মুম্বাই, ০২ মার্চ- আর দশটা কিশোরীর মতো আমিও কত রাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। ভাবতাম, আমাকে তেমন দেখায় না কেন, যেমনটা দেখানো উচিত। কেন আমার পেট বেরিয়ে থাকে? কেন বাহুর মাংসপেশি ঝুলে থাকে? আমি ফরসা নই কেন? আমার চোখের নিচে কালো দাগ কেন পড়ে গেছে? আমি কেন আমার বয়সী ছেলেদের চেয়ে লম্বা? গায়ে ভাঁজের যে দাগগুলো আছে আমার, সেগুলো কি কোনো দিন আর যাবে না? চামড়ায় ফাটা দাগগুলো আজীবন থাকবে? এত লম্বা, এত কালো! কে বিয়ে করবে একে? ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এক আত্মীয় মুখ ফসকে বলেই ফেললেন কথাটা। আমার এত দিনের চাপা অনিশ্চয়তা সেদিন পাকাপোক্তভাবে বেরিয়ে এল সবার সামনে। আমার বয়স তখন ১৩। বাড়ির সবার সঙ্গে গোয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সঙ্গে দেখা। বন্ধুদের নিয়ে তিনিও গিয়েছিলেন ছুটি কাটাতে। আমরা তাঁর সঙ্গে একটা বিকেল কাটাই। আমার এখনো মনে আছে, নীল জিনস আর সাদা টপেও তাঁকে রাজকন্যার মতো দেখাচ্ছিল। তাঁর সৌন্দর্য আমাকে আরও এলোমেলো করে দিয়েছিল সেদিন। ১৫ বছর বয়সেও আমি তেমন একটা কিছু বুঝতাম না। শুধু জানতাম, আমি কোনো দিন নায়িকাদের মতো নিখুঁত হতে পারব না। কিন্তু ২ বছর পর জীবনে একটা অপ্রত্যাশিত বাঁক এল। সঞ্জয়লীলা বানশালী আমাকে সাওয়ারিয়া ছবির নায়িকা হিসেবে চূড়ান্ত করলেন। একটা দ্বিধার মধ্যে ছিলাম, আমি সিনেমার তারকা হতে পারব! নিজেকে দেখে তো এটা তখন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। একটা দুশ্চিন্তা তাড়া করে বেড়াচ্ছিল আমাকে। যদি আমাকে পিঠখোলা ব্লাউজ পরে নাচতে বলে, আর তখন যদি পিঠের অতিরিক্ত মাংস-চর্বি ব্লাউজের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে, তখন বলিউড কি আমাকে মেনে নেবে? গ্রহণ করবে? কেউ নিশ্চয়ই থলথলে চর্বি দেখার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে সিনেমার টিকিট কাটবে না। তাই এরপর আমি তারকাজগতের যোগ্য অংশ, কিছু অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অনুশীলন শুরু করলাম। একের পর এক নানা ধরনের ডায়েট মেনে চলতে থাকলাম। এমনও ডায়েট করেছি, যেখানে আমাকে দিনভর শুধু আনারসই খেতে হয়েছে। ওই ডায়েটে অন্য কিছু খাওয়া বারণ ছিল।সবকিছু ভুলে ব্যায়ামের ক্লাসে, যোগব্যায়ামের সেশনে কাটিয়েছি দিনের পর দিন। খাবারের সঙ্গে দূর-দূরান্তের সম্পর্ক সে সময় ছিন্ন করে ফেলেছিলাম। কোনো কোনো সপ্তাহে ওজন কমানোর জন্য এতই উন্মত্ত হয়ে যেতাম যে ভয়ে আমি কিচ্ছু মুখে নিতাম না। আমার বয়স তখন ১৮। একটা ছেলের সঙ্গে ডেটে গিয়েছিলাম। পরে ফিরে এসে ওই ছেলে আমার এক বন্ধুকে বলেছিল, সোনম তো বিশালদেহী! এটা শোনার পর আমি একটা পুরো দিন না খেয়ে ছিলাম। (সেই ছেলেবেলার ছেলেমানুষী ভুলগুলোর কারণে আমাকে এখন জীবনভর অ্যাসিডিটির মতো অসুখে ভুগতে হচ্ছে আর হবে।) আমি ভাবতাম, বিলবোর্ডে আমার বড় একটা ছবি এলেই নিজের ওপর থেকে বুঝি এই দ্বিধা আর অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। আমার ধারণা ভুল ছিল। বরং নায়িকা হওয়ার পর আমার আত্মগ্লানি আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। কত কত লেখা ছাপা হতো, অনলাইনে আমার ছবি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা হতো, ছোট ছোট খুঁত ধরা পড়লেই তাতে লাল দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে কত কথাই না বলা হতো। নারীর দেহ গড়ন নিয়ে সমালোচনা হওয়া নতুন কিছু নয়। তারকাদের ছোট ছোট খুঁতকে বিশাল ভুল মনে করাও আমাদের পুরোনো অভ্যাস। যদি জানতে চাই, মোটা বলে আত্মীয়রা কি কোনো দিন তোমাকে চর্বি ঝরানোর টোটকা দিয়েছে? যদি জানতে চাই, কালো বলে তোমাকে নিশ্চয়ই রোদ থেকে দূরে থাকার কথা শুনতে হয়েছে? নিশ্চয়ই জীবনের কোনো না কোনো সময় তুমি অন্যের মন্তব্য শুনে নিজের শরীরকে ঘৃণাও করেছ? হাত তোলো তো দেখি, আমাদের সংখ্যাটা কেমন! আমাদের ভুলগুলো কি জানো? আমরা সব সময় শিখে এসেছি নারীদের হতে হবে নিখুঁত, সেটা যতই অকল্পনীয় হোক না কেন। তাঁকে সব সময় আবেদনময়ী দেখাতে হবে, তা যতই অসামঞ্জস্যপূর্ণ হোক না কেন। মানবদেহের বাস্তবসম্মত দেহ গড়ন প্রকাশ করতে এখনো আমাদের বাধে। এমনকি হেয়ার রিমুভাল ক্রিমের বিজ্ঞাপনে আমরা ক্রিম ব্যবহারের আগে যে ত্বক দেখাই, সেটাও এত নিখুঁত থাকে যে তাতে কোনো লোমই থাকে না! সৌন্দর্য রক্ষার নিয়মকানুন কঠিন আর সব মেনে চলা প্রায় অসম্ভব। আনুশকা শর্মাকে কথা শুনতে হয়েছে রোগা বলে, সোনাক্ষি সিনহা উপহাসের শিকার মোটা বলে আর ক্যাটরিনাকে তামাশার পাত্রী হতে হয়েছে সব দিক থেকে ফিট বলে। তবে অবক্ষয় যেখানে, সেখানেই আছে সমাধান। গতানুগতিক সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা খুব একটা বিস্তৃত না। আর সমাধানটা ঠিক এখানেই। আমি যেমন পেয়েছি। আমি যেমন সৌন্দর্যকে চিনেছি, জেনেছি আমার জীবনকে ঘিরে থাকা নারীদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে। সিনেমায় নাম লিখিয়েছি এক দশকের বেশি সময় হলো। তখন আমার একরত্তি আত্মোপলব্ধিও ছিল না। তবে আমার জীবনকে ঘিরে রাখা নারীদের ধন্যবাদ, সেই সময়টায় আমার পাশে থাকার জন্য। তাঁদের কারণে আমি এখন নিজেকে নিয়ে এতটা সন্তুষ্ট। আমি সৌভাগ্যবান। কারণ, নম্রতা সোনির মতো একজন মানুষ আমার বন্ধু ও রূপসজ্জাকার। সে আমার আসল রূপ সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছে এবং প্রতিমুহূর্তে আমার ঈশ্বরপ্রদত্ত চেহারার প্রশংসা করেছে। যখন আমি নিজের গালের ভাঁজ আর চোখের নিচের কালি নিয়ে ঠাট্টা করতাম, তখন সে আমাকে বোঝাতোসৌন্দর্য এটাই। আমার মুখে একটা দাগ আছে। এই দাগের কারণে আমি যখন হাসি, তখন আমার ঠোঁটের একপাশ ওপরের দিকে উঠে যায়। এই খুঁত সারাতে আমি অনেক কিছুই করতে চেয়েছি একসময়। তখন নম্রতা আমাকে বুঝিয়েছে, এই দাগটাই, এই হাসিটাই আমাকে আমি বানিয়েছে। আমার খুঁতকে আমার জন্মগত ত্রুটি বলে এর পরিবর্তন করতে কখনো উৎসাহ দেয়নি নম্রতা; বরং এটাই আমাকে সবার থেকে আলাদা করে, এই উপলব্ধি সেই-ই আমার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি সৌভাগ্যবান রিয়ার মতো একজন বোন ও স্টাইলিস্ট আমার জীবনে আছে। আমার দেখা সবচেয়ে দারুণ মেয়ে রিয়া। ওর মতো গড়ন আর শরীরের ভাঁজ আমার নেই বলে আমি যখন নিজেকে দুষছিলাম, তখন সে আমার সব বাজে ভাবনায় ইতি টেনে দিল। সে আমাকে বোঝাল, আমি যা পরি আমি তাতেই সবার সেরা। আমি বারবার অভিযোগ করতাম, ২১ বছর বয়সে আমাকে যতটা প্রাণবন্ত লাগত, এখন আর ততটা লাগে না। কিন্তু রিয়া বলে, এখন আরও বেশি ভালো লাগে আমাকে। আমার জীবনের নারীরা আমাকে শিখিয়েছে, মন থেকে পাশে থাকলে, ভালোবাসলে, উৎসাহ জোগালে যেকোনো বন্ধু, বোন বা কাছের মানুষ তার প্রিয়জনের জীবন বদলে দিতে পারে। ভাবুন তো, দিনের শুরুতেই একটা সুন্দর প্রশংসা মনকে কতটা ভালো করে দেয়। কারও প্রশংসা করা তো খুব কঠিন কিছু না। তাহলে কেন আমরা কারও দিন ভালো করতে এই ছোট চেষ্টাটা করি না? আজ ৩১ বছর বয়সে এসে আমি আমার শরীর ও গড়নকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। কারণ, এটা ঈশ্বরপ্রদত্ত স্বাভাবিক সুস্থ শরীর। নিজেকে অনেক রোগা বানিয়ে নিখুঁত হওয়ার স্বাদ আমি নিয়েছি। এখন আমি একটা স্বাভাবিক সুস্থ জীবনযাপন করছি। আমি স্বাস্থ্যকর খাবার খাই, ঠিকমতো ঘুমাই, ভোরবেলা উঠি, নিজেকে প্রাণবন্তভাবে আবিষ্কার করি। সুস্বাস্থ্যেই সৌন্দর্য, এটাই এখন আমার উপলব্ধি। বাকিটুকু মিডিয়ার হাতে। এখন এটা তাদের ওপর যে তারা কোনটা উদ্যাপন করবে। সুস্বাস্থ্যে সৌন্দর্য, নাকি রোগা শরীর। এই দুইয়ের তফাতটা তাদের বুঝতে হবে। আমি এখন জানি, বলিরেখা, চোখের নিচে কালি, চামড়ার ফাটা দাগে কাটা দাগ, জন্মদাগ থাকা কোনো অপরাধ না। এগুলো আমাদের বেড়ে ওঠার সনদ। এই স্বাভাবিকত্ব হচ্ছে আসল সৌন্দর্য। বলে রাখি, আমি কিন্তু সাজগোজ কিংবা আকর্ষণীয় দেখানোকে নিরুৎসাহিত করছি না। আমাকে যারা চেনে, তারা জানে যে সেজেগুজে নিজেকে আকর্ষণীয় দেখাতে আমি কতটা ভালোবাসি। ফ্যাশন সচেতনতা আমাদের আত্মশক্তি বাড়ায়, সাজসজ্জা আমাদের ভালো থাকার অনুপ্রেরণা দেয় আর অলংকার-পোশাক আমাদের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করার জরুরি অনুষঙ্গ। কিন্তু এগুলোর প্রভাবে নিজের ঈশ্বরপ্রদত্ত সৌন্দর্যকে খুঁত বলে অবজ্ঞা করলে চলবে না। নিখুঁত হওয়া মানে হলো একটা ভয়ংকর উচ্চমূল্যের কল্পকাহিনি। সেই কল্পকাহিনি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার সময় এসেছে এখন। তাই যে কিশোরীরা আজ নিজের ঘরের আয়নার দিকে ঝুঁকে ভাবছ কেন তুমি নায়িকাদের মতো খুঁতহীন সৌন্দর্যের অধিকারী নও, তাদের বলব, তোমরা যে সৌন্দর্য দেখো, সেই সৌন্দর্য নিয়ে আমার ঘুম ভাঙে না। আমি এমন নই। কোনো নায়িকাই তেমনটা নন। দিব্যি দিয়ে বলছি, বিয়ন্সেও নন। আসল কথাটা এখন বলি: প্রতিবার মানুষের সামনে যাওয়ার আগে আমাকে ৯০ মিনিট সাজগোজের জন্য চেয়ারে বসে থাকতে হয়। তিন থেকে ৬ জন মানুষ কাজ করে আমার চেহারা আর চুল নিয়ে। অন্যদিকে একজন ব্যস্ত থাকে আমার নখ ঠিক করতে। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে আমার আইব্রুর যত্ন নিতে হয়। শরীরের এমন জায়গায় আমাকে কনসিলার ব্যবহার করে দাগ ঢাকতে হয়, যেখানে আমি ভাবতেই পারি না যে কনসিলার দিতে হবে। আমি প্রতিদিন ভোর ৬টায় উঠি। ব্যায়ামাগারে সাড়ে ৭টায় যাই। ৯০ মিনিট ব্যায়াম করি। বিকেলে আর রাতে ঘুমানোর আগেও করি। আমি কী খাব, কী খাব না এটা নিয়ে ভাবা একজন মানুষের চাকরি। আমি রূপচর্চার জন্য মুখে যে প্রলেপ দিই তাতে যা থাকে, ততটা উপকরণ আমার খাবার টেবিলেই থাকে না। একটা পুরো দল কাজ করে আমার জন্য উপযুক্ত সুন্দর পোশাক খুঁজে বের করতে। এরপরও যদি আমাকে নিখুঁত না দেখায়, তখন শুরু হয় ফটোশপ করে আমাকে সুন্দর দেখানোর কারসাজি। আমি আগেও বলেছি, বলেই যাব: একটা পুরো সৈন্য দল লাগে, প্রচুর টাকা লাগে আর অনেক অনেক সময় লাগে একজন নারী তারকাকে তারকাসুলভ করে তুলতে, যেমনটা তোমরা সব সময় দেখো। এই সৌন্দর্য-সাজসজ্জা মোটেও বাস্তবসম্মত না। একে আদর্শ হিসেবে ধরার কোনো কারণ নেই। বরং আদর্শ হিসেবে নিতে পারো, তাদের ঘুমের রুটিন। তাদের মতো নিখুঁত দেখানোর চেষ্টা না করে নিজের সুস্বাস্থ্যের জন্য কোন ব্যায়াম ভালো তার খোঁজ করতে পারো। নিজের শরীরকে বোঝার আর সুস্থ জীবনযাপন করার পথ খুঁজতে পারো। নিজের আত্মবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দাও। সুন্দর দেখানোর চেয়ে, উপলব্ধি করো যে তুমি সুন্দর, সুখী ও বাধাহীন। তোমাকে সুন্দর দেখাতেই হবেএই দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করো। এরপর থেকে তুমি যখন কোনো ১৩ বছরের মেয়েকে দেখবে ম্যাগাজিনে থাকা নায়িকার নিখুঁত ছবি দেখে আফসোসে ভেঙে পড়তে, তার সব ভুল ধারণা ভেঙে দিয়ো। তাকে বুঝিয়ে বোলো, সে নিজেই কতটা সুন্দর। তার হাসির প্রশংসা কোরো। তার সাহসের, তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা কোরো। তার চেহারা ত্রুটিপূর্ণ আর বিলবোর্ডে থাকা নায়িকা সবার সেরা, এই ভুল ধারণা নিয়ে তাকে বড় হতে দিয়ো না। তার সামনে এমন দৃষ্টান্ত বেঁধে দিয়ো না, যাকে অনুসরণ করা অসম্ভব। তাকে বোলো আমি ঘুম ভেঙে উঠে এমন নিখুঁত দেখাই না, সেও এমন দেখাবে না। আর এতে কোনো খারাপ কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক, এটাই সুন্দর। সূত্র: প্রথম আলো আর/১০:১৪/০২ মার্চ
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2FMVv6o
March 03, 2018 at 05:54AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন