে ধরে রেখেছি। এ বড় কস্টের বড়ই লজ্জার।

ভাষা সৈনিক আব্দুল আজিজের প্রত্যাশা, সিলেটবাসী আরও দ্রুত ঐতিহ্যসচেতন হয়ে উঠবেন। হাসান মার্কেটের ব্যবসায়ীদের অন্যত্র জায়গা দিয়ে সিটি কর্পোরেশন এখানে আগের মতোই একটি পার্ক স্থাপন করবেন। সেই পার্কে দমবন্ধ হয়ে যাওয়া অবস্থায় সকালে বিকালে মানুষজন আসবেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে, নিবেন বিশুদ্ধ বাতাস। পাশাপাশি রাস্তাবন্ধ করে সিলেটে যেসব ছোটখাটো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ হয় সেগুলোও এখানে করা যেতে পারে।

এতে জনদুর্ভোগও অনেকটা কমবে বলে মনে করেন প্রফেসার আব্দুল আজিজ। একই ধরণের মত প্রকাশ করেছেন সিলেটের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি অধ্যক্ষ মাসউদ খান।

তিনিও জানিয়েছেন, ১৯৪৮ এর পুর্ববর্তী ঘটনাবলী সম্পর্কে তিনি খুব বেশি অবগত নয়। তবে ভাষা আন্দোলনে এই গোবিন্দচরণ পার্কটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সিলেটবাসীর জন্য অত্যন্ত গৌরব জনক এই ঐতিহ্যের কোন স্মৃতিচিহ্নই এখানে নেই। এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখ আর আক্ষেপের বিষয়।



from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2Cz4ncv

February 20, 2018 at 02:21PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top