বাড়ি নং ৫৭/৮, বালিগঞ্জ, কলকাতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মে থেকে এটাই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অফিস। বাংলাদেশের জন্মের সময়ে এখান থেকেই শোনা যেত কালজয়ী সব গান। কীভাবে জন্ম নিল এসব গান? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীরা বলেছেন সে রকম কয়েকটি গানের গল্প। লিখেছেন হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক। জয় বাংলা, বাংলার জয় কথা: গাজী মাজহারুল আনোয়ার সুর: আনোয়ার পারভেজ শিল্পী: শাহনাজ রহমতুল্লাহ বলেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার সঠিক সময়টা এই মুহূর্তে মনে নেই। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের ঘটনা হতে পারে। ওই সময় ফার্মগেটে একটা স্টুডিও ছিল। ওখানে নিয়মিত বসতাম আমরা। গান নিয়ে আড্ডা হতো। ওখানে বসে গানও লিখতাম। একদিন বসে ভাবছিলাম নতুন কিছু লিখতে হবে। দেশের জন্য। বঙ্গবন্ধুর বলা জয় বাংলাটাই ছিল আমার গানের শুরুর শব্দদ্বয়। এটা নিয়েই শুরু করলাম একদিন। ওই সময় এলেন আনোয়ার পারভেজ। আসার পর ওকে বললাম, আমাদের একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটা শুনেই আমার সঙ্গে বসল ও। লেখা চলতে থাকল। হঠাৎ ওই স্টুডিওতে হাজির হলেন আলতাফ মাহমুদ। তিনি গানের শুরুটা শুনেই বললেন, আরে গাজী, এটা দুর্দান্ত গান। লেখ লেখ। তাঁর উৎসাহে লেখার গতি বাড়ল। এটা বেশ বড় গান। লেখা শেষ হতেই আলতাফ ভাই ও আনোয়ার ভাই বললেন, এটা এখনই গাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ডাকা হলো শাহনাজকে (শাহনাজ রহমতুল্লাহ)। কোরাস গাওয়ার জন্য আরও কয়েকজন শিল্পীও এলেন। সেদিনই আমরা গানটা রেকর্ড করলাম। গানটা রেকর্ড করে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে দিই। ওই সময় এই গানটি সূচনা সংগীত হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। গানটি প্রচারের পর থেকে একটা উদ্দীপনা দেখা দেয় সবার মধ্যে। এখনো গানটা একই রকম জনপ্রিয়। ওই সময় আসলে এত কিছু ভেবে লিখিনি। তরুণ ছিলাম। গান লেখাটাই ছিল আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার। রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি কথা: আবুল কাশেম সন্দ্বীপ সুর: সুজেয় শ্যাম কণ্ঠ: সমবেত বলেছেন সুজেয় শ্যাম ২৫ মে কলকাতার বালীগঞ্জ থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম নতুন করে শুরু হয়। কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনের দিন। আমি দেশ থেকে গিয়ে যোগ দিই জুন মাসের শুরুতে। যেখানে আমরা কাজ করতাম সেটা ছিল একটা দোতলা বাড়ি। একদিন স্টুডিও থেকে নেমে আসছি। হঠাৎ দেখলাম আমাকে পেছন থেকে কেউ একজন ডাকছে, দাদা একটু শুনবেন। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখি সন্দ্বীপ দাঁড়িয়ে আছে। ওর পুরো নাম আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। আমি দাঁড়ালাম। বললাম, কী খবর? কয়েক ধাপ নেমে এসে ও বলল, দাদা আমি একটা গান লিখেছিলাম। সমর দাকে (সমর দাস) দিতে পারি না। ভয় করে। আপনি যদি একটু দেখেন। আমি হাতে নিয়ে পড়লাম। আমার খুব ভালো লাগল। মুখটা খুব সুন্দর। বঙ্গবন্ধু যে কথাগুলো বলে গেছেন সেই কথাগুলোই যেন প্রতিফলিত হয়েছে গানে। পরদিনই গানটি সুর করলাম। এটা ছিল আমার সুর করা দ্বিতীয় গান। দুই-এক দিনের মধ্যে গানটির রেকর্ডিং করলাম। পরে নিয়মিত বাজানো হতো গানটি। বিজয় নিশান উড়ছে ওই কথা: শহীদুল ইসলাম সুর: সুজেয় শ্যাম শিল্পী: অজিত রায় বলেছেন সুজেয় শ্যাম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমরা তখন বালীগঞ্জের সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করছি। ওই দিন সকালে আমার অন্য একটি গান করার কথা ছিল। সেভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। তখন অনুষ্ঠান সংগঠক (প্রোগ্রাম অর্গানাইজার) আশফাকুর রহমান খান আমাকে এসে বললেন, শ্যাম এই গান হবে না। বিজয়ের গান গাইতে হবে। আমি উত্তর দিলাম, বিজয়ের গান এখন কোথায় পাব। আমাকে উত্তর দিলেন, শহীদুল ইসলামকে বলো ও লিখে দেবে। শহীদুল আমার বন্ধু। এখন আর বেঁচে নেই। আমি গিয়ে বললাম, দোস্ত বিজয়ের গান লাগবে। ও একটু ভাবল। তারপর বলল, দোস্ত আমি মুখটা লিখে দিচ্ছি। তুই দাঁড়া। মিনিট দুই-তিনেক চিন্তা করে প্রথম চারটি লাইন লিখে দিল। বিজয় নিশান উড়ছে ওই/ খুশির হাওয়ায় উড়ছে/ উড়ছে উড়ছে উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে। ওই সময় হারমোনিয়াম ফাঁকা ছিল না। অন্য একজন শিল্পী হারমোনিয়াম নিয়ে অন্য একটা গানের সুর করছিলেন। একটাই হারমোনিয়াম ছিল বেতার কেন্দ্রে। পরে বাধ্য হয়ে মুখে মুখে গানটা সুর করলাম। ওই দিন অফিসটার মধ্যে অন্য রকম ব্যাপার কাজ করছিল। সবাই বেশ উজ্জীবিত। এরই মধ্যে পুরো গানটা চলে এল। হারমোনিয়ামও পেয়ে গেলাম। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে গানটা রেডি হয়ে গেল। আমি অজিত রায় দাদাকে অনুরোধ করলাম গানটা লিড দেওয়ার জন্য। তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। শিল্পীদের নিয়ে বসে গেলাম। এরই মধ্যে স্টুডিও ফাঁকা হয়ে গেল। আমি বসে গেলাম রেকর্ডিংয়ে। ঘণ্টাখানেকের কম সময়ের মধ্যে গানটি প্রস্তুত হয়ে গেল। দুপুরের দিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এলেন প্রবাসী সরকারের চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান। তাঁরা রেডিওর মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন। তারপরই গানটি বাজানো হলো। এভাবে একটি গান তৈরি হয়ে গেল। আর এটাই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ গান। তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর কথা ও সুর: আপেল মাহমুদ শিল্পী: রথীন্দ্রনাথ রায় বলেছেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমি কলকাতার বালীগঞ্জের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছাই ১৯৭১ সালের জুনের ১৩ বা ১৪ তারিখ। ৫৭/৮ এই দোতলা বাড়িটি সার্বক্ষণিক পাহারা দেওয়া হতো। যে কেউ চাইলে এখানে ঢুকতে পারত না। এদিকে আমি কলকাতার কিছুই চিনি না। প্রথমবার গিয়েছি। অনেক খুঁজে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পেয়েছিলাম। গিয়েই আমি তো পরিচিত সবাইকে পেয়ে গেলাম। কামাল লোহানী ভাই, আবদুল জব্বার আংকেল, আপেল মাহমুদসহ সবাই। আমাকে দেখেই সবাই বললেন, এই যে আইসা গেছে, আইসা গেছে। আর চিন্তা নাই। সবাই খুব কাছে টেনে নিলেন। জব্বার আংকেল বললেন, আব্বা, তুমি বিশ্রাম নাও। সন্ধ্যায় তোমার সঙ্গে দেখা হবে। লোহানী ভাই বললেন, এখানে খাওয়া-দাওয়া সব ফ্রি। মাসে হাতখরচ বাবদ ৫০ টাকা পাবি। আমি তাতেই রাজি। সেদিন দুপুরের পর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সন্ধ্যার দিকে আমাকে এসে আপেল ডাকছে মামু ও মামু ওঠ। আপেল আমার বন্ধু ছিল এবং আমাকে মামু ডাকত। আমার তখনো মাথার মধ্যে ঘুরছে আমি হয়তো পূর্ব পাকিস্তানে আছি। আমি ধড়ফড় করে উঠে বললাম কেন মিলিটারি আসছে নাকি? আমাকে বলল, এখানে মিলিটারি আসবে কোথা থেকে। তুই হাতমুখ ধুয়ে একটু ওপরে আয়। আমি একটা গানে সুর করেছি। তোকে একটু টান দিয়ে দিতে হবে। আমি হাতমুখ ধুয়ে ওপরে গেলাম। আপেলের সঙ্গে গানটার শুরুতে গাইলাম। প্রথম দিন গিয়েই গানটি গেয়েছিলাম। এটা আমার একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। সূত্র: প্রথম আলো এমএ/ ০১:৪৪/ ২২ মার্চ
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2puDxPe
March 22, 2018 at 07:53PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন